প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

ভিক্ষুক গাছ | তৈমুর খান

বাতায়ন/মাসিক/কবিতা/২য় বর্ষ/১৮তম সংখ্যা/২৩শে কার্ত্তিক , ১৪৩১ চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা | কবিতা তৈমুর খান ভিক্ষুক গাছ দু - একটি ভিক্...

Saturday, May 13, 2023

মিলির ইন্টারভিউ | সীমা ব্যানার্জী-রায়

বাতায়ন/ধারাবাহিক/সাপ্তাহিকী/১ম বর্ষ/৪র্থ সংখ্যা/১৩ই মে, ২০২৩


ধারাবাহিক গল্প
পর্ব ৩

সীমা ব্যানার্জী-রায়

মিলির ইন্টারভিউ

পূর্বানুবৃত্তি: পাত্র শিক্ষিত হলেও তোতলা হওয়ার কারণে মিলির বাবার মত থাকা সত্ত্বেও বাতিল হয়ে গেল। এরপর দূর দূর থেকে সম্বন্ধ আসতে থাকে। মিলির ঠাম্মার কথা মনে পড়ে। ঠাম্মা বলত পা ছড়িয়ে ভাত খেলে দূরে শ্বশুরবাড়ি হয়। ডার্লিং সই ঠাম্মা আরও বলত

, দিদিভাই, যতই পড়াশুনা করো না কেন, মেয়েদের বিয়ে করে ফেললেই আর কোন চিন্তা থাকে না। নয়তো চারিদিকের হায়েনারা খুবলে খুবলে খাবে। মিলি পাল্টা বলে, বিয়ের পরেই যে হায়েনারা খুবলে খাবে না, তার কী কোন প্রমাণ আছে? সই? মিলি তার ঠাম্মার গাল দুটো টিপে বলেছিল তখন। ফর্সা গাল লাল হতে দেখেছিল মিলি। কিন্তু ঠাম্মা কথা ঘুরিয়েই নাতনির কপালে একটা চুমু খেয়ে বলেছিলেন, ‘চুপ কর তো ছুঁড়ি। তারপর...

অভিবাসে সারাদিন সংসারের কাজ আর বাড়ি সামলাতে সামলাতে মিলি ভাবে, এই জীবনটাকে কী সে টেনে নিয়ে যেতে পারবে শেষ দিন পর্যন্ত? তাও এই বিদেশের বাড়িতে পূজা-আহ্নিক ইত্যাদি সারা হবার পর দ্বিপ্রহরেই অতি যত্নে খাবার তৈরি করেছে মিলি। তারপর সোফায় গিয়ে বসে টিভির বাংলা চ্যানেলটা খুলে দিল। আজকাল তো বোতাম টিপলেই একেবারেই ঘরের মেয়ে হওয়া যায়। মুখ নিচু করেই সোফার ওপরে পা দুটো উঠিয়ে দিল। তারপর দুই হাঁটুর ভেতরে থুতনিটা গুঁজে বসে ভাবছিল মিলি, নিজের দেশটাই ছিল সবচেয়ে ভাল। এখানে যেন বড্ড টেনশন আর ডিপ্রেশন। অনেকেই চাকরি করে। ঘরে-বাইরে কেবল কাজ আর কাজ। অবসর নেই কোন। সপ্তাহান্তে মাঝে মাঝেই গ্রুপ পার্টি তাই লেগেই থাকে। সেখানে যারা কাজ করে তারা কত সাবলীল। এ’সব দেখে মিলির চাকরি করার খুব শখ হল।

এখানে অল্প বিদ্যেতেও চাকরি পাওয়া যায় শুনেছে বান্ধবীদের কাছে। এটা শোনার পর থেকেই ওর মনের শুকনো মাটিতে নববর্ষার কিঙ্কিণী, মনের নদীতে জলের ছলছলাৎ শব্দেরা নেচে উঠেছে। স্বামীর কাছে বেশ আবদার করেই তাই চাকরি করার কথাটা পাড়ল। স্বামীর মুখে নিঃশব্দ হাসি ফুটে উঠল। চোখ নাচিয়ে বলে উঠল, ‘কত ধানে কত চাল জানো?’

মিলিও তার তুরুক জবাব দিল, ‘মেপে দেখিনি তো, জানব কী ভাবে? আর আমার জেনেও দরকার নেই। কাজ করার ইচ্ছে হয়েছে তাই তোমায় জিজ্ঞেস করছি।’

স্বামী হেসে বলল, ‘যাবে যাও। কাজ খোঁজো, ইন্টারভিউ দিতে থাকো। ডু ইওর বেস্ট।’

—কী রকম মানুষ রে বাবা! মনে মনে বলে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিলি। মনে যে ছোট্ট ঘাসটা জন্ম নিয়েছিল, সেও কেমন যেন নেতিয়ে পড়ল। জীবনে এক-একটা সময় আসে যখন মানুষকে স্বীকার করে নিতেই হয়, প্রথম আর চলতির মধ্যে প্রথমটাই বেস্ট। আমাদের একজন বড় দার্শনিক বলেছেন- ‘ক্ষেতে জল দিতে হলে জলাধার থাকে উঁচু কোন জায়গায়। জল দিলে, জলটা ক্ষেতে আসার চেষ্টা করে। একটা দরজা দিয়ে তাকে আটকে রাখা হয়। কিন্তু দরজা খোলামাত্র জল আপন ধর্মে ছুটে যায়, পথে যদি ধুলো-কাদা থাকে, জল তা ধুয়ে নিয়ে যায়।’ কিন্তু মানুষের এই স্বর্গীয় প্রকৃতি প্রকাশের কারণ বা ফল কোনটাই ওই ধুলো-কাদা নয়। এক আকস্মিক ঘটনা মাত্র, অতএব এর সমাধান আছে।

তাও আর একবার ইন্টারভিউয়ের নাম শুনে মিলি আবার আঁতকে উঠল। ঘরের আশেপাশে কোথাও তীক্ষ্ণ শিস দিয়ে ডেকে উঠল মকিংবার্ড। চতুর্থীর শশীর মতো ক্ষীণ হাসি ভেসে উঠল তার মুখে। একটা দমকা হাওয়া শিস দিয়ে গেল ঠিক কোকিলের মতো। মনে পরে গেল কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কথা, ছেলে বেলায় মনে করতাম কোকিল বুঝি পাখি নয়, ভ্রাম্যমাণ সুমিষ্ট স্বর মাত্র।’ এই দেশে যদিও কোকিল দুর্লভ। কোকিলের দেখা তো সে পায়নি। তাই নিজেই নিজেকে বলে উঠল, ‘ওরে বাবা! ইন্টারভিউ?’ মনে পড়ে গেল বিয়ের আগের ইন্টারভিউয়ের কথা। কত ইন্টারভিউ দিতে হয়েছে তাকে! তারপর তার রেজাল্টের জন্য চিন্তা। বাবা-মায়ের উপাংশুকথন।

নিজের মনেই প্রশ্ন করল, আচ্ছা এখানে এত প্রবাসী বাঙালি বধূ— এরা সবাই কী তাদের ঠাকুরমার কথা না শুনে পা ছড়িয়ে খেতে বসত নাকি? মনে পড়ল ওর বিয়ের জন্য মা-বাবার কত চিন্তা, কত খরচা, আড়ালে আবডালে ফিসফিসানি। অথচ এখানে অনেক বাবা-মাকেই বলতে শোনে, ‘ছেলে-মেয়ের জন্য চিন্তা করি না, ওদের যখন সময় হবে ওরা নিজেরাই নিজেদের সাথি বেছে নেবে। শুধু আমাদের শুনতে বাকি যে, “উই আর রেডি নাও।” চার হাত এক করে দেওয়া আমাদের একমাত্র কাজ।’ মা-বাবার মনে যেন কত শান্তি। বেশ গর্বের সাথেই কথাগুলো বলেন ওনারা কিন্তু! আমাদের বাবা-মায়ের সাথে অনেক তফাত এনাদের। শুধু তাই নয় ঝক্কিও কম। দেশের মতো অত জলখাবারের জন্য ডলারও গচ্ছা যায় না। এদিক-ওদিক ছুটতেও হয় না পাত্র-পাত্রী খুঁজতে। মিলি নিজের মনেই ভাবতে লাগল, অনেক নিয়মই তো এখন পাল্টাচ্ছে! এটাই বা পাল্টাবে না কেন? হয়তো পাল্টিয়েছে কিন্তু তার ক্ষেত্রে পাল্টায়নি।

এরকম তো হতে পারে যে, পাত্রী যাবে পাত্রের ইন্টারভিউ নিতে? আজকাল তো চাকরির ক্ষেত্রে অনেক মহিলারা পুরুষের ইন্টারভিউ নেন। চাকরির ইন্টারভিউ আর সম্পূর্ণ নতুন পরিবারে পদার্পণ করার যে ইন্টারভিউ মোটামুটি দুটোই তো প্রায় একই ধাঁচের। চাকরির ইন্টার্ভিউতে পাশ করলে পকেটে মা লক্ষ্মী (টাকা) বিরাজ করেন আর বিয়ের ইন্টারভিউতে পাশ করলে ঘরে মা লক্ষ্মী (বৌ) বিরাজ করেন। এটাই শুধু যা ইন্টারভিউয়ের এসপার আর ওসপার। যান্ত্রিক ডিজিটালের যুগে চলাফেরা করছি আমরা। কিন্তু আমাদের অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে অনেক সময়ে বহু মাইল পেছনে।

ইন্টারভিউ দেওয়া ও নেওয়ার পদ্ধতি যদিও প্রায় একই তবুও তার মধ্যে দুটো বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। একটাতে জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে যাওয়া আর একটাতে অভিভাবকদের জলখাবারের পয়সা বেশ কিছু গচ্ছা যাওয়া। কাজ তাতে সফল হোক আর নাই হোক। ‘এক দানে ছক্কা না হলেই অক্কা।’ কথাটা মিলি রেগে গেলে নিজের মনে নিজে নিজে আওড়ায় ছন্দে মিলিয়ে। লুডো খেলার মতো যতক্ষণ না ছক্কা পড়ে ততক্ষণ ঘুঁটি ঘর থেকে বের হয় না। ডাইস চেলে যেতে হয়। তেমনই যতক্ষণ না ইন্টারভিউতে পাশ করে রেজাল্ট পাওয়া যায় ততক্ষণই ইন্টারভিউ দিয়ে যেতে হয় নানান জায়গায়। পছন্দ মতো হলে হায়ার তা না হলে জিরো টায়ার—রিজেক্ট।

সত্যি কথা বলতে কী ইন্টারভিউয়ের নাম শুনলে নার্ভাস হয়নি, এরকম মানুষ কিন্তু খুব কমই শোনা যায়। কর্মক্ষেত্রের জন্যেও ইন্টারভিউ দিতে গেলে কিছু কিছু জিনিসের প্রতি সচেতন হতে হয় যেমন রেজুমে, কভার লেটার, সার্টিফিকেট, হ্যান্ডশেক, স্মাইল, ড্রেসকোড, কোয়ালিফিকেশন, অ্যাপিয়ারেন্স, এবং আরও কিছু। জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে গেলেও চট করে চাকরি পাওয়া সহজ হয় না, ম্যানার্স-এর ঠেলায় অন্ধকার। যদিও মিলিকে তখনও পর্যন্ত জুতোর সুকতলা ক্ষোয়াতে হয়নি। বিদেশে আসতে যে ইন্টারভিউ দিতে হয়েছিল তাতেও এত ভুগতে হয়নি। জীবনে আরও আরও ইন্টারভিউ দিতে হবে মিলিকে।

এরপর প্রেগন্যান্সি ইন্টারভিউ। ফলাফল? ছেলে না মেয়ে? একমাত্র ছেলের সাথে বিয়ে কাজেই ছেলে না হলে তো বংশ রক্ষা হবে না। এখনও আছে পৃথিবীর সব জায়গায়। মুখে যতই বলুক, এখনকার দিনে আবার ছেলে-মেয়ে! মুখে মারিতং জগত! মনকে ডিঙোতে দিতে চায় না। কাজেই এ-ও এক ভয়ংকর ইন্টারভিউ। আর যদি শ্বশুরবাড়ির বা স্বামীটির পছন্দ মতো হয়, তাহলে বাড়তি একটা ‘সৌভাগ্যবতী’ উপাধিও জুটে যায় কপালে।

এখন তো আর বাউল দেখা যায় না, নয়তো শোনা যেত...

জীবনপুরের পথিক রে ভাই / কোন দেশে শাকিল নাই / কোথাও আমার মনের খবর পেলাম না...”

মিলি আজকাল সময় পেলেই একটার সাথে আর একটার তুলনা খোঁজে। বৈবাহিক ইন্টারভিউয়ের কথাও তো এক পরিবার থেকে আর এক পরিবারে যাওয়ারই ইন্টারভিউ। অনেকটা নতুন কাজে যুক্ত হওয়ার মতোই। পাল্টানো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আবহমান বাঙালি জীবন এখন যদিও গ্লোবাল, তাও তো শুনতে পাওয়া যায় এখনও বর্তমান নানান ঝক্কির এই ইন্টারভিউ।

যা সহজ, সরল, স্বাভাবিক, তাই তো চিরকালের। অস্বাভাবিক কোনকিছুই চিরকালের হয় না, হতে পারে না। তাও একটু রদবদল হোক না। আর এই রদবদল একমাত্র করতে পারে মেয়েরাই।

সমাপ্ত


No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)