প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দহন | মানুষকে মানুষের মূল্য দিন

বাতায়ন/দহন / কবিতা / ৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ ,   ১৪৩২ দহন   | সম্পাদকীয় "এর মধ্যেই আছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সে-কোন সন্ত্রাসবাদীই হ...

Saturday, May 17, 2025

নাহ্! | সাহানা

বাতায়ন/দহন/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
দহন | ছোটগল্প
সাহানা
 
নাহ্!

"দরজায় কিছুই নেই! আবার আয়না দ্যাখে। হ্যাঁওই তো... এবারে পেছনে ফেরে বোঝে আসলে উল্টো নয়বিপ্রতীপ কোণে একটা ছোট্ট খাঁজ থেকে ঝুলে আছে কিছু একটা! এমনিতে অদৃশ্য!"


টেবলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ল আয়ান! সামনেই বিরাট কাচে ঢাকা স্পেস, বারান্দা বলা চলে, আবার নয়! উল্টোদিকে একটা বিশাল গ্যালারি! ভার্সিটির সব কনভোকেশন এখানেই হয়! এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জুড়ে বিশাল কাচের টেবল। কাচটা একেবারেই স্বচ্ছ নয়, ভারি অদ্ভুত! খাঁজকাটা একটা টেক্সচার, অথচ দূর থেকে দেখলে কাচ বলে ভ্রম হতে পারে! আসলে এটা একটা অদ্ভুত রাসায়নিক মিশ্রণে তৈরি বিদঘুটে মেটেরিয়াল! আজ পর্যন্ত এর কম্পোজিশনটা কেউ জানেই না!

 
এইটা তৈরি করেছিল আয়ানের ঠাকুর্দা! এই ভার্সিটির বিশেষ কর্তৃপক্ষের মাথা ছিলেন, যিনি! বিরাট মাপের রসায়নবিদ। শুধু রসায়ন নয়, পদার্থবিজ্ঞানের আনাচেকানাচে অবাধ বিচরণ ছিল তাঁর! এককথায় একজন প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানী!
 
ছোটবেলায় অনেক সময় আয়ান মাথা গলিয়ে দিত দাদুর ল্যাবরেটরিতে। নানারকম গন্ধ, বিভিন্ন রাসায়নিক কোনোটা জ্বলছে, কোনোটা ভুসভুসিয়ে উঠছে! মাঝাখানে প্রফেসর সেন হাই-পাওয়ার লেন্স লাগিয়ে লেখালিখিতে মত্ত! গবেষণা চলছে সবসময়ই!
 
আয়ানের মনে আছে, দাদুর তৈরি দুটি বিশেষ রাসায়নিক পেটেন্ট পেয়েছিল, সম্মানিত হয়েছিলেন তিনি! পরবর্তীতে ওই রিসার্চ ল্যাবের সত্ত্ব বর্তায় তার বাবা এবং এখন তার ওপরে। কিন্তু, দাদুর মতো বিজ্ঞানে উৎসাহী নয় তারা কেউই। ফলে, সবটাই কোনো তৃতীয় ব্যক্তিকে হস্তান্তর করতে হবে, এমনটাই শর্ত! ল্যাবটি কিনে নিতে রাজি অনেকেই!
 
দাদুর হাত ধরে অনেকবার সে এসেছে, ছোট্ট থেকেই, এই ল্যাবে। নানা অবান্তর কৌতূহলী প্রশ্ন...
-ওটা কী দাদু? ফুটে উঠেছে? ওই ধোঁয়া কীসের? এই প্ল্যান্টটার ফাংশান কী? ইত্যাদি ইত্যাদি!
দাদু সহাস্যে বোঝাতেন। কেমন একটা আকর্ষণ ছিল ল্যাবটার। ঠিক ভাষায় বোঝানো যাবে না! বড় হয়ে যখনই ল্যাবে উঁকি মেরেছে, দেখেছে শুভ্র দাড়ি নেড়ে একমনে কীসব মিশ্রণ তৈরি করছেন বৃদ্ধ! ওপাশে কাচের নানান পাত্রে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টের জিনিস... লতাপাতা, গুল্ম, কিছু প্রাণীদেহ আরকে ভেজানো। লাল-নীল নানা রাসায়নিক! অদ্ভুত একটা জংলি গন্ধ!
 
আয়ান বর্তমানে ম্যানেজমেন্টের কৃতী ছাত্র। বাবার মতোই বিরাট সাম্মানিক নিয়ে সে এগিয়ে চলেছে জোরকদমে! ব্যবসায়ী মানসিকতায় গড়ে উঠেছে সেন অ্যান্ড কোং! মাত্র দুই জেনারেশনেই রমরমিয়ে চলছে! তাদের প্রধান প্রোডাক্ট একটি প্রাণদায়ী ভ্যাকসিন! রাসায়নিক ফর্মুলা থেকে ওষুধে পরিণত করার সব কাজ দাদু শেষ করে যেতে পারেননি।
 
বাকিটা করেছিলো বাবা এবং ছেলে। তাঁদের মিলিত প্রচেষ্টাতে আজ এই কোম্পানি উন্নতির শিখরে! এ বছর অ্যানুয়াল কর্পোরেট মিটিং-এ বাবা ঘোষণা করেছিলেন বেশ কিছু প্রজেক্ট! তিনি ম্যানেজিং ডিরেক্টর। এক ফাঁকে বাবাকে ধরে আয়ান ফিশফিশ করে... "ড্যাড! ল্যাবের কথাটা বোলো না মিটিং-এ!" বাবা গম্ভীর! তাঁর ইচ্ছে ছিল, এবারেই ব্যাপারটা ওপেন ফোরামে ফ্ল্যাশ করার!
 
পরীক্ষামূলক সব কাজটাই হয় দেশের বাইরে। অতএব, ল্যাবের খুব একটা প্রয়োজনীয়তা এখন নেই। শুধু একটাই সমস্যা! দাদু বেশিরভাগ তথ্যই লিখে রাখতেন নোটবুকে। অথচ ফর্মুলার সেই গোপন খাতা বা তথ্য ল্যাবের কোথাও খুঁজে পায়নি আয়ান! তন্নতন্ন করে খুঁজেছে ইঞ্চি, ইঞ্চি! আবার মাথা নাড়ল আপনমনেই! দিন এগিয়ে আসছে। তার বাবা একদম বদ্ধপরিকর... ল্যাবটা তিনি বেচবেন! ব্যবসায়ী বুদ্ধি দিয়ে আয়ানও বুঝেছে। কিন্তু... নিজের হৃদয়ে যে অহরহ অন্তর্দহন... কীভাবে রুখবে!
 
ছোটবেলার নস্টালজিয়া কাটিয়ে ওঠা খুব কঠিন! আয়ান এ ব্যাপারটা একদম পারে না! খালি মনে হয়, দাদুর অক্লান্ত পরিশ্রম, সে তো এক শিল্পীর রাত জেগে ছবি আঁকার মতোই! বিশ্বের দরবারে তার অসীম মূল্য! তাঁর সেইসব কাজের নথিপত্র, যা অনেকটাই পাওয়া গিয়েছে, আইনসম্মতভাবে! কিন্তু, যেটুকু হয়নি? খালি মনে হয়, কিছু তথ্য, অন্য কেউ পেলেই...
 
ল্যাবের দরজাটা খুলতেই পুরনো একটা গন্ধ! যদিও দীর্ঘদিন বন্ধ! চারপাশে অপরিচ্ছন্ন ভাব! কেমন একটা কষ্ট পাক খায় বুকে! আয়ান মাথা নিচু করে সব টেবল, চেয়ার, সেলফ্ চেক করে! রুমটা, ভার্সিটির লম্বা গ্যালারিটার ঠিক নীচেই। ফলে, বাঁদিকে কিছুটা অংশ বেঁকে ঢুকে গিয়েছে একটা সুড়ঙ্গের মতো। ওখানে একটা আয়না আছে!
আয়ান সোজা হয়ে দাঁড়ায়! ওখানে আয়নাটা কেন? আগে তো মনে হয়নি! চট করে ওটা খুলে বাইরে আনে। আয়নার কাচটা অদ্ভুত! নিজের ছায়া ছাড়াও ঘরের একটা ত্রিমাত্রিক দৃশ্য চোখে পড়ে। লেন্সের কারসাজিতে উল্টো দিক শুধু নয়, ওপাশে দরজার কোণ পর্যন্ত পরিষ্কার! হঠাৎ... দরজার ওপাশে একটা ঝুলে থাকা বিবর্ণ... ওটা কী?
আয়নাটা রেখে পেছনে ফেরে! দরজায় কিছুই নেই! আবার আয়না দ্যাখে। হ্যাঁ, ওই তো... এবারে পেছনে ফেরে বোঝে আসলে উল্টো নয়, বিপ্রতীপ কোণে একটা ছোট্ট খাঁজ থেকে ঝুলে আছে কিছু একটা! এমনিতে অদৃশ্য! কাচের কারসাজি! কাচ তো নয়, যেন আস্ত লেন্স! ধীরে ধীরে সমকোণে পিছিয়ে চার পা আগে হেঁটে কোণাকুণি এগিয়ে হাত চালায় দেওয়ালে। ছোট্ট খাঁজ একটা! টানতেই... ধূসর ছোট্ট খাতাটা পকেটে পুরে এদিক-ওদিক তাকায়!
 
বিকেলের ঢলে পড়া সূর্যটার দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে খাতাটা বের করে অগ্নিসংযোগ করে আয়ান! দাদুর অনাবিষ্কৃত এবং বহুল প্রচারিত সবকিছুই তার হৃদয়ে লিপিবদ্ধ! অনেক ব্যবসা, অনেক লোভ! এইটুকু আর নাই বা জানল কেউ! অন্তরের দহন এইভাবেই দ্রবীভূত হোক লোকচক্ষুর আড়ালে! মানুষের আকাশছোঁয়া আকাঙ্ক্ষা থেকে মহাবিজ্ঞানী এবং আবিষ্কারকের সম্মানটুকু নাহয় সেই রাখুক পৃথক করে!
 
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

জাল— মাছ কাটতে না জানলেও কিছু মানুষ জানে


Popular Top 10 (Last 7 days)