ধারাবাহিক গল্প
পর্ব ২
সীমা ব্যানার্জী-রায়
মিলির ইন্টারভিউ
পূর্বানুবৃত্তি: মিলির আঠারো বছর বয়স, হায়ার সেকেন্ডারি পাশ
করার পরেই বাড়ি থেকে বিয়ে দেবার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। মিলির আপত্তি ছিল, সে
কলকাতার বাইরে পা দিতে চায় না। বাড়ির আনাচকানাচে বাবা-মায়ের কাছাকাছি থাকতে চায়।
মনে যদিও ইচ্ছা ছিল অন্য বন্ধুদের মতো কলেজের অন্তত একটা ডিগ্রি হাতে পাক।
ভবানীপুরের পাত্রপক্ষ মিলিকে দেখে যাবার ক’দিন পর মিলির বাড়ি থেকে পাত্রের বাড়ি
গেল।
তখন মায়ের মুখে পাত্রের তোতলামির বিবরণ শুনে সবার সাথে মিলিও হেসে কুটিপাটি হল। কাজেই সেটা বাতিল হয়ে গেল। মা আবার চ্যাম্পিয়নের ভূমিকায়।
আবার দিন যায়, রাত আসে। দুপুরে মায়ের হাতে করকরে আনন্দবাজার পত্রিকার ‘পাত্র-পাত্রী’-তে চোখ রাখা এইসব চলছে। কারণ আজকাল আর কেউই জানাশোনা পাত্র বা পাত্রীর হদিশ দিতে চান না। দিনকাল যা পড়েছে, এই ফেসবুকের যুগে, কার জন্য যে কে ঠিক হয়ে আছে কেউ জানতে পারে না।কয়েক সপ্তাহ
বাদে এল আরেকটা ইন্টারভিউ কুচবিহার
থেকে। মিলি বলল, ‘এত দূর
দূর থেকে কেন আসছে গো মা?’ মা
শুনে হাসি মুখে মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘দেখতে আসলেই বিয়ে হয়ে যায় নাকি
রে বোকা মেয়ে? এমনিই কথায় আছে, পাঁচ
কথায় বিয়ে।’ চুপ করে যায় মিলি। মায়ের সাথে তর্ক করা যায় না মোটেই।
মনে পড়ল তার
স্বর্গীয়া ঠাম্মার কথা। মিলির চিরকালের অভ্যাস ছিল পা ছড়িয়ে বসে ভাত খাওয়া। ঠাম্মা-পিসন-দিদন কত বারণ
করেছেন। বলতেন, ‘পা
ছড়িয়ে খেতে বসলে নাকি দূরে শ্বশুরবাড়ি হয়। তখন কেঁদে ভাসালেও আর বাপের বাড়ি আসা
হবে না, বুঝতে পারবি তখন। পা ছড়িয়ে খাওয়া বার হয়ে
যাবে।’
কারোর বারণেই
মিলি তার অভ্যাস বদলায়নি। শেষে একদিন ঠাম্মা রেগে গিয়ে দিলেন পাখার বাট দিয়ে এক
ঘা। সে এক কাণ্ড। মিলি কেঁদে রসাতল। কারণ ঠাম্মাকেই সে সব সুখদুঃখের কথা বলে, আদর
করে ‘ডার্লিং
সই’ নামে ডাকে। আর সেই ঠাম্মা কিনা তাকে সবার
সামনে পাখার বাট দিয়ে মারলেন? কতখানি অপমান
তা তো ঠাম্মা ভাবলেন না। ঠাম্মার আদরে শেষে মানভঞ্জন হল মিলির।
যথা সময়েই
কুচবিহারের লোকেরা এলেন মিলিকে দেখতে। নিয়মের হেরফের নেই। মিলি ঘরে ঢুকে পাত্রের
মুখের দিকে তাকিয়েই ফিক করে হেসে ফেলেছে। হাসি কিছুতেই চাপতে পারছে না। চেষ্টা
করছে কত, কিন্তু কেন যে এত হাসছে বুঝতে পারছে না। আসলে
ছেলেটির ঠোঁটের কাছে ছিল একটা বড় লাল রঙের আঁচিল। সেটা দেখেই মিলি হেসে ফেলেছে আর
নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলে ফেলেছিল— ভগবান ছেলেটার সব সৌন্দর্যই মেরে দিয়েছেন ওই
আঁচিলটা দিয়ে।
যাই হোক, শেষ
পর্যন্ত দেনাপাওনাতে আটকালো বলে মিলিকে আর অত দূরে যেতে হল না। এই ভাবে নানান
সম্বন্ধ আসতে লাগল দূর দূর থেকে— দিল্লি, এলাহাবাদ, নাগপুর, মুম্বাই।
মিলির জোরাজুরিতে বাবা তাদের আপত্তি জানিয়ে চিঠি দিয়েই চলেছেন। মাকে প্রায়ই বলতে
শোনে আজকাল, ‘এই
মেয়ের যে কী ভাবে বিয়ে হবে জানা নেই বাবা। এ চলবে
না, ও চলবে না করে তো বেশ কয়েকজনকে দেখা হল।’ এরপর যা ঘটল, মিলিকে
সেটা তার ওপরওয়ালার ইরাদা বলে মেনে নিতে হল।
সাত-সমুদ্র
তেরো-নদীর ওপার থেকে ভেসে ভেসে এল এক মিঞা-কি-মল্লার।
মা বললেন, ‘ঘ্যানর-ঘ্যানর
করলে কী হবে? জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে তিন-বিধাতা
নিয়ে। কাজেই যা হবে মেনে নিতেই হবে। এই ভাবে দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে, শেষে
বুড়ি বয়সে বিয়ে করবি নাকি?’
সেদিন মিলি ভাত
খেয়ে কলেজে যাবার জন্য সবে প্রস্তুত হচ্ছিল, হঠাৎ ফোন বেজে
উঠল। মা কার সাথে বেশ খানিকক্ষণ কথা বললেন। ফোন রেখেই মিলির বৌদির সাথে কিছু
গুরুতর ব্যাপারে যেন পরামর্শ করলেন। তারপরেই মিলিকে ডেকে বললেন, ‘আজ আর কলেজে
যাস না মিলি!’ শুনে মিলি তো
অবাক। যে মা স্কুল-কলেজ
কামাই করা একদম পছন্দ করেন না। আর আজ তবে হল কী মায়ের? বৌদির
দিকে তাকাতেই উনি চোখ মেরে বললেন, ‘আজ তোমাকে দেখতে আসবে গো?’
মা বেশ ধমকের
সুরে বললেন, ‘পাশের
বাড়ির মিতালিদিকে বলে আয় আজ বিকেলে ওর সাথে তুই সিনেমায় যেতে পারবি না। আজ বাড়িতে
তোকে থাকতেই হবে। কথার নড়চড় যেন না হয়।’ মায়ের আদেশ মানে মিলির কাছে ফতোয়া জারি।
মিলির মুখ থমথমে হয়ে ওঠে। সারাদিনের সমস্ত প্ল্যান বানচাল হয়ে গেল। রাগের চোটে
সাপের মতন হিস হিস করতে করতে মিলি গিয়ে আছড়ে পড়ল বিছানায়।
বিকেলে বৌদির ডাকেই ঘুম ভাঙল।
সন্ধেবেলা
আত্মীয়ের সাথে অভিবাসীর নায়ক এসে উপস্থিত। মিলি আর কোন আপত্তি করেনি। জানে বেশি
আপত্তি করলে, মায়ের হাত থেকে রেহাই পাওয়া বড় ফেচাং। হয়তো
এটাই তার কপালে ছিল।
দু’পক্ষেরই
পছন্দ হল এবং মিলি বিয়ের সার্টিফিকেট পেয়ে বিদেশের পথে পা বাড়াল। প্লেনে উঠে
ঠাম্মার কথা বড্ড যেন মনে পড়তে লাগল। প্লেন তো ছুটছে মেঘ সরিয়ে। ঘষা কাচের ভিতর
দিয়ে অস্পষ্ট ছবির মতো তাদের বাড়ির পলাশ-রাঙা, হাসি-তরল দিনগুলো চকিতে তার মনের পর্দায় ভেসে
উঠে ফের মিলিয়ে যাচ্ছিল। ঠাম্মার কথা মনে এল হঠাৎ আর ফিক করে হেসে ফেলল। একটু ডাগর-ডোগরটি হবার পর
থেকেই ঠাম্মার কাছ থেকে শুনে আসছে ‘পতি পরম গুরু’।
—দিদিভাই, যতই
পড়াশুনা করো না কেন, মেয়েদের বিয়ে করে ফেললেই আর কোন চিন্তা থাকে
না। নয়তো চারিদিকের হায়েনারা খুবলে খুবলে খাবে। স্বামী
খেটেখুটে ফিরলে তার সেবাযত্ন করাও কিন্তু বউয়ের কাজ।
—বিয়ের পরেই যে
হায়েনারা খুবলে খাবে না, তার কী কোন প্রমাণ আছে? সই? মিলি
তার ঠাম্মার গাল দুটো টিপে বলেছিল তখন। ফর্সা গাল লাল হতে দেখেছিল মিলি। কিন্তু
ঠাম্মা কথা ঘুরিয়েই নাতনির কপালে একটা চুমু খেয়ে বলেছিলেন, ‘চুপ কর তো
ছুঁড়ি। আজকালকার মেয়েগুলো বড্ড এঁচোড়ে পাকা।’ ঠাম্মার কথাগুলো হাঁচোরপাঁচোর করছে
হঠাৎ। মনে মনে বলে উঠল,
‘তোমার কথাই সত্যি হল যে সই। তুমি থাকলে আজ যে কী করতে, তা
আমার ভাল ভাবেই জানা আছে।’
ক্রমশ
খুব সাবলীল ভাষায় লেখা পড়ে বেশ ভালো লাগলো। ক্রমশঃ পরের পর্ব পড়ার আগ্রহ বেড়ে চলেছে।
ReplyDelete