ধারাবাহিক উপন্যাস
পারমিতা
চ্যাটার্জি
শেষ
থেকে শুরু
[পর্ব— ২৬]
"-যদি থাকার হয় আবার দেখা হবে, তা না হলে পথের দেখা পথেই শেষ হওয়া ভালো, তবে তোমাকে আমার মনে থাকবে। -আমারও তোমাকে মনে থাকবে। সজল হেঁটে চলে যাচ্ছে রাহুলদের দিকে, পিছন ফিরে দেখল মেয়েটি একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে আছে, সজল তার দিকে চেয়ে হাত নাড়ল, তারপর আবার এগিয়ে গেল।"
পূর্বানুবৃত্তি পরেরদিন রাহুল
সুচরিতাকে নিয়ে ঘুমচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ওদের দরজায় ধাক্কা দিয়ে
বলল, রাহুল ওঠ এবার, পরে প্রেম করিস এখন ওঠ। এদিকে প্রবীর ক্রমশ চিন্তিত হয়ে পড়ছে, ওর মনে হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মনকলিকে
নিয়ে বিদেশে চলে যেতে পারে,
ওর কাছে এক-এক ঘন্টা মনে হচ্ছে অনেক। কাল ওরা ফিরলে
ওদের বলেই চলে যেতে হবে, আর দেরি করা ঠিক হবে না। তারপর…
ওরা গাড়ি থেকে নেমে প্রাণভরে নিশ্বাস নিল। অনেকক্ষণ ধরে যেন এক মনখারাপের দমবন্ধ পরিবেশে যাত্রা করে এল। সবার মুখের কথা ও হাসি দুই যেন অসুখ নামে কোন এক ডাকাত চুরি করে গেছে। যতই হোক অনেক দিনের বন্ধু মনকলি। এতদিন অসুখটা একরকম ছিল এবার যেন মনে হচ্ছে বেশ ভালোভাবেই বেড়ে উঠেছে। প্রবীর কলকাতায় ডাক্তারের সাথে কথা বলে জেনেছে এবার রেডিয়েশন দিতে হবে, তাও একরকম ঠিক আছে। কারণ কেমো দিলে চুল সব উঠে যায় তখন মানসিকভাবে মনকলি আরও ভেঙে পরে। বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাও ওর চলে যায়।
যাইহোক
বড়ন্তির অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চতুর্দিকে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা বড়ন্তির
জলাধার চোখে-মনে যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিল।
ক্ষণিকের জন্য একটা সুন্দর অনুভুতির সংগীত মনের বীণার তারে
তারে বেজে উঠল।
সজল বলে উঠল,
-রোমান্টিক সৌন্দর্য একেবারে, এসব জায়গায় বেড়াতে এসে লিসার জন্য
খুব মনখারাপ করছে। লিসা ইণ্ডিয়ায় আসেনি কখনও এই সৌন্দর্যে লিসা মুগ্ধ হয়ে যেত।
এই
অবস্থানটি সাধারণ মানুষের কাছে অজানা তাই এখানে ভিড় অনেক কম। বড়ন্তি নিজস্ব মহিমায় সংরক্ষিত। যে কোন বিচরণ প্রিয় মানুষের জন্য একটি কাঙ্ক্ষিত
গন্তব্য। ভ্রমণকারীরা স্বল্প ভিড়ে ও অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এই
জলাধারের ও প্রকৃতির স্বাদগ্রহণ করতে চলে আসে।
-উফফ জাস্ট ফাটাফাটি জায়গা রে রাহুল, যত দেখছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি।
রাহুল বলল,
-ভাবছি— অবশ্যই সুচির যদি মত থাকে।
-আমার আবার কীসের মত?
-এখন সব বিষয়ে দুজনের মত লাগবে ম্যাডাম, বিয়ে করেছি
যে, মানে
পায়ে শেকল পড়েছি।
-কী বললে আমি শেকল!
সুচরিতা
তেড়ে আসতে লাগল, সজলের
পেছনে রাহুল দাঁড়িয়ে পরে বলল,
-বাঁচা বন্ধু
বাঁচা, বিয়ে
করে বন্ধ হয়েছি যে খাঁচায়।
সুচরিতা বলল,
-যা বলার বলো না,
আমার তো মনে হয় না বিয়ের পরে আমি এমন কিছু নিজের মত ফলিয়েছি যে, কারুর শেকল
পায়ে পড়ার অনুভূতি হবে।
রাহুল এবার
সজলের পিছন থেকে বেরিয়ে এসে রাগত সুচরিতার পিছন দিক থেকে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
-আরে রাগ করছ
কেন? নতুন
বউকে রাগিয়ে তারপর আদর করে মান ভাঙাতে খুব ভালো লাগে তাই।
সুচরিতা তার
টোল-খাওয়া গালে কাজলকালো চোখদুটো বড় বড় করে
বলল,
-তা—ই না?
রাহুল পিছন
থেকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
-হ্যাঁ তাই, তুমি বড্ড
সুন্দর, তোর
টোলখাওয়া গাল কাজলকালো হরিণ চোখের অমলিন দৃষ্টি আমায় পাগল করে দেয়।
-এবার তো বলো?
-বলছিলাম তোমার মত থাকলে এখানে একটা ছোট্ট বাড়ি করতাম।
সুচরিতা
একমুখ হেসে বলল,
-নানাধরণের
রংবেরঙের ফুলগাছ লাগাতাম,
নানারকম ফল সবজিও লাগাতাম, কী মজা হত বলো?
-হ্যাঁ তা সব হত কিন্তু একটা জিনিসের অসুবিধা হত, তিনঘন্টা
যাতায়াত করে কলেজ করব কী করে? আর আমাদের ছোট্ট অতিথি এলে তাকে
স্কুলে যাতায়াতের কী ব্যবস্থা করতাম?
-এখনি তো আর বাড়ি করছি না যখন আমরা কাজ থেকে অবসর নেব তখনকার জন্য করে
রাখলাম। এখন মাঝে মাঝে ছুটে কাটিয়ে যেতাম।
-ঠিক আছে কোন চিন্তা নেই। আমার সুচি যা বলবে তাই হবে, এই সজল
কোথায় গেল?
-বোধহয় আমাদের প্রেম করতে দেখে ও অন্য কোথাও যাত্রা করেছে।
সত্যি সজলকে দেখল,
একটা পিকনিক পার্টি আর সেই পার্টিরই দুটি মেয়ে খুব সুন্দর ব্যাডমিন্টন খেলছে, সজল ওদের
সামনে দাঁড়ায়, সজলের
সুন্দর সুপুরুষ চেহারাটি বড় মেয়েটির এক দেখাতেই কেমন যেন মনে একটা ছোঁয়া লাগল, সজলকে
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বড় মেয়েটি সামনে বলল,
-হাই— আমি মৌটুসী।
-দিদিটা পারেও।
ছোট বোন
মুখচোরা মৌপিয়াদের দলের দিকে যেতে যেতে বলল,
-দিদিটা
পারেও বটে, কে
না কে! তার সাথে চলে গেল ব্যাডমিন্টন খেলতে।
মৌটুসী
নিজের পরিচয় দিতে হাত বাড়িয়ে বলল,
-আমি সজল।
-খেলবেন আমার সাথে?
-তোমার সাথে?
সরি তুমি বলে ফেললাম।
-ঠিক আছে তাতে কিছু যায়-আসে না, বোনটা খেলতে
পারে না, ওর
সাথে খেলে মজা পাই না। তাই আপনাকে দেখে ডেকে ফেললাম।
-হ্যাঁ চলুন তাহলে খেলা যাক।
-গুরুচণ্ডালী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
-গুরুচণ্ডালী সে আবার কী?
-আপনি কোথায় থাকেন বলুন তো যে গুরুচন্ডালী মানে জানেন না?
-আমি বাইরের দেশেই থাকি।
-ও আচ্ছা তাই জন্যই?
-কী তাই জন্য?
-অর্ধেক বাংলা ভুলে গেছেন।
-যেমন?
-গুরুচন্ডালী মানেটা জানেন না?
-তা আপনি বলে দিন-না?
-গুরুচণ্ডালী মানে হচ্ছে মিশিয়ে ফেলা, যেমন আপনি একবার আমাকে তুমি বলছেন
একবার আপনি বলছেন, এই
মিলিয়েমিশিয়ে ফেলাটাকে বলে গুরুচন্ডালী।
-ও আচ্ছা,
আপনি কিন্তু বেশ ভালো খেলেন।
-তাহলে আপনি বলাটাই ঠিক করলেন?
-হ্যাঁ আপনি তো বললেন গুরুচন্ডালী না করতে?
-আমি আবার
কোথায় গুরুচন্ডালী করলাম?
-আমি তুমি বলব, আর অপরপক্ষ আপনি বললে গুরুচন্ডালী হয় না?
-ওহো হ্যাঁ তাইতো, ভুলেই গিয়েছিলাম, ওকে দুজনেই দুজনকে তুমি বলব, এবার হবে তো?
-হ্যাঁ তা হবে, তবে এবার আমাকে ফিরতে হবে, আমরা আজই কলকাতায় রওনা হব।
মেয়েটির
মনটা যেন একটু দমে গেল,
সজল বলল,
-লাঞ্চ করে
বেরিয়ে যাব, ওই
যে আমার বন্ধুরা আমাকে ডাকছে।
-ঠিক আছে যান আর কী বলব!
-না আর কিছু বলার নেই।
-আপনার ফোন নাম্বার আর ঠিকানাটা দেবেন?
-কী করবেন নিয়ে?
-এই যোগাযোগটা থাকত।
-যদি থাকার হয় আবার দেখা হবে, তা না হলে পথের দেখা পথেই শেষ হওয়া ভালো, তবে তোমাকে
আমার মনে থাকবে।
-আমারও তোমাকে মনে থাকবে।
সজল হেঁটে
চলে যাচ্ছে রাহুলদের দিকে,
পিছন ফিরে দেখল মেয়েটি একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে আছে, সজল তার
দিকে চেয়ে হাত নাড়ল,
তারপর আবার এগিয়ে গেল।
দ্রুত লাঞ্চ
সেরে ওরা যখন গাড়িতে উঠল ফেরার জন্য তখন ঘড়িতে দেড়টা বাজে, হিসাব করলে
একঘন্টাও পুরো থাকা হল না। মৌটুসী মেয়েটা তার মনে গভীর দাগ কেটে দিল এই স্বল্প
সময়ে। সজল মনে মনে ভাবছে বাঙালি মেয়েদের মতন যত্ন করতে কেউ পারে না, শুধু বাঙালি
না ভারতীয় সব মেয়েরাই খুব যত্ন করতে পারে। রাহুল বলল,
-লিসাকে নিয়ে
এইখানে হানিমুনে আসিস তখন আমরা খুব আনন্দ করব।
-মনকলি বেঁচে থাকার সময়টা যেন আরও লম্বা হয় কত মানুষ তো ক্যানসার নিয়ে কত
বছর বেঁচে থাকে।
রাহুল কিছু
বলছে না, ওর
একটা অব্যক্ত কষ্ট কেমন বুকটা যেন চেপে ধরেছে। আবার ওই সুন্দর পথ দিয়ে ওরা ফিরে
চলেছে।
সুচরিতা
ঘুমে রাহুলের ঘাড়ে ঢলে পরেছে, রাহুল সযত্নে ওকে কাছে টেনে ধরে রেখেছে যাতে পড়ে না যায়,
সামনের সিটে সজলও ঢুলছে, রাহুল বলল,
-ড্রাইভারসাব
ক্যাসেট লাগা দিজিয়ে।
কারণ আশেপাশের মানুষগুলো যদি পাহাড়ি রাস্তায় ঢুলতে থাকে তবে অবশ্যম্ভাবী ড্রাইভারের চোখে ঘুমে এসে যাবে আর সেক্ষেত্রে অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার
সম্ভাবনা বেশ বেশি থাকে হঠাৎ ক্যাসেট বেজে উঠতে সজল সচেতন হয়ে উঠল, সুচরিতা
আহ্লাদী মেয়ের মতন বলে উঠল,
-ক্যাসেট
চালাল কেন?
রাহুল ওকে
বুঝিয়ে আদর করল, সুচরিতা
আরামে রাহুলের কাঁধে মাথা রেখে আধো ঘুম ঘুম চোখে আসতে লাগল। ঠিক চারটের সময় ওরা
এসে পুরুলিয়ায় নামল।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment