প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দেবীর বিসর্জন | বিশ্ব প্রসাদ ঘোষ

বাতায়ন/মাসিক/কবিতা/২য় বর্ষ/১৮তম সংখ্যা/২৩শে কার্ত্তিক , ১৪৩১ চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা | কবিতা বিশ্ব প্রসাদ ঘোষ দেবীর বিসর্জন তুমি ...

Monday, May 15, 2023

নাটক | অমৃত | অমৃতা মজুমদার

বাতায়ন/নাট্য সাহিত্য/১ম বর্ষ/৫ম সংখ্যা/১৫ই মে, ২০২৩

নাটক
অমৃতা মজুমদার
 
অমৃত

 
[পাঠক এটিকে নাট্য সাহিত্যের হিসেবে বিচার না করে একটি নাট্য মুহূর্ত হিসেবেই বিচার করবেন।]
 
[চরিত্র: শ্রাবণী ও স্বপ্ননীল]
 
গড়িয়াহাটের একটি ক্যাফে থেকে বেরিয়ে দরজাটা খোলা অবস্থায় ধরেই রাখল স্বপ্ননীল। শ্রাবণী একটা তির্যক দৃষ্টিতে স্বপ্নকে দেখে হনহন করে হাঁটা লাগাল। স্বপ্নও দরজাটা সামান্য ঠেলে দিয়ে পিছু নিল, বলল—
 
— কী হয়েছে?
— কী হবে?
— পালাচ্ছিস যে?
— কোথায়?
— এই যে!
— দেরি হয়ে গেছে, মা বকবে।
— দেরির কী আছে? যাবি তো আমার সঙ্গে।
— না।
— না মানে?
— না মানে যাব না। না বোঝার মতো তো কিছু নেই।
— কেন? আমার সাথেই তো যাস!
— আজ থেকে আর যাব না। আমি একা যেতে পারি।
— তুই একা যেতে পারবি না সে কথা তো বলিনি। তবে যাবি কেন যখন গাড়ি আছে? আর আমিও তো ওদিকেই যাব!
— এমনি যাব না। মুড নেই।
— না আমার সঙ্গেই চল।
— না। আমি ট্রেনে চলে যাব।
 
শ্রাবণী বাঁ-দিকের রাস্তা ধরল, সেদিকে স্টেশন। স্বপ্ন ওর হাতটা ধরে ওকে গাড়ির দিকে নিয়ে গেল।
 
— আহা! তুই ট্রেনে চাপতে ভালবাসিস, লোকের ঘামের গন্ধ তোর ভাল লাগে, ঠেলাঠেলিতে তুই এক্সপার্ট সে আমি ভাল মতোই জানি। ট্রেনেই যাস! তবে বালিগঞ্জ থেকে না গিয়ে নিউ গড়িয়া থেকে। তত দূর আমার গাড়িতে চল।
— ভাল লাগছে না, প্লিজ ছাড়।
— ছাড়ব বলে ধরেছি কি?
— উফফ! ভাল লাগছে না!
— আচ্ছা বল, পাস্তাটা কেমন ছিল?
— জানি না।
— সে কী? গপগপ করে খেলি তো!
— তাহলে নিশ্চয়ই ভাল ছিল! বোকা বোকা কথাগুলো বন্ধ কর, মাথাটা গরম হচ্ছে এবার।
— ফুঁ দিয়ে দেব?
 
শ্রাবণী কটমট করে স্বপ্নর দিকে তাকিয়ে, “অসহ্য!”
ইতিমধ্যে ওরা পৌঁছল গাড়ির কাছে। উঠে বসল। সিটবেল্ট লাগাল স্বপ্ন, শ্রাবণীকেও লাগাতে বলল।
 
— না। ভাল লাগে না।
— লাগিয়ে নে।
— কেন? ভরসা নেই নিজের চালানোর উপর?
— সে আছে। তবে মামাকে দেওয়ার মতো ফালতু টাকা নেই।
 
স্বপ্ন নিজেই শ্রাবণীর সিটবেল্টটা লাগিয়ে দিল।
 
— এই জন্য যাব না বলেছিলাম! উফফ!
 
গাড়ি চালাতে শুরু করল স্বপ্ন। গাড়ি চালানোর সময় ও কম কথা বলে। শ্রাবণীই অনর্গল বকবক করে যায়, আজ ব্যতিক্রম।
 
— কী হয়েছে তোর?
— কিছু না।
— আজ এত চুপচাপ যে?
— আমি সবার সঙ্গে বেশি কথা বলি না।
— আচ্ছা! আমি এখন সবার দলে?
— হুম।
— বেশ।
 
এরপর বেশ খানিক সময় চুপচাপ। গাড়ি যাদবপুর থানা থেকে বাঁদিক ধরল।
 
— চল একদিন ঘুরে আসি কোথাও। অনেকদিন সমুদ্র দেখিনি। যাবি?
— না, যাব না।
— কেন? চল-না!
— যাব না। বিরক্ত করিস না। মাথাটা খুব গরম আছে।
— এসি চালাব?
— মেরেই ফেলব তোকে।
 
বিস্তর চড়থাপ্পড়-ঘুসি চলতে থাকে, সঙ্গে প্রকাশ অযোগ্য সম্বোধন, বোধহয় ভালবাসার।
 
— আরে কী করছিস? অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে তো!
— হয়ে যাক, মরে যা তুই।
— তুইও তো যাবি!
— তোর ভুলে অন্তত আমি মরব না।
— সেই! পাপীদের সহজে মুক্তি মেলে না।
— আমার সঙ্গে যাবি কেন বেড়াতে? তোর যাওয়ার লোকের অভাব? যা তাকে নিয়ে।
— কাকে?
— খিস্তি খেতে ভাল লাগে?
— না, চুমু।
— গিয়ে বল, দেবে।
— আরে! কে দেবে?
— কেন! ক্যাফেতে বসে তো সবার সামনে বলে এলি, ‘প্রাক্তনকে ভোলা যায় না। মনে পড়লে, দেখা হলে বুকের ভিতর চিনচিন করে। কিছু ছিল মাইরি! পরিকথার কন্যা!’ আর আমি তো কাজের মাসি, তিন বাড়ি বাসন মাজি। আরও কী যেন বললি!
 
দুরুদুরু বুকে, বোকা বোকা হাসি নিয়ে স্বপ্ন বলল,
 
— না না আর কিছু না।
— দাঁড়া, ও হ্যাঁ! ‘পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা!’ সেই! পাঁচ আড়াইয়ে মন ভরবে কী করে বল? তখন জাস্ট তোকে একটা লাথি মারতে ইচ্ছে করছিল।
— ইস্ কী হিংসুটে! আহা! ওসব একটু বলতে হয়। আসলে অমিতের সঙ্গে ওর কতটা যোগাযোগ আছে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছিলাম।
— সেই! যোগাযোগ থাকলে যদি আমার কথা বলে দেয়, তাহলে তোর অসুবিধা হয়ে যাবে। তাই না?
— না সে-সব না। আমি চাইছি যে ও বলুক।
— যাতে ন্যাকামি মেরে তোকে আবার মেসেজ করে, আবার যাতে যোগাযোগটা তৈরি হয়, তাই তো!
— উফফ আচ্ছা জ্বালা তো!
— স্বাভাবিক! এখন আমি জ্বালা ছাড়া আর কী হব?
— উফফ! তুই বলিস না তোর প্রাক্তনদের কথা?
— বেশ করি। আরও বলব।
— নিজের বেলায় অমনি বেশ করি!
— হ্যাঁ বেশ করি।
— বেশ।
 
গাড়ি পৌঁছল কালিকাপুর — অভিষিক্তা সিগনালে। ১৮, ১৭, ১৬, ১৫... ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল। গাড়ি সিগনাল ছাড়ল।
 
— আমি আর যাব না তোর সঙ্গে। আমাকে নামিয়ে দে। গাড়ি থামা।
— বৃষ্টি পড়ছে।
— আই ডোন্ট কেয়ার। আমি নামব।
— ভিজলে শরীর খারাপ হবে।
— তাতে তোর কী? আমার কাছে ছাতা আছে।
— না, এখানে নামানো যাবে না।
— কেন?
— কিঁউ আপনে উও কাহায়াত নেহি শুনি? রাত কী আন্ধেরো মে এক আকেলি লেড়কি খুলি হুই তিজোরি য্যাইসা হোতি হ্যায়।
— ডিসগাস্টিং।
 
শ্রাবণীকে রাগতে দেখে স্বপ্ননীলের বেশ মজা হল। স্বপ্ন মনে মনে হাসছে কিন্তু বাইরে হাসার সাহস নেই।
 
— আমার তোকে ভালবাসাটাই ভুল হয়েছে। ইউ ডোন্ট ওয়ার্থ ইট। জাস্ট ডোন্ট।
— ঠিক বলেছিস, আই ডোন্ট ওয়ার্থ ইট। এটাই বাকি ছিল শুনতে। বাড়ির সবাই মিলে ব্যান্ডেল গেছিলাম সেদিন বেড়াতে, ভোর বেলা বেরিয়ে। ওখানে সারাদিন ঘুরেছি। তারপর ওখান থেকে ইমামবাড়া, সেখান থেকে ত্রিবেণী। পুরোটাই লোকাল ট্রেনে আর টোটোতে। ফেরার পথে যখন তোর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, বললি দেখা করতে ইচ্ছে করছে। হাওড়ায় নেমেছি বিকেল পাঁচটা। তারপর ওলা ধরে বাড়ি ফিরেছি, ছ’টা দশ। খানিক জল খেয়ে বাইক নিয়ে বেরিয়েছি, ছ’টা পনেরো। তোর অফিসের সামনে পৌঁছেছি, সাড়ে ছ’টা। অফিস টাইম, কলকাতার রাস্তা, বারো কিলোমিটার! শুধুই তোর মন রাখতে। তা-ও দশ মিনিট দাঁড় করিয়ে রেখেছিলি, কিছু বলিনি। ঠিক, ভালবাসি না!
— সে আমিও করেছি। জীবনে কোনদিন রান্নাঘরে ঢুকিনি, তোর জন্য সেদিন মাংস রান্না করেছি। হাতে ছেঁকাও খেয়েছি।
— সে রান্না তো সবাই খেয়েছে।
— হ্যাঁ, আর সবাই ভাল বলেছে তুই বাদে। তুই বললি জঘন্য হয়েছে, বাঙালের হাতের রান্না খাওয়া যায় না।
— শুধু সেটাই শুনলি? তিনবার চেয়ে খেলাম সেটা দেখলি না?
— তুই রান্না করলে তো আমি চেয়েও খাই, ভাল হয়েছেও বলি।
— আমি একটু আলাদা। আমার একটা স্টাইল আছে।
— ইউ গো টু হেল!
— আই উড লাভ টু! আমি যতদূর জানি, হেল আমেরিকার একটা খুব সুন্দর জায়গা। ওখানেই যাব হানিমুনে।
 
স্বপ্ননীল গাড়িটা নিউ গড়িয়া স্টেশনের কাছে একটা গাছের তলায় ওদের প্রিয় জায়গায় দাঁড় করায়। এখানেই ওরা প্রায়দিন গাড়ি থামিয়ে গল্প করে। স্বপ্ন সিগারেট খায়। এদিনও স্বপ্ন গাড়ি থামিয়ে একটা সিগারেট ধরাল।
 
— আমার কিন্তু দেরি হচ্ছে।
— হোক।
— তুই খুব খারাপ একটা মানুষ। সব সময় আমার উপর জোর খাটাস।
— একদম না। ভালবাসি শুধু।
— ন্যাকামি রাখ। ওই মেয়েটার সাথে তোর কী সম্পর্ক আমি জানি না কিন্তু।
— সেটা আবার কে?
— শ্রেয়া।
— উফফ! আর ক’বার? বলেছি তো কিছু নেই।
— আমি কী জানি! আমাকে বলিস কিছু নেই। তারপর আমার আড়াল হলেই দেখা করিস হয়তো।
— বাজে বকার জন্য আলাদা করে ডিপ্লোমা করেছিস? দেখাটা করব কখন? রবিবার ছাড়া তোর সঙ্গে আমার অন্যদিন সকালে কোনও কথা হয় না। সেটা ইচ্ছে করেই, সারাদিনে প্রথম দেখা হওয়ার একটা অপেক্ষা তৈরি হয়। একটা ভাবনা থাকে আজ কী ড্রেস পরবে, কেমন চুল বাঁধবে ইত্যাদি। কিন্তু ওই যে দেখা হল সকাল দশটায়, তারপর সারাদিন তো এক সঙ্গে। রাত দশটা-সাড়ে দশটা অবধি এক সঙ্গে থাকি, দুটো পর্যন্ত কথা হয় রোজ। অন্য কারও সাথে দেখা করব কখন?
— সেই! এমনি এমনি ‘ব্যাবু! ব্যাবু!’ লেখা মেসেজ আসে বল?
 
স্বপ্ন একটু সময় ঢোক গিলে তারপর জোরে জোরে হেসে,
 
— সে আমি কী করব লিখলে? আসলে ও ছোট থেকেই পশ্চিমে থেকেছে তো, তাই ও ভাবে সব বাঙালি ছেলের ডাকনাম বাবু। তাই ডাকে বোধহয়।
 
শ্রাবণী গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম করে,
 
— আমি চললাম। আর পোষাচ্ছে না জাস্ট।
— আরে! বৃষ্টি পড়ছে তো!
 
শ্রাবণীর হাতটা চেপে ধরে স্বপ্ন, শ্রাবণী বলে—
 
— ছাড় আমাকে।
— প্লিজ যাস না। আচ্ছা আই অ্যাম সরি।
 
শ্রাবণী চেঁচিয়ে উঠে বলে,
 
— ফা* ইউ!
— সত্যি! কোথায়? কখন? আমি ইন্টারেস্টেড।
 
শ্রাবণী হেসে ফেলে,
 
— ভাল লাগছে না কিন্তু!
— প্লিজ আর রাগ করিস না। আমি সরি বলছি কান ধরে। অ্যায় কবিরাআআআ মান যাআআআআ...
— সরি তে হবে না।
— তাহলে?
— আমি কী জানি?
— চুমু?
— উমমমম! চলতে পারে।
 
স্বপ্ন শ্রাবণীর গালে একটা চুমু খায়। শ্রাবণী আরেকটা গাল বাড়িয়ে দেয়। সেখানেও একটা চুমু খায় স্বপ্ন। আরেকটা চুমু হাতে। এরপর শ্রাবণী নিজের জামার একটা বোতাম খুলে ঘাড়ের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বলে,
 
— এখানে একটা স্করপিও স্পেশাল চাই আমার।
 
স্বপ্ন নির্দেশ পালন করে ভাল ছেলের মতো।
 
— আরেকটা তোর যেখানে ইচ্ছে।
— চোখ বন্ধ কর।
 
শ্রাবণী চোখ বন্ধ করে। স্বপ্ননীল বোধহয় শ্রাবণীকে যতটা ভাল বাসে, ততটাই স্নেহ করে। তাই প্রাণ ভরে একটা স্নেহচুম্বন করে শ্রাবণীর কপালে।
 
— এটা কী হল?
— কেন, কী হল!
— তুমি ঠোঁট চেনো না?
— চিনি তো।
— তাহলে সেখানে দাও।
— না, ওখানে পাবি না।
— কেন?
— ঝগড়া করার জন্য।
— ঠিক তো!
— হ্যাঁ।
— বেশ। আমাকে স্টেশনে ছেড়ে দে।
— শোন!
— কী?
— আমাকে আরব সাগরের উপর উড়ন্ত ফানুসে চুমু খাবি?
— যদি আমাকে সারা জীবন শ্রাবণী বলে ডাকিস, তবেই!
 
অতঃপর ওদের সেই সন্ধের প্রথম চুমু গাড়ির ভিতর। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর চাঁদের আলো। সেই সন্ধের শেষ চুমুটা নিউ গড়িয়া স্টেশনের শেষ প্রান্তে। লোকজন বেশি নেই। ঝিকঝিক কিছু অস্পষ্ট আলো আর ব্যাকড্রপে ট্রেনের হেডলাইট।

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)