প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দহন | মানুষকে মানুষের মূল্য দিন

বাতায়ন/দহন / কবিতা / ৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ ,   ১৪৩২ দহন   | সম্পাদকীয় "এর মধ্যেই আছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সে-কোন সন্ত্রাসবাদীই হ...

Friday, December 29, 2023

প্রথম উষ্ণতা | সুনীল কুমার হালদার

বাতায়ন/ধারাবাহিক/১ম বর্ষ/২৭তম সংখ্যা/ ১৩ই পৌষ, ১৪৩০

ধারাবাহিক গল্প
সুনীল কুমার হালদার

প্রথম উষ্ণতা

২য় পর্ব


পূর্বানুবৃত্তি উচ্চমাধ্যমিকে স্টার ও জাতীয় বৃত্তি পেয়ে স্কুলের নাম উজ্জ্বল করে গেছেন নাথদা। ভাল ছেলের তকমা ক্লাস সিক্স থেকে থাকাতে আমার মধ্যেও জেদ তৈরি হয়ে গেল, নাথদা পারলে আমাকেও পারতে হবে। ভাল ছেলে তকমা ছাড়াও যা কিছু থাকে একটা কিশোরের জীবনে সেসব কিছুই ছিল না আমার জীবনে। যারা এক কাপড়ে এপার বাংলায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল তাদের ছিন্নমূল ছাড়া আর কী বলা যায়! তারপর…


মেসোমশাই স্কুলমাস্টার ছিলেন, লোকে তখন মাস্টারমশাইদের গরিব স্কুলমাস্টার বলত, ক'টা টাকাই বা মাইনে পেতেন, যত দিন বেঁচে ছিলেন, দশজনের সংসার টেনেছেন, আপৎকালীন সঞ্চয়ের অবকাশ পাননি, ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে ওই রোগের চিকিৎসাও করা হয়ে ওঠেনি। শেষে যখন বাড়াবাড়ি হল, এক বিঘে চাষজমি বন্ধক রেখে চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে দেখানো হল, কিছুদিনের মধ্যেই হাসপাতাল জবাব দিয়ে দিল, জানা গেল, পুরোনো টনসিলের রোগটা আসলে প্রাথমিক স্তরের ক্যানসার ছিল! জবাব দিলে যা হয়, খড়কুটো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক, টোটকা, এইসব করেও শেষ রক্ষা করা যায়নি। টিউমার ক্রমশ বাড়তে লাগল, গলার বাইরে বেশ বড়সড় লাম্প হল, সেটা ফুটো হয়ে গিয়ে মাঝে মাঝে রক্ত পড়তে শুরু করল, অবশ্য কিছুক্ষণ পরে নিজে থেকেই রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যেত। শেষের সেই দিনের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। ক্রমশ ক্ষতটা পচতে শুরু করল, পচা দুর্গন্ধে সারা কামরা ভরে থাকত। ঝিমিয়ে থাকা মেসোমশাইয়ের মতন বাড়ির পরিবেশ সবসময় ঝিমিয়ে থাকত, যেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রদীপ নিভে যাবে, এইরকম পরিবেশ।

এই মানসিক পরিস্থিতির মধ্যেই আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া এবং তারপর এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্যে অপেক্ষা করা! বাড়িতে থাকতে ভাল লাগত না, চলে যেতুম মাসিমার পাশে চিত্তদার বাড়িতে। চিত্তদা সম্পর্কে মেসোমশাইয়ের একমাত্র বোনের ছোট ছেলে, গ্র্যাজুয়েট, কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে ক্লার্কের কাজ করেন। গ্রামের ভিতরে নিজেদের পৈতৃক ভিটে ছেড়ে নিজে বাড়ি করেছেন মাসিমার বাড়ির কিছুটা দূরে, যেখান থেকে পালেদের জঙ্গল শুরু হয়েছে, সেই জায়গায়। একহারা মেয়েলি চেহারা, সেই জন্যে গ্রামের যাত্রাপালায় চিত্তদাকে নারী চরিত্রে অভিনয় করতেও দেখেছি এক-দু'বার। বছর দুয়েক বিয়ে হয়েছে, মেয়ে, পাশের হৈবৎপুর গ্রামের, নাম কল্পনা, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে বসতে হড়কে গিয়ে বিয়ের আসরে। আমার থেকে দু'বছরের বড়, তাঁকে আমি কল্পনাবউদি বলেই ডাকতুম। ডানা কাটা পরি না হলেও মুখে একটা নরম সৌন্দর্য আর হাসি লেগে থাকত সবসময়। ইন ফ্যাক্ট, ওঁদের তিন ভাই-বোন-বাবা-মা সবার মুখে ওই অনাবিল হাসি লেগে থাকত, যা আমাকে গভীর ভাবে স্পর্শ করত। ওঁদের দেখে আমি নিজের অস্বাভাবিক গুমোট পরিবেশের কথা ভুলে যেতুম। ভাই রমেশ, আমার থেকে দু'বছরের ছোট, আমাদেরই স্কুলে আর্টস নিয়ে পড়ত, আর ছোট বোন আল্পনা, তখনও গার্লস স্কুলে, ক্লাস এইট হবে বোধহয়, ফ্রক পরে।

আমার নিজের পরিচয় বলতে ওই ভাল ছেলে, সে জন্যে কি না বলতে পারব না, কল্পনাবউদি আমাকে খুব পছন্দ করতেন, বাড়ি গেলে এটা-ওটা খাওয়াতেন। চিত্তদা অফিস চলে গেলে, উনি একা হাতে সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, আমি ওঁদের বাচ্চা মেয়ের সাথে দোলায় বসে দোল খেতুম। একদিন উনি বললেন, আর কিছুদিনের মধ্যেই তো তুই চলে যাবি, আমার বাপের বাড়ি হৈবৎপুর থেকে একদিন ঘুরে আয়, জায়গাটা বেশ খোলামেলা, অনেকটা জায়গা নিয়ে বাড়ি, গেলে তোর ভাল লাগবে। আমার মাসিমাকে জিজ্ঞেস করতে তিনি আপত্তি করলেন না। কল্পনা বউদিকে জানালুম, উনি বললেন, এই সামনের রোববার রমেশ এসে তোকে নিয়ে যাবে, মাত্র আধ ঘন্টার হাঁটা পথ।

পরের রবিবার, রমেশ এল না, বদলে ওদের বোন আলপনা তথা আল্পি এল। আল্পি ও দিদির মতন সুশ্রী, হাসলে ডানদিকে না বামদিকে একটা গজদন্ত ছিল, দেখা যেত। মাসিমা অর্থাৎ ওদের মা ছিলেন ভীষণ ফরসা, বাবা লম্বা ছিপছিপে চেহারা, সেই জন্যেই বোধহয় কল্পনাবউদি, রমেশ ও আল্পি বেশ সুশ্রী হয়েছে! ফরমালিটি করার কিছু ছিল না, চললুম আল্পির পিছু পিছু। একটা কাঁচা মেঠো পথ আমাদের গ্রাম থেকে বেরিয়ে গেছে হৈবৎপুরের দিকে। গ্রাম শেষে ধানক্ষেতের শুরু, ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে পথ চলে গেছে সুদূরে। পথের উপরে সাদা সমতল বেল মাটি, নির্জন, দু'দিকে সবুজ ধানক্ষেত, ধানগাছগুলোতে তখনও শিষ আসেনি, মোটা আর হৃষ্টপুষ্ট, দেখেই চাষে অভিজ্ঞ যে কোনো লোক বলে দেবেন, গাছগুলো গর্ভবতী, কিছুদিনের মধ্যেই শিষ বেরিয়ে আসবে। ধানগাছের এই অবস্থাকে বলে গাছে থোড় আসা। গর্ভবতী মায়েদের গা থেকে যেমন আলাদা একরকম গন্ধ বেরোয়, তেমনই একরকম মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে ছিল সারা পথ-মাঠঘাট আর আকাশ জুড়ে। সেদিন ছিল সূর্যকরোজ্জ্বল, সোনালি আলোয় ঝলমল করছিল প্রকৃতি, মাঠ ভর্তি সবুজ ধানগাছগুলো সেই সোনালি রোদে স্নান করছিল। তখন বোধহয় শরৎকাল ছিল, মাথার উপর ঘন নীল আকাশে সাদা ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ মাঝে মাঝে উড়ে যাচ্ছিল। আল্পি আমার আগে, আমি তার দু'হাত পিছনে, দু'জনে হেঁটে চলেছি নীরবে ও বোধহয় শরীরে হালকা প্রসাধন করেছিল, সব মেয়েরাই যা করে। ধানক্ষেতের সোঁদাগন্ধ আর আল্পির শরীরের গন্ধ মিলেমিশে একরকম মিষ্টি সুগন্ধ নাকে এসে সারা শরীরে আলাদা শিহরণ সৃষ্টি করেছিল, এক অনাস্বাদিত অনুভবের সাক্ষী থাকল আমাদের দু'জনের সেদিনের পথ চলা। মন্ত্রমুগ্ধের মতন কখন পৌঁছে গেছি আল্পিদের বাড়ি, আমি বুঝতেও পারিনি।

তারপর এক পা, এক পা, করতে করতে এখন অবধি পঁয়ষট্টি বছরের সফর। সে তো অনেক কথা।

 

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

জাল— মাছ কাটতে না জানলেও কিছু মানুষ জানে


Popular Top 10 (Last 7 days)