বাবা
বৃষ্টির তরঙ্গে একটা কাগজের নৌকো রাস্তায় হেলে দুলে একবার এদিক একবার ওদিক দোল খেয়ে যাচ্ছে। মনের খেয়ালে কে যেন কখন রাস্তার জলে একটা কাগজের নৌকো ছেড়ে গেছে। মাঝি নেই, দাঁড় নেই, পাল নেই, মাস্তুল নেই। এ যেন নিরুদ্দেশের যাত্রা। জানি না কার কাছে চলেছে।
৩০ বছর আগেও এমনই একটা নৌকা ভেসে চলেছিল, যার দাঁড় নেই, মাস্তুল নেই, কান্ডারি নেই। সেও ছিল এক নিরুদ্দেশের যাত্রা। একটা কচি আঙুল যখন আমার আঙুল ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, সেই উদ্দেশ্যহীন কাগজের নৌকার কান্ডারি হতে। আমি আঙুল ছাড়িয়ে দিয়েছিলাম। তখন বৃষ্টির জল চাইনি। চেয়েছিলাম রঙিন জল। কাগজের নৌকা চাইনি, চেয়েছিলাম রক্তমাংসের নৌকো। যার ছইয়ের ভিতর বসে পাড়ি দেবো আলমগীরের প্রাসাদ। তাই সবকিছুকে তছনছ করে পেছনে ফেলে দুমড়ে মুচড়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম সেই ছোট্ট আঙুলের ছোট্ট কাগজের নৌকা। তারপর অনন্ত পথ চলা। সে চলায় দরকার পড়েনি কোন কাগজের নৌকোর। শুষ্ক পাথরে জমিতে হেঁটে গেছি জলাশয়ের খোঁজে।
আর যে জলাশয় আমাকে হাতছানি দিয়ে গেছে প্রতিনিয়ত, তাকে উপেক্ষা করেছি বার বার। ভেবেছি এখানে শান্তি কোথায় সুখ কোথায়। অথচ সেই কচি আঙুল, আমার হাত ধরে আমার সাথে হেঁটে গেছে রুক্ষ পাথুরে জমিতে। ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে বিস্তর। আমি অনুভব করতে পারিনি তার স্পর্শটুকু, আমি অনুভব করতে পারিনি তার নরম ভালবাসার ছোঁয়া।
এই ব্যালকনির প্রতিটি খাঁজে ঘরের প্রতিটা কোণে আলমারির প্রতিটা তাকে কান্ডারি বিহীন কাগজে নৌকাগুলো আজও আছে। সংসারে যাবতীয় যত জড় বস্তু সব জায়গায় লেগে আছে সে নরম আঙুলের ছোঁয়া।
আমি সর্বত্র বলগা হরিণ দেখতে পাই যে। নদী দেখলেই রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে উঠি। চন্দন সুবাস পেলে চন্দন গাছ হয়ে উঠি। আমার সেই চন্দন শরীর ঘিরে থাকত বিষাক্ত সাপ। সাহস পায়নি কেউ সেই নীল শরীর ছুঁতে। সবাই সরে গেছে একে একে। আমি এখন ক্ষতবিক্ষত পরাজিত একনায়কতন্ত্র ইতিহাস। পৃষ্ঠাগুলো বিবর্ণ হতে হতে আজ খয়াটে।
আকণ্ঠ মদে বেহুঁশ শরীরটার উপর বাবা বলে ডেকে গেছে বহুবার, ছুঁয়ে গেছে পেলব আঙুলগুলো। বুকে মাথা রেখে কেঁদে গেছে আজন্মকালের ভালবাসার মানুষ, কানে পৌঁছায়নি তার ডাক। সে ডাক সে আহ্বান সব প্রতিশ্রুতি প্রতিধ্বনিত হতে হতে মিলিয়ে গেছে না জানি কোন দিগন্তে।
এমনি বর্ষার দিনে সময় কাটিয়েছি কন্ঠলগ্না কত প্রেয়সীর। দুটো চাতক প্রাণ সারাক্ষণ খুঁজে গেছে এক কান্ডারিকে। সে তো বলগাহীন হরিণ তাকে ধরা কি সহজ? ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত সেই খয়াটে বিবর্ণ পাতা, আজ মানচিত্র খুলেছে ফেলে আসা দুঃস্বপ্নগুলো। এখন আমি চাই কেউ বাবা বলে ডাকুক, কেউ বলুক - আমায় মেলায় নিয়ে যাবে? অথবা আজ তুমি নিজে চলো না বাবা স্কুলে!
বৃষ্টির ছাঁট ব্যালকনি ছাড়িয়ে ভেতরে তখন ঝাপটা মারছে। আমার শরীর আমার চোখের পাতা আমার ভিতরের জল তখন সমস্ত একাকার। ব্যালকনি থেকে হাত দিয়ে ঘষে ঘষে ময়লা তোলার চেষ্টা করলাম পরিষ্কার হলো না কিছুই। নিজের হাতটাই নোংরা হল। কিছু স্মৃতি কিছু জল কাছে বসে থাকা কিছু অচেনা পাখি প্রায় ডুবন্ত রিক্সার হর্ন জলে দাপাদাপি করা কিছু বাচ্চা সবাইকে পরিচয় দিয়ে এলাম। আমি একজন বাবা।
আজ বাবা ডাকটা বড্ড শুনতে ইচ্ছা করছে। যে ডাক আমায় ছেড়ে, কাগজের নৌকা ছেড়ে, সপ্তডিঙায় ভেসে পাড়ি দিয়েছে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে। সেখান থেকে মাঝে মাঝে ডাক ভেসে আসে। একটা সেল ফোন কিছু টুকরো ছবি কিছু ডাক সন্ধান দেয় একটা কাগজের নৌকোর। আর বাবা ডাকটা আমার কাছে অজপা হয়ে যায়।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment