প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

শেষ থেকে শুরু [৫ম পর্ব] | পারমিতা চ্যাটার্জি

বাতায়ন/সাপ্তাহিক/ধারাবাহিক/২য় বর্ষ/১ ৯ তম সংখ্যা/ ৩০শে কার্ত্তিক , ১৪৩১ ধারাবাহিক উপন্যাস পারমিতা চ্যাটার্জি শেষ থেকে শুরু [৫ম পর্ব...

Wednesday, October 4, 2023

শারদ | শরতের পেঁজা মেঘ আর বিশ্বকর্মা পুজো | জয়িতা বসাক

বাতায়ন/শারদ/হলদে খাম/১ম বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১৯শে আশ্বিন, ১৪৩০

শারদ | হলদে খাম
জয়িতা বসাক

শরতের পেঁজা মেঘ আর বিশ্বকর্মা পুজো


প্রিয় শরৎ,

পেঁজা তুলোর মতো মেঘগুলোকে সেদিন ডেকে বলছিলাম, কতদিন তোদের আর দেখি না! ছোটবেলায় দেখতাম পালকের মতো দুটো ডানা লাগিয়ে কেমন আনন্দে গা ভাসিয়ে দিতিস। তবে কেন এখন আর আগের মতো নীল আকাশে ভেসে যাস না? মাঝে মাঝে ফিরেও তো আসতে পারিস, একবার উঁকিও তো মেরে যেতে পারিস আমার শৈশবের সেই সব পুরোনো দিনগুলিতে! সময়ের পলি জমে জমে আমার সব তরল অতীত কখন যেন ভরাট হয়ে গেছে। এখনো মনে পড়ে,

ছোটবেলায় আকাশের দিকে প্রায়ই তাকিয়ে থাকতাম, তবুও যেন টের পেতাম না বর্ষা পেরিয়ে কখন তুই এসে দাঁড়িয়েছিস আমার বারান্দায়। রাস্তার ধারে একটা ছোটো শিউলিগাছ, সারা-গায়ে শরতের সুগন্ধ মেখে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। ভোর হলেই বাতাসকে তোয়াক্কা না করে কীভাবে যেন একরাশ ফুল ঝরে পড়ত রাস্তার নোংরা ধুলায়। কেউ কোনোদিনই কুড়োত না, তবুও রোজ রাতে ওরা ফুটত আর তারপর সকলের অজান্তে কখন যেন ঝরে যেত।

শরৎ মানেই বাঙালির মনে ডাক দিয়ে জেগে ওঠে দুর্গাপুজো। কিন্তু তোর মনে আছে শরৎ, দুর্গাপুজোর ঠিক আগে আমার শৈশব, বছর ভর অপেক্ষা করে থাকত ভাদ্র সংক্রান্তির বিশ্বকর্মা পুজোর জন্য। কেন জানি না, আকাশের বুকে ভেসে ভেসে খেলা করা রংবেরঙের ঘুড়ির প্রতি আমার আজন্ম একটা গভীর টান ছিল। পেঁজা তুলোর মতো মেঘ দেখলেই মনের মধ্যে চাঁদিয়াল, পেটকাটি, ময়ূরপঙ্খী, মুখপোড়া কত সব নাম অবিরাম গুনগুন করত। ভাদ্রের নীল আকাশে পাখির মতো ডানা মেলে ওরা পতপত করে উড়ে বেড়াত। আমি ঘুড়ি ওড়াতে পারতাম না একদম, কিন্তু ঘুড়ি কেটে এলে দৌড়ে গিয়ে টপ করে ধরতে পারতাম। সাথে থাকত লম্বা একটা লগা। আর সেই লগার মাথায় বাঁধা মোটা নারকেলদড়িতে পেঁচানো মস্ত একটা ঢিল। আমাদের পাড়া মানে উত্তর কলকাতার ফড়িয়াপুকুর (শ্যামবাজার) ছিল ঘুড়ি লাটাইয়ের আড়ত। পুজোর কদিন আগে থেকেই মাচা বেঁধে অনেক ঘুড়ির দোকান রাতারাতি গজিয়ে উঠত। রাতদিন সেখানে বিস্তর ঘুড়ি, সুতো কেনাকাটা। এমনিতে স্থায়ীভাবে রাস্তার দু’ধারে খেলনা, পাঞ্জাবি আর মিষ্টির দোকানের পাশাপাশি ছিল লোহালক্কড়ের বেশ কিছু দোকান আর কারখানা। তাই বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন থেকে পাড়া জুড়ে দেদার মাইক চালিয়ে শুরু হয়ে যেত উৎসবের রমরমা। আশপাশের অনেক বাড়িতে আগের দিন সুতো কিনে তাতে সাবু চটকানো মাড় আর মিহি কাঁচের গুঁড়ো মিশিয়ে জম্পেশ মাঞ্জা দিত।

পুজোর দিন খুব ভোর থেকেই আকাশ রঙিন হয়ে যেত। টপাটপ ঘুড়ি উড়ত আর ওড়া মাত্রই ঘুড়িগুলো পরস্পর পরস্পরের শত্রু হয়ে যেত। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত। প্রতিপক্ষের ধারালো সুতোর টান লাগলেই ঝপাঝপ ঘুড়িগুলো কাটত। আর কেটে এদিকে এলেই, আমি আর দিদি দু’জনে মিলে খপাখপ সেগুলো ধরতাম। তখন আমাদের প্রাণখোলা শৈশব। তার আরো কয়েকবছর পরে আমার খুড়তোতো ভাই যখন নার্সারি পেরিয়ে প্রথম স্কুলে উঠল, তখন থেকে ওই হত আমার সাগরেদ! তোর মনে পড়ে শরৎ, কোনো কোনো বার তোর গোঁসা হলে, তুই অনাবিল বৃষ্টি ঢেলে দিতিস! আর সেদিন আকাশের সব আসমানী রং বৃষ্টির জলে ধুয়ে গড়িয়ে নেমে আসত মনখারাপের উঠোনে।

শরৎ তোর মনে আছে সেসব বর্ণময় দিনের কথা? উত্তর কলকাতার সব বাড়িগুলোই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে সবসময় দাঁড়িয়ে থাকত। একটা বাড়ির সর্দি লাগলে, পাশের বাড়ি হাঁচত। সেরকমই, আমাদের বাড়ির সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকত পাশের বাড়ি। ফলে দু’টো ছাদ ছিল একদম লাগোয়া। পাশের বাড়ির এক বড় দাদা, মাঝেমাঝেই পাঁচিল টপকে, আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে আমাদের ছাদে নেমে আসত। আর সহজেই গাছের ফুল কিংবা কেটে আসা ঘুড়ি তুলে নিয়ে পালাত। সেসব টের পেলেই, আমার কী ভীষণ কান্না! আসলে শৈশব মানে এমনই! ছোট ছোট জিনিস পেলে যেমন অনাবিল আনন্দ তেমন বঞ্চিত হলে ভয়ানক কষ্ট। আমাদের সামনের বাড়ির বুবাইয়ের সাথে ঘুড়ি ধরা নিয়ে বেশ আলগা প্রতিযোগিতা হত। কে ক’টা ঘুড়ি ধরল, আড়চোখে দেখে হিসেব হত। বিশ্বকর্মা পুজোয় সারাদিনে দশ-বারোটার বেশি ঘুড়ি কখনো নামাতে পারিনি। বুবাই মাঝে মাঝে ওর মামারবাড়ির গল্প বলত। সেই বলার মধ্যে বেশ বিজ্ঞের মতো ভাব ছিল। বলত— “জানিস আমার মামারবাড়ি বড়বাজারে, আজকের দিনে এত্ত ঘুড়ি ওড়ে, যে কী বলব! আকাশ জুড়ে সুতোর লাইনে পড়ে যায়। একবার লগা তুলে ঘোরালেই একসাথে ডজন খানেক ঘুড়ি তুড়ি মেরে নামিয়ে আনা যায়।” আমি আর দিদি বড় বড় হ্যাঁ করে সেসব গল্প শুনতাম। আর সেই হ্যাঁ দিয়ে মুখে মধ্যে নেহাত মাছি কেন, ইয়া বড় বড় হাতি অনায়াসেই সেঁদিয়ে যেতে পারত!

পুজোর দিন খুব সকাল থেকেই আমার ছাদ-ডিউটি। চোখে একটা রোদচশমা এঁটে, সকাল, দুপুর সবসময়ই আমি অন-ডিউটি। দিদির আবার এতটা নেশা ছিল না। ও ডিউটিতে ভয়ানক ফাঁকি মারত। চান-খাওয়ার জন্য আমি অফ-ডিউটি হলেই, হয় ছাদ টপকে ঘুড়ি নিজেই উড়ে পালাত নয়তো পাশেরবাড়ির হাড়বজ্জাত ছেলেটা চক্ষুদান দিত। দুপুর পেরিয়ে বিকেল হলেই সব ছাদেই পুরো পরিবারের সবাই উঠে আসত। ইঁট পেতে বসে চা, বিস্কুট, মুড়িমাখা খাওয়া চলত। প্রতিবেশীদের সাথে সুখদুঃখের আড্ডাও চলত। জীবনটা তখন বড় বেশি জমজমাট ছিল। মাইকের গানের শব্দ ছাপিয়ে যখন 'ভো-ও-ও-ও-কা-আ-ট্টা...' হত, তখন লগা উঁচিয়ে আশেপাশের ছাদের সবাইকার সারি সারি চোখ আকাশের দিকে ঘুরপাক খেত। উর্দ্ধমুখে তাকিয়ে অজস্র ঘুড়ির মাঝে কাটা ঘুড়িটাকে সবাই খুঁজত। পোক্ত ঘুড়ি উড়িয়েরা কাটা ঘুড়িটাকে কায়দা করে লটকে নিত। সামনের বাড়ির ছাদে বুবাইয়ের ছোটকা, ন-কা ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াত। আমাদের বাবা, কাকারা আবার ঘুড়ি ওড়ানোর হ্যাপার ধার ধারত না। কেটে আসা ঘুড়ি ধরে আর হাত্তার সুতো গুটিয়েই সারা বিকেল কাটিয়ে দিত। তারপর বিকেল গড়িয়ে খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে আসত। তখনও ইতস্তত কিছু ঘুড়ি উড়ত। একে একে সব বাড়িগুলোতে সন্ধ্যার শাঁখ বেজে উঠত। পশ্চিম আকাশের আবির ধোয়া আলো আস্তে আস্তে মুছে গিয়ে একসময় সাঁঝতারাও উঠে এসে ঘুড়িগুলোর পাশে ঝুলে থেকে ঝকঝক করত, কিন্তু আমরা ক্ষান্ত হতাম না। তারপর অন্ধকার আরো গাঢ় হত। চাপচাপ গাঢ় অন্ধকারে আশপাশের বাড়ির ছাদে থাকা মানুষেদের চেনা মুখ একসময় ঢেকে যেত, শুধু কালো মাথা ছাদ জুড়ে ঘুরঘুর করত। তখনও আমরা মায়ের বারংবার ডাক উপেক্ষা করে, অন্ধকারে কেটে আসা ঘুড়ির শেষ সুতোগুলো খুঁজতাম। তারপর যখন নিজেদের হাত-পাগুলোকে আর নিজেরা খুঁজে পেতাম না, তখন তল্পিতল্পা গুটিয়ে সোনামুখ করে ছাদ থেকে নেমে আসতাম। ঘরে আসার পর শুরু হত আরেক বিপত্তি। সারাদিন রোদে থেকে থেকে চোখে তখন সর্ষে ফুল দেখতাম। ঘাড় ব্যাথার সাথে 'হাই হাই' হাই উঠত। আর আয়নার দিকে তাকিয়ে কেলেকুলো নিজেকে আর চিনতেই পারতাম না। এ তো গেল আনন্দের কথা। এবং এই অনাবিল আনন্দ কালেভদ্রেই হত। বেশিরভাগ পুজোর দিন মনখারাপেই কাটত। কারণ আমাদের স্কুলে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই 'হাফ ইয়ারলি' পরীক্ষা শুরু হয়ে যেত। মহালয়া কাটিয়ে সেই পরীক্ষা শেষ হত। এই নিয়মের সাধারণত ব্যাতিক্রম হতই না। পড়তে বসে জানলার রেলিঙের ফাঁক দিকে ছেঁড়া আকাশের দিকে বুভুক্ষুর মতো তাকিয়ে থাকতাম। কপাল ভাল থাকলে, নেহাত পুজো যদি অক্টোবরের শেষে হত, কিংবা সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি হত, তখন পরীক্ষাগুলো আগেই হয়ে যেত। আমার হাড় জুড়োত। এমনকি পরীক্ষা না থাকলেও বিশ্বকর্মা পুজোয় আমাদের ছুটিও দিত না, কখনো কখনো হাড়কিপ্টের মতো একটা হাফ ছুটি ধরিয়ে দিত। যার ফলে ঘুড়ি ধরার সব আনন্দটুকু মাঠেই মারা যেত। তখন মনে হত বস্তির ওই ছেলেগুলো, যারা কারখানার চালায় উঠে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, ওদের কী মজা ! পড়াশুনো নেই, পরীক্ষা নেই। সারাদিন শুধু আনন্দ, আনন্দ আর আনন্দ ... ইশ্‌! আমিও যদি ওদের মতো হতে পারতাম!

ঋতুর হাত ধরেই সময়ের চাকা শুধু ঘুরতেই থাকে। চাকার দাগে লেগে থাকে দিন বদলের গল্প। শৈশব, কৈশোরের অনাবিল স্রোত থেমে যায়। শরৎ, তোর গায়ে লেগে থাকা চিরন্তন গন্ধটা জীবন থেকে ফিকে হতে হতে, একসময় যেন হারিয়ে গেল। পেঁজা তুলোর মতো মেঘ আমার জানলায় এখন আর ভেসে আসে না।  শিউলিগাছটা হয়তো ওখানেই আছে, শুধু ফুলের গন্ধটাই এখন আর পাই না।

এখন আমি প্রযুক্তি কলেজে চাকরি করি। আজ সতেরো বছর ধরে ওই দিনটা আমার ছুটি থাকে। কিন্তু জানিস শরৎ, আমার এখন আর আকাশ দেখার কথাই মনে থাকে না। জীবনের ঘুড়ি ধরার জন্য ছুটতে ছুটতে কখন যেন নীল আকাশ, রঙিন ঘুড়ি, অনন্ত সুতো, ঘুরন্ত লাটাই সব হারিয়ে ফেলেছি... এক্কেবারে ভো-ও-ও-ও-কা-আ-ট্টা...


ইতি,

ছোট্টবেলার টুপুস


1 comment:

  1. শরতের স্মৃতিকথা ভালো লাগল।ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব বাড়ির ছাদে এ সকলের অভিজ্ঞতা।

    ReplyDelete

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)