অপরাজিতা
শ্রমণার এলোমেলো চিন্তায় ছেদ পরে ড্রাইভারের ডাকে, “ম্যাডাম এই
যে মল, আমি পার্কিং-এ থাকব।” ঘাড় নেড়ে শপিং মলের দিকে এগিয়ে যায় শ্রমণা। আজ গাড়িটা
সারাদিনই থাকবে ওদের জন্য। উঁহু শুধু আজ বলে না, যে ক’দিন এ দেশে থাকবে গাড়িটা তো
রাখতেই হবে। আজ একবার অয়নের সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে। এই গাড়ির ব্যবস্থাটাও অয়নই
করে দিয়েছে। ড্রাইভারটা বেশ ভাল, শান্ত, নম্র।
এ কথা-সে কথা ভাবতে ভাবতে এ দোকান-সে দোকান ঘুরে বেড়ায় শ্রমণা, টুকটাক কেনাকাটাও চলতে থাকে। ফোর্থ ফ্লোরে উঠে সিসিডি-তে চোখ পড়তেই কফির নেশা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে শ্রমণার, সত্যি তো কতক্ষণ চা-কফি কিচ্ছু খাওয়া হয়নি। এখন একটা কোল্ড কফি হলে মন্দ হয় না। সিসিডি-তে ঢুকে পছন্দসই একটা জায়গা বেছে বসতে না-বসতেই পিছন থেকে একটা ইতস্তত ডাক, “আরে শ্রমণা না!”
অবাক হয়ে পিছন ফিরে তাকায় শ্রমণা, তার পরিচিত কেউ? মোটাসোটা, গিন্নিবান্নি এক মহিলা মৃদু হাসি নিয়ে তাকিয়ে। অনেক কষ্টেও কিছুতেই মনে করতে পারে না শ্রমণা, কে এই মহিলা! বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, দেখেই বোঝা যায় অত্যন্ত সাধারণ ঘরের বৌ।
শ্রমণার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে ইতস্তত মহিলা খুব সংকোচ নিয়েই বলেন, “জানি আমায় চিনতে পারছিস না, পারার কথাও না, অনেক বদলে গেছি আমি। তবে তোকে আমি ঠিক চিনেছি, তুই সেই একই আছিস, মনে হচ্ছে আমার সামনে সেই পঁচিশ বছর আগের শ্রমণা দাঁড়িয়ে, কলেজের সেই-ই শ্রমণা, আমি শিখা।”
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো কেঁপে ওঠে শ্রমণার সমস্ত অন্তরাত্মা, ঘৃণায় কুঁচকে যায় চোখমুখ। শিখা, শিখা রায়, ওর জীবনের শনি, অভিশাপ। এক লহমায় যার জন্য শ্রমণার জীবন তছনছ হয়ে গেছিল, শ্রমণা হেরে গেছিল।
কিন্তু সেদিনের সেই ছিপছিপে, মিষ্টি মেয়েটার কী হাল আজ! মুখে একটু বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে শ্রমণার। নিজেকে যথা সম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে, না আজ আর হারলে চলবে না, আজ জিততেই হবে শ্রমণাকে, হাসিমুখে বলে, “সরি চিনতেই পারিনি, বেশ বুড়িয়ে গেছিস, তা কী খবর? সব ভাল তো?”
মাথা নেড়ে শিখা বলে, “হ্যাঁ ওই চলছে, তোর খবর কী? তুই তো এখনও বাইরেই থাকিস তাই না?” ব্যাগ কাঁধে তুলে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে শ্রমণা বলে, “হ্যাঁ, লন্ডন, কালই এসেছি এখানে, মেয়ের বিয়ে। আসি রে।” “তোর মেয়ে?” বাঁকা হাসি দিয়ে শ্রমণা বলে, “হ্যাঁ আমার মেয়ে, কেন অসুবিধা আছে? আসি।”
অসহ্য লাগছে শ্রমণার, দমবন্ধ লাগছে, বেরোতে পারলে বাঁচে, কিন্তু শিখা ছাড়লে তো? “আমার ওপরে এখনও রেগে আছিস শ্রমণা? এত বছর পর দেখা, বোস-না একটু কথা বলি।” উফফ কী ন্যাকামি, রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে শ্রমণার, তবু নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলে, “না আসলে অনেক কাজ আছে তা-ই, মেয়েটাও একা আছে ফ্ল্যাটে, নতুন জায়গা…” “আর তোর বর?” উফফ, সেই হাড়জ্বালানি প্রশ্ন, উত্তেজিত হতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় শ্রমণা, “এসব কথা থাক, আমার সত্যিই বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে শিখা।” “আর একটু থাক-না, আমার বর আসবে এখুনি, দেখা হয়ে যাবে।”
এত নীচ, এত ঘৃণ্য হতে পারে মানুষ! এই শিখাই নাকি এক দিন প্রাণের বন্ধু ছিল শ্রমণার! কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে, ঠাস করে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করছে এবার। কী সাহস! এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে শ্রমণা বলে, “সরি রে, সেই ইচ্ছে বা প্রবণতা কোনোটাই আমার নেই, চলি।”
“শ্রমণা, শোন…” শিখার ডাকে এবার বেশ ঝাঁঝিয়েই ওঠে শ্রমণা, “hey listen, তোর বর বা তুই কাউকে নিয়েই কোনও ইনটারেস্ট নেই আমার। আমায় অভদ্র হতে বাধ্য করিস না প্লিজ।” “তুই ভাবছিস আমার সঙ্গে রঞ্জনদার বিয়ে হয়েছে, তাই এত রিয়্যাক্ট করছিস তাই না?” “রঞ্জনদা! তুই বরকে দাদা বলিস নাকি!” মুখ বেঁকায় শ্রমণা।
“আমার বরের নাম সোমনাথ, আমি জানতাম তুই ভুল বুঝছিস, তাই বরের
প্রসঙ্গ তুলেছিলাম…” ধপাস করে আবার চেয়ারে বসে পরে শ্রমণা, “মানে কী এসব কথার!
তোরা বিয়ে করিসনি? কেন? এত্ত প্রেম! ওহ সেই লম্পটটা বুঝি তোকেও ডিচ করেছে?”
পাবলিক প্লেস, চারিদিকে লোকজন ভর্তি, সমস্তই বিস্মৃত হয়ে শিখাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে শ্রমণা। “এই হয় শিখা, এই হয়, আর কেউ না জানুক তুই অন্তত জানতিস আমার সঙ্গে রঞ্জনের সম্পর্কের কথা। রঞ্জন যখন তোকে প্রোপোস করল তুই কী করে রাজি হলি তাতে? কী ভাবে পারলি আমায় ঠকাতে? তোর উচিৎ ছিল লম্পটটার মুখোশ খুলে দেওয়া, তা না করে তুই... ছি! অপরকে ঠকালে নিজেকেও ঠকতে হয় দেখলি তো? স্কাউণ্ড্রেলটা কাউকেই ভালবাসেনি, আমাকে, তোকে সবাইকে নিয়েই খেলে গেছে।”
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment