প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

রং | প্রতিজ্ঞা

  বাতায়ন/ রং /সম্পাদকীয়/২য় বর্ষ/ ৩ ২তম সংখ্যা/ ২৯শে ফাল্গুন ,   ১৪৩১ রং | সম্পাদকীয়   প্রতিজ্ঞা "নির্ভীক একটি ফুলের মতো মেয়েকে চরম লাল...

Saturday, September 16, 2023

গহনার পুতুল | সীমা ব্যানার্জী-রায়

বাতায়ন/সাপ্তাহিকী/ধারাবাহিক/১ম বর্ষ/১৯তম সংখ্যা/২৯শে ভাদ্র, ১৪৩০

ধারাবাহিক গল্প

সীমা ব্যানার্জী-রায়

 

গহনার পুতুল

[১ম পর্ব]

 

নিনা। একমাত্র সন্তান। আদরে আহ্লাদে বড় হয়েছে সে। দুঃখের আঁচড় গায়ে লাগতে দেননি মা-বাবা। নিনা বিএ পাশ করার পরই বাবা-মা ওর বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। মেয়ের বিয়ে হবে। নাতি-নাতনিতে ঘর ভরে উঠবে আনন্দে, এই কামনাই একমাত্র নিনার বাবা-মায়ের মনে।

নিনার বাবা প্রবালবাবু ছিলেন খুবই অবস্থাপন্ন। কলকাতা শহরের উপর ছিল তিনতলা বাড়ি। চাকরবাকর ভরা সেই বাড়িতে। পদমর্যাদাও বেশ আছে। এখনও রিটায়ার করেননি। জাঁকজমকেরও কোন কমতি নেই। তার উপর নিনা ওদের একমাত্র মেয়ে। তাই পাত্র পেতে একটুও অসুবিধা হল না। সংবাদপত্রে নিনার বাবার বিজ্ঞাপন দেখে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছির মতো ছেলেদের বাবারা আসা শুরু করলেন মৌ-এর খোঁজে। প্রবালবাবু এবং ওঁর স্ত্রী রূপার পছন্দ মতো একটা ছেলে হাতের কাছেই পাওয়া গেল।

ছেলে ওই একটাই ভাস্করবাবুর। মেয়েও একটি। তবে সে নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে সুখে আছে। বাবা-মা’র সঙ্গে সে রকম যোগাযোগ নেই। ছেলে পার্থ সিএ পাশ করে চাকুরি করছে। ভাস্করবাবু এবং ওঁনার স্ত্রী অনন্যাদেবী গরিবের সন্তান ছিলেন। নিজেদের অধ্যবসায়ে একটা বাড়ি করতে পেরেছেন তাই নিয়ে ওনারা বেশ গর্বিত।

 

ছেলে পছন্দ হলেও এ বিয়েতে প্রবালবাবুর মনে একটা দ্বিধা। স্ত্রীকে বললেন, ‘পার্থর বয়স নিনার চাইতে বেশ বেশি।’ রূপাদেবী শুনে বললেন, 'পার্থর বয়স মোটেই বেশি দেখায় না। নিনাকে দূরে কোথাও পাঠাতে হবে না। ওকে না দেখে আমরা থাকব কী করে? এটাই তো বেশ ভাল হবে। আমাদের চোখের সামনেই থাকবে, যখন ইচ্ছা আসবে-যাবে। আগেকার দিনে তাই তো হত। আর সুখী হওয়ার খবরও পাওয়া যেত। জানো তো, আমার মা বলতেন বয়সে একটু বেশি হলে বৌ নাকি বরের খুব আহ্লাদী হয়। যেমন আমি, বলেই লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেললেন রূপাদেবী। তুমি ওই একটা সামান্য কারণে আপত্তি কোরো না, প্লিজ। পার্থর সঙ্গেই নিনার বিয়ে ঠিক করো। আমার মন বলছে নিনা খুব সুখী হবে।’ কাজেই আর আপত্তি করলেন না প্রবালবাবু। ভাল দিন দেখে বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দিলেন।

 

খুব ধুমধাম করে নিনা-পার্থর বিয়ে হয়ে গেল। মানুষের জীবনে এবং সমাজে অনেক রীতির বদল ঘটেছে। কিন্তু মেয়ের বিয়ের সমস্ত জরানা দেওয়ার সামাজিক রীতি, আইন করেও বদলানো যায়নি আজও। সে যাই হোক, নিনার বাবার অর্থের অভাব ছিল না। তাই খুশি মনেই তাঁরা মেয়ের বিয়েতে চাহিদার অতিরিক্তই দিয়ে সাজিয়ে পাঠালেন মেয়েকে।

 

প্রচুর গহনা, দানসামগ্রী নিয়ে নিনা শ্বশুরবাড়ি ঘর করতে এল। কিন্তু সেখানে গিয়ে নিনার মনে হতে লাগল সে যেন অথৈ জলে পড়ে গেছে। স্বামীকে তো কাছেই পাওয়া যায় না! ঘুমোতে আসার আগে পার্থ মা-বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে। ততক্ষণে বেচারা নিনা ঘুমিয়ে পড়ে। সারাদিনের জমানো গল্প তো একজনের সঙ্গেই করা যায়। তাই তো বলেছিল মা বিয়ের আগে। কিন্তু ঢুলতে ঢুলতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে, বুঝতে পারে না।

 

সকালে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই পার্থ অফিসের জন্য তৈরি হয়ে যায়। অনন্যাদেবী নিজে হাতে জলখাবার তৈরি করে ছেলেকে খেতে দেন। নিনা কুণ্ঠা বোধ করে। মনে পড়ে, মা শ্বশুরবাড়ি আসার সময় বলে দিয়েছিলেন, পার্থর অফিস যাওয়ার সময় খাবার এবং অফিস থেকে আসার পর সব কিছু নিজের হাতে করার জন্য। নিনা বড়লোকের আদরের মেয়ে হলেও এসব যে জানে না, তা নয়। বাবার জন্য এ কাজগুলো ও নিজের হাতেই করত। কারণ মা-ই হাতে করে সব শিখিয়ে রেখেছিলেন মেয়েকে। যাতে মেয়ে বিয়ের পর অসহায় বোধ না করে। কিন্তু সে শিক্ষা কীভাবে কাজে লাগাবে বুঝে পায় না নিনা।

 

স্বভাবতই নিনার অভিমান হয় পার্থর ওপর। শাশুড়ি একটু সরতেই একদিন নিনা কান্না ধরা গলায় পার্থকে বলল, 'তুমি আমায় ডাকো না কেন? আমিই তো তোমার খাবার করে দিতে পারি। মা'র এত সকালে ওঠার কী দরকার? তাই তো উনি বিয়ে দিয়েছেন তোমার, তাই না? আর আমারও তো ইচ্ছে হয়, নিজের স্বামীকে একটু আদরযত্ন করে খেতে দিতে?'

 

পার্থ ভীরু দৃষ্টিতে চারদিক দেখে নিয়ে ফিশফিশ করে বলল, ‘তোমার তো এ সব করার অভ্যাস নেই, তাই ডাকি না। আর মা-ও তাতে বেশ দিলখুশ দেখেছি। পরে তো মা না থাকলে তোমাকেই সব করতে হবে। এখন না হয় বিশ্রাম নিয়ে নাও। বলে ওর টিকোলো নাকটা একটু নেড়ে দেয়।’

 

পার্থ অফিস থেকে ফিরে আসার পরও সেই একই ঘটনা। নিনা রান্নাঘরে ঢুকলেই অনন্যাদেবী বলেন, 'তোমার কষ্ট হবে নিনা, আমিই পার্থকে খেতে দিচ্ছি। আর তা ছাড়া, এসবের তো তোমার অভ্যেস নেই। যাও গিয়ে বিশ্রাম নাও। এখন এত সব করলে শরীর খারাপ হবে, আর চোখে-মুখে কালি পরে যাবে।' এই বিশ্রাম নিতে নিতেই তো কাবার হয়ে গেল বিয়ের চার মাস। আর কত বিশ্রাম নেবে সে? কখনো কখনো একলা আকাশের দিকে তাকালে চোখে পড়ে যেন একটা নক্ষত্র মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সেই মুহূর্তে ওর মনে হয় এই নশ্বরতার বিরুদ্ধে নেমে পড়ি।

 

ছুটির দিনেও সেই একই ব্যাপার। পার্থর অফিসের গাড়ি করে ভাস্করবাবু ও অনন্যাদেবী নিনাকে ‘গহনার পুতুল’ সাজিয়ে আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যান। ভাল ঘরের মেয়েকে বৌ করে আনতে পেরেছেন, অনন্যাদেবীর গর্বের সীমা নেই। সেটা তাঁর হাবভাবে স্পষ্ট বোঝা যায়।

 

সারাদিন যে কীভাবে কাটে তা একমাত্র নিনাই জানে। তার নিজের মা’র মতন তো আর গল্প-উপন্যাস পড়ে, আর এখনকার টিভি সিরিয়াল দেখে সময় কাটাতে পারে না। তাই অগত্যা মাঝে মাঝে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যেকদিন পাখিদের স্বভাব-চরিত্র স্টাডি করে। ওটাই ওর কাছে এখন বড় কাজ। জানলার বাইরের পাখিটা 'পিকেটু-লকেটু' এই ধরণের ডাকছে। ওরাও সঙ্গী বা সঙ্গিনীদের খোঁজে থাকে। আর সে তো মানুষ, তার সঙ্গীকে ডাকলেও সাড়া পাওয়া যায় না। মানুষ তো একসঙ্গে দু’জনকে চাইতে পারে, সেটাই তো স্বাভাবিক। দেহগত কামনা বা যৌনতার প্রথম উদ্ভবই হয় মনে। তারপর তা দেহে সঞ্চারিত হয়। যৌন সংসর্গের সিংহভাগই মানসিক, ক্ষুদ্র অংশ হল দৈহিক। শতকরা আশি এবং শতকরা কুড়ি ভাগ। মন যখন বিকল বা বিক্ষিপ্ত তখন যৌনতার উদ্ভব হয় না। আপাতত তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া গেল যে, আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা প্লেটোনিক। কিন্তু...

 

ক্রমশ

2 comments:

  1. চমৎকার ঝরঝরে শব্দের বিন্যাস। মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেছে! 💖

    ReplyDelete

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)