বাতায়ন/হলদে খাম/১ম বর্ষ/৭ম সংখ্যা/২৭শে মে, ২০২৩
হলদে
খাম
সঞ্জয় কুমার দাস
লহরীর প্রতি মহাসাগর
লহরী,
আজ বুঝলাম তুমি কতটা সত্যি কথা বলো। তুমি বলেছিলে, ‘আমার চোখে
তুমি চিরযুবক।’ সত্যিই তাই। তা না-হলে প্রায় দু’ঘণ্টা সামনের সিটে বসেও আমাকে
চিনতে পারলে না! আমি কিন্তু তোমাকে ঠিক চিনেছি।
আজকের দিনে, তোমার বয়স আটান্ন বছর সাত মাস বাইশ দিন। আমার
চৌষট্টি বছর পাঁচ মাস কুড়ি দিন। পরিপাটি করে ছিমছাম শাড়ি পরা, পিঠ বেড় দিয়ে আঁচলটা
বাঁ হাতে ধরে থাকা, ডান হাতের কব্জিতে সরু ব্রেসলেট ওয়াচ। কানে বেশ বড় একটা
হায়দ্রাবাদী মুক্তোর টপ। গলায় একটা সরু সোনার চেন। অফ হোয়াইট জামদানিটা পাঁচ ফুট ছ’
ইঞ্চির শরীরটা নিপুণ ভাবে ঢেকে রেখেছে। চোখে সোনালি ফ্রেমের রীমলেস চশমা। সব
মিলিয়ে দেবী শুভ্রা। বেণীসজ্জা কোন দিনই তোমার ধৈর্যে কুলোত না, তাই চুল কখনও পিঠ
ছাপাতে পারেনি। তবে এখনও ঘাড় পর্যন্ত বেশ পরিপুষ্টই আছে। শুধু মাথার কয়েকটা সাদা
সুতো ঘোষণা করছে— সামনেই ষাট। বাঁ-গালের সেই টোলটা দেখার জন্য, সারাক্ষণ তোমার
মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু তুমি তো সারাক্ষণই ছিলে মৌনী। কোলের ওপর ছিল
শান্তিনিকেতনী সেই-ই ব্যাগটা, যার কোণে, সুতো দিয়ে এখনও “P” লেখা।
বোলপুর থেকে যখন উঠলে, অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। এখনও একইরকম ঋজু
ভঙ্গি। এতটুকু ব্যস্ততা না দেখিয়ে সোজা নিজের সংরক্ষিত আসনে বসে পড়লে। চার দিকটা
একবারের জন্য দেখে নিলে। ডান দিকে একটি বিংশতিবর্ষীয়া তরুণী। বাঁ দিকে বছর বারোর
একটি কিশোর। সামনে আমাকেও দেখলে, কিন্তু চিনলে না। কারণ তো একটাই, তোমার চোখে,
তোমার মহাসাগর তো ‘চিরযুবক’। তাই হয়তো চিনতে পারনি। ওই শান্তিনিকেতনী ব্যাগটায় কী
আছে, আমি তাও জানি। একটা গীতবিতান। একটা চশমার বাক্স, সেটা অতিরিক্ত। দু’-তিনটে ঝর্না
কলম। তাতে একটা অবশ্যই লাল কালির। একটা ভাঁজ করা ছাতা। নিজের পরিচয় পত্র, আর ত্রিশ
বছর তিন মাস আগে, বেলুড় মঠে, তোমাকে দেওয়া আমার শেষ হাতচিঠিটা। তখন-তখনই যেটা
খোলার অনুমতি ছিল না। বলেছিলাম, ‘বাড়ি গিয়ে খুলবে।’
তারপর তুমি পাগলের মতো আমাকে খুঁজেছ! কলকাতা ছাড়িয়ে, চন্দননগর,
রাঁচি, বহরমপুর, চুরুলিয়া, আসানসোল, বসিরহাট… প্রতিটা জায়গাতেই আমি তোমাকে ছায়ার
মতো অনুসরণ করেছিলাম। তুমি অবশ্য জানতে না। মাস খানেকের ব্যর্থ অনুসন্ধানের পর,
তুমি মৌনব্রত নিলে। তোমার একমাত্র আশ্রয়, তোমার মা, চিৎপুরের বাড়িতেই দেহ রাখলেন।
তখন কাশী মিত্তির ঘাটেও আমি ছিলাম। তারপরেই তুমি হারিয়ে গেলে! ভাবলাম সংসার পেতেছ।
প্রায় বছর দশেক পরে, খবর পেয়েছিলাম, তুমি ঠিকানা বদলে চিৎপুর থেকে বোলপুরে চলে
গেছ, এবং অবিবাহিতাই রয়ে গেছ।
আসলে এমন ব্যবহারের মূলে ছিল, অপরেশ, অপরেশ নন্দী। তোমার
গৃহশিক্ষকের একমাত্র প্রবাসী পুত্র। হঠাৎই একদিন তোমাদের কলেজ স্ট্রিটের দিলখুস-এ
দেখেছিলাম। সহ্য করতে পারিনি। তুমিও নিজে থেকে তেমন কিছু বলোনি। ভেবেছিলাম তোমার
উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে নষ্ট করার অধিকার আমার নেই। যখন জানলাম তুমি শুধুমাত্র
প্রশান্তরই লহরী, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তুমি কী ভেবেছ বা ভাবো, আমি আজও জানি না।
তবে আমি এখনও সেই প্রশান্তই আছি। অতল গভীরতা আর গাম্ভীর্য নিয়ে
একদম একা! এইটুকু জানাতেই এই খোলা চিঠি। জানি না এ’-চিঠি তুমি কোনদিন পাবে কি না?
পেলে হয়তো অজান্তেই একটা মুক্তো গড়িয়ে পড়বে, হয়তো নয়!
‘ভাল থেকো’ বলতেও ভাল লাগছে না। সময়টা অতিবাহিত হোক, এইটুকুই
আশা!
ইতি—
প্রশান্ত (তোমার মহাসাগর)
প্রশান্ত (তোমার মহাসাগর)
No comments:
Post a Comment