প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দহন | মানুষকে মানুষের মূল্য দিন

বাতায়ন/দহন / কবিতা / ৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ ,   ১৪৩২ দহন   | সম্পাদকীয় "এর মধ্যেই আছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সে-কোন সন্ত্রাসবাদীই হ...

Thursday, July 4, 2024

চক্ষুদান | রাখি সরদার

বাতায়ন/সাপ্তাহিক/ধারাবাহিক/২য় বর্ষ/৮ম সংখ্যা/৪ঠা শ্রাবণ, ১৪৩১

ধারাবাহিক গল্প

রাখি সরদার

চক্ষুদান
[৩য় পর্ব]

“তুমি কীভাবে ভেবে নিলে যে তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব! আমি যে তোমার রং, তুলি। আর শ্বশুর বাড়ি ফিরব না। বাবাকে কালই বলে দিয়েছি। আমার পক্ষে একজনের মিথ্যে ঘর করা অসম্ভব।’’


পূর্বানুবৃত্তি কমল কাজ করতে পারছে না দেখে হীরু কমলকে এখন মন দিয়ে কাজ করতে বোলে বলে বিকেলে বিড়ি নয় পুরো সিগারেট খাওয়াবে গঙ্গার ধারে। দুপুর ঢলে অভিমানের মতো বিকেল নামছে। নিজের মধ্যে ছটফট করছে। কেন সে আজ রং, তুলি ধরতে পারল না। শুধু গণেশ নয়, কার্তিক বাহন ময়ূরের চোখও আঁকতে গিয়েছিল। ময়ূরটি যেন তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে তার আঙুলে আঁচড়ে দিয়েছে! নিজের বাম হাতের আঙুলগুলো ভাল করে দেখতে থাকে। মায়ের ডাকে চমকে উঠে খাবারের আয়োজন দেখে কমল বিস্মিত হয়। তারপর…
কমলেশ ও হীরু তাদের কুমোরটুলি পাড়ার বস্তি ছাড়িয়ে তাদের প্রিয় জায়গায় পৌঁছায়। গঙ্গার এদিকের ভাঙা মন্দিরঘাটে কেউ তেমন আসে না। একেবারে নির্জন। অদূরে বহু পুরানো একটা ল্যাম্পপোষ্টে সন্ধের আগেই কে আলো জ্বেলে দিয়েছে। নদীর উপর শান্ত নিঝুম আকাশ নেমে এসেছে। কয়েকটা নৌকা ভাসছে। হীরু কমলেশের দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে ধরে,
“এক টান দাও কমলদা। দেখবে মনটা কী ফুরফুরে হয়ে যাচ্ছে।’’
দুজনে চুপ করে সিগারেট টানতে থাকে। গোলাকার সূর্য থেকে লালচে শিমুল রং গলে গলে ডুবে যাচ্ছে নদীর জলে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কমলেশ আনমনা স্বরে বলে,
“কাল সব ঠিকঠাক পারব তো। ভয় করছে রে হীরু।’’
“দূর ভয় কীসের! তুমি শিল্পী মানুষ, ব্যবসায়ী নয়। তোমাকে পারতেই হবে। সুরথদা সুযোগ খুঁজছে, তোমাকে
সরাতে পারলেই তোমার জায়গায় ওর শালির ছেলেকে আনবে। সে ব্যাটা বৈষ্ণবঘাটার পীযূষ পালের স্টুডিয়োতে
কী গণ্ডগোল করেছে। কাজ চলে গিয়েছে। তোমার কাজ চলে গেলে কে নেবে? মিলনদা তোমার বাবার কারণেই…’
কমলেশ মাঝপথে হীরুকে থামিয়ে দেয়,
“চুপ কর, বাবার নখের যোগ্যতা আমার নেই। থাকলে বাবার এত সাধের ‘জগতমাতা শিল্পালয়’ অন্যের হাতে চলে যেত না। কী আছে আমার? না আছে অর্থ, না আছে ক্ষমতা। এমনকি ভগবান হাতটাও না দিয়ে খোঁড়া করে পাঠিয়েছেন।’’
“বাড়ি চলো কমলদা।’’
“ওটিই তো আমার একমাত্র যাওয়ার জায়গা রে। আচ্ছা বাবার দেওয়া নামটা পর্যন্ত রাখল না! কুমোরটুলিতে
বাবার শিল্প কর্মের কথা সবাই ভুলে গেল!’’
“এই কারসাজিটাও সুরথদার।’’
“শুনেছি পুরাকালে রাজা সুরথ মা দুর্গার পুজো করেছিলেন। আর আমাদের সুরথদা তো সব কিছু ভাঙতে ওস্তাদ।’’
“ও মানুষ নয় দাদা, অসুর। চলো, বাড়ি চলো। ভাল করে রাতে ঘুমাও। কাল ভোর ভোর পৌঁছে যেও।’’
ভোর থেকেই রেডিয়োতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বিখ্যাত মহালয়া চলছে। টিভির বিভিন্ন চ্যানেলেও মহালয়া চলছে। কমলেশ স্নান সেরে মিলন হালদারের ‘বিশ্বকর্মা শিল্পালয়ে’র দিকে রওনা দেয়। সবাই এসে গিয়েছে। পিতৃপক্ষ শেষ হলেই দেবীর চক্ষুদান হবে। পিতৃপক্ষ পেরিয়ে যেতে মিলন সবাই তাদের স্টুডিয়োর সব থেকে উঁচু প্রতিমার পদতলে জড়ো হয়। একটা উঁচু টুলে উঠেছে কমলেশ। নীচে সবাই দাঁড়িয়ে। মিলন হালদার নিজে শাঁখ বাজাচ্ছে। কমলেশ জগতজননীকে প্রণাম জানিয়ে মায়ের চোখে তুলির টান দিতে যায়। কিন্তু সে কিছুতেই মাকে স্পর্শ করতে পারে না! এক মহাশক্তি যেন তার হাত চেপে ধরে আছে। হাতটা থরথর করে কাঁপতে থাকে। দুচোখ অন্ধকার হয়ে আসে। কমলেশ মাথা ঘুরে উঁচু টুল থেকে নীচে পড়ে যায়। জ্ঞান হারাতে হারাতে তার কানে যায়,
“বলেছিলাম মিলন, ওর আর কিছু হবে না। বুড়িকে না পেয়ে…”
দীনু পাল চিৎকার করে ওঠে,
“তুই থামবি সুরথ। ছেলেটার কী হল আগে দ্যাখ।’’
আজ মহাসপ্তমী। সকাল থেকেই ঢাকের শব্দ। মাইকে সপ্তমীর মন্ত্রপাঠ শোনা যাচ্ছে। কমলেশকে মা আশালতা ধরে ধরে এনে দাওয়ায় বসায়। মহালয়ার দিন সেই যে জ্ঞান হারিয়ে ছিল, তারপর টানা পাঁচদিন জ্বরের ঘোরে। মিলন হালদার অনেক করেছে। গাড়ির ব্যবস্থা করে পিজি হসপিটালে ভর্তি করিয়েছে। অনেক পরীক্ষা হয়েছে। হসপিটালেই ছিল সেই থেকে। ষষ্ঠীর বিকেলে বাড়ি ফিরেছে। সন্ধেয় মিলন হালদার ও হীরু এসেছিল রিপোর্ট নিয়ে। আশালতা রিপোর্টের কথা শুনে ডুকরে কেঁদে ওঠে। মিলন শান্ত কণ্ঠে আশালতাকে জানায়,
“মাসিমা ডাক্তার বলেছে কিছুদিন ওষুধ খেতে হবে, একদম ওষুধ বন্ধ করা যাবে না। আর কোনো কারণে উত্তেজিত না হয়। চিন্তা কোর না। আমরা তো আছি।’’
মাঝে মাঝেই এখন কমলেশের মাথাটা অসহ্য যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। শরীর ক্লান্ত। দুপুর থেকে বিজয়ার গান বাজছে। প্যান্ডেল খোলার শব্দ। বড় বড় লরিতে এই দুপুর থেকেই প্রতিমা ও লোকজন চলেছে গঙ্গার ঘাটের দিকে। থেকে থেকে ধ্বনি উঠছে ‘দুর্গা মাঈ কী জয়, আসছে বছর আবার এসো।’ কমলেশ অস্থির হয়ে ওঠে। একবার ঘর, একবার বাইরে পায়চারি করতে থাকে। আশালতা ছেলেকে চোখের আড়াল হতে দেয় না। কমলেশ বিরক্তির স্বরে বলে,
“মা, আমি কি বাচ্চা ছেলে যে আমার পিছু পিছু ঘুরছ? শরীর খারাপ হয়েছে, ওষুধ খাচ্ছি, সেরে যাবে।
এমন করলে যেদিক ইচ্ছে হয় চলে যাব।’’
“অমন করে বলিস না খোকা। ঠিক আছে তোর যেমন করে থাকতে ভাল লাগে থাক।’’
সন্ধের পর যত রাত বাড়তে থাকে প্রতিমা নিরঞ্জনের নামে হৈ হল্লা বাড়তে থাকে। কমলেশের ঘুম আসে না।
মাথাটা আবার যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। দরজা খুলে মায়ের ঘরে যায়। মাকে ডাকতে গিয়ে দ্যাখে তার মা অঘোরে
ঘুমোচ্ছে। মায়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বড় কষ্ট হয়। সকালে মাকে ওভাবে তার কথা বলা উচিৎ হয়নি। নিজের ঘরে এসে বিছানায় শোয়। ঘুম আসে না। পুবের জানালা গলে ভেসে আসছে কচি চাঁদের জ্যোৎস্না।
সেই জ্যোৎস্নার মৃদু ঘোর তার যন্ত্রণা যেন একটু একটু করে শুষে নিচ্ছে। তার নাকে ঝাপটা মারছে দেবীর
আরতির ধোঁয়া। বিজয়ার বিষণ্ণ সুর বাজছে। কমলেশ সেই সুরের টানে এগিয়ে যাচ্ছে গঙ্গার পাড় ধরে। সামনে কার নূপুর ধ্বনি! নরম কুয়াশায় সে নারী অনেকটাই অস্পষ্ট। নদীর বুকে অজস্র তারার আলপনা। তার মধ্যে ফুল, বেলপাতা, প্লাস্টিকের মালা ভেসে। কমলেশের এসব কোনোদিকে চোখ নেই। সে অদ্ভুত এক বিষণ্ণ সুরের মূর্ছনা ধরে পৌঁছে যায় তার অতি চেনা সেই ভাঙা মন্দির ঘাটে। সুরটি হাওয়ায় মিশে যায়! সেও থমকে দাঁড়ায় এক অভূতপূর্ব দৃশ্যে! এই ঘাটে তো কোনোদিন প্রতিমা নিরঞ্জন হয় না! এ তবে কী দেখছে সে! ঘাটের কোল ঘেঁষে মায়ের এক মূর্তি পড়ে! মূর্তিটির মুখ এতই আশ্চর্য সুন্দর, যেন এক সমগ্র জগত ধরা! দশ হাতের দু’একটি হাত ও মুখ বাদে সবটাই গঙ্গার জলে নিমজ্জিত। একবার করে ঢেউ আসছে আর মায়ের চোখ, মুখ অঞ্জলিভরা জলে মা গঙ্গা ধুয়ে দিচ্ছেন। কমলেশ স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে এমন অভাবনীয় দৃশ্য দেখতে থাকে! এভাবে বারবার ঢেউ এসে যখন মায়ের ত্রিনয়ন সম্পূর্ণ ধুয়ে দিয়েছে কমলেশ উন্মত্ত হয়ে ওঠে। মূর্তিটির মাটিগলা মুখটা বাঁহাতের করতলে তুলে ধরতে ধরতে বলে ওঠে,
“মাগো, দুঃখ করিস কেন! তোকে অন্ধ হয়ে থাকতে দেব না। যতই বাধা আসুক, আমার রং তুলির ছোঁওয়ায়
তুই আবার এই জগত নয়ন ভোরে দেখবি।’’
কথা শেষ হয়েছে কী সেই মুহূর্তে প্রকাণ্ড একটা ঢেউ জগতজননীর মাটিগলা কাঠামো ও কমলেশকে নিয়ে অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। কমলেশ সুরধুনীর কোলে ডুবতে ডুবতে চেঁচিয়ে ওঠে,
“মা… মা…”
কী হয়েছে খোকা! এই তো আমি তোর বিছানার পাশেই যে বসে। সারারাত জ্বরের ঘোরে ছিলি যে। মা আশালতার কণ্ঠস্বরে কমলেশ বিছানায় ধড়ফড় করে উঠে বসে। সেই মুহূর্তে দরজার বাইরে থেকে বুড়ির গলার শব্দ,
“জেঠিমা… কোথায় গো? বিজয়ার প্রণাম করতে এলাম যে।’’
বুড়ির পায়ের মিঠে নূপুর ধ্বনি এগিয়ে আসছে। বুড়ি ঘরে প্রবেশ করে। ফুটফুটে কমলারং শাড়িতে যেন সাক্ষাৎ মা দুর্গা এসেছে। কমলেশ শিউলির সুঘ্রাণ পাচ্ছে। বুড়ি কমলেশের দিকে উত্তাপভরা চাউনি ছুঁড়ে আশালতাকে প্রণাম করে। তারপর আহ্লাদী কণ্ঠে বলে,
“জেঠিমা, মেয়ে বাড়িতে এল কই চা খাওয়াবে না!’’
“বোস, এখুনি আনছি।’’
আশালতা বেরিয়ে যেতেই বুড়ি কমলেশের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,
“তুমি কীভাবে ভেবে নিলে যে তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব! আমি যে তোমার রং, তুলি। আর শ্বশুর বাড়ি ফিরব না। বাবাকে কালই বলে দিয়েছি। আমার পক্ষে একজনের মিথ্যে ঘর করা অসম্ভব।’’
কমলেশ বুড়ির মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সুদূর ওই নীলের স্রোত থেকে সোনালি রোদ মিলেমিশে একাকার হয়ে জানালার কোলে লুটিয়ে পড়ছে। তার ঈষৎ আভা বুড়ির ডান নয়ন ছুঁয়ে। সেদিকপানে তাকিয়ে কমলেশের বুকে অদ্ভুত আলোড়ন! চোখের কোণে দুফোঁটা অশ্রুর উদ্ভাস।
 

সমাপ্ত

 

No comments:

Post a Comment

জাল— মাছ কাটতে না জানলেও কিছু মানুষ জানে


Popular Top 10 (Last 7 days)