প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

ভিক্ষুক গাছ | তৈমুর খান

বাতায়ন/মাসিক/কবিতা/২য় বর্ষ/১৮তম সংখ্যা/২৩শে কার্ত্তিক , ১৪৩১ চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা | কবিতা তৈমুর খান ভিক্ষুক গাছ দু - একটি ভিক্...

Saturday, June 24, 2023

গোপীনাথের মেলা | জনা বন্দ্যোপাধ্যায়

বাতায়ন/ছোটগল্প/১ম বর্ষ/১১তম সংখ্যা/৮ই আষাঢ়, ১৪৩০


ছোটগল্প
জনা বন্দ্যোপাধ্যায়

গোপীনাথের মেলা

আজ এক ক্লাস সিনিয়র প্রশান্তদার সঙ্গে অগ্রদ্বীপের গোপীনাথের মেলা দেখতে এসেছে অজন্তা। দু’জনেই কালনা কলেজে পড়ে। প্রশান্তর অগ্রদ্বীপের গ্রামে মামার বাড়িতে শৈশব কেটেছে। এই গ্রাম আর মেলার কত গল্প শুনেছে অজন্তা। প্রশান্ত অজন্তাকে এর আগেও কয়েকটা মেলায় নিয়ে গেছে। প্রশান্তর নামের সঙ্গে স্বভাবের মিল আছে। প্রশান্তর বিভিন্ন মেলায় ঘুরে বেড়ানোর শখ। মেলায় বিভিন্ন মানুষজন ও জীবনযাত্রা দেখা যায়। প্রশান্তর মতো মুক্ত মনের ছেলে অজন্তা দেখেনি।


কাটোয়ার তিনটে স্টেশন আগে অগ্রদ্বীপ। এই গ্রামটি স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গঙ্গার অপর পাড়ে। অপ্রশস্ত খালের মতো গঙ্গা। দোল পূর্ণিমার পরের কৃষ্ণা একাদশী তিথিতে চিঁড়ে মহোৎসব দিয়ে মেলা আরম্ভ হয়। ওই দিন গোপীনাথ মন্দির থেকে বিগ্রহ চৈতন্যদেবের শিষ্য গোবিন্দ ঘোষের সমাধি মন্দিরে নিয়ে আসা হয় দেবতার হাত দিয়ে মানব পিতার কুশ ও পিণ্ডদানের উদ্দেশ্যে। এসব গল্প অজন্তার প্রশান্তর মুখে শোনা। মেলাটি গ্রামীণ মেলা হলেও বহু মানুষ পুণ্য অর্জনের জন্য আসে।

“গ্রামবাংলার মানুষ আজ অরন্ধন পালন করে।” এই কথাটা বলতে বলতে প্রশান্তর মনে পড়ে যায় অজন্তার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। সে গ্রামের ছেলে অভাবে মানুষ, খিদে পেলে না খেলেও চলে। কিন্তু অজন্তার পক্ষে তা সম্ভব নয়। অজন্তাকে শান্তিপুরের রাস মেলা, জয়দেবের কেন্দুলী মেলাও প্রশান্ত দেখাবে বলেছে। গোপীনাথের মেলায় প্রচুর কাঠের পুতুল বিক্রি হচ্ছে দেখে অজন্তা উচ্ছসিত হয়ে বলে, “সত্যিই এ এক প্রাণবন্ত মেলা!”

প্রশান্ত হেসে বলে, “আগে অবশ্য অগ্রদ্বীপের খ্যাতি ছিল বারুণী স্নান উৎসবের জন্য। গঙ্গাসাগরের মেলার থেকেও বেশি ভিড় হত।”

মেলায় এক জায়গায় কচুরি-তরকারি খেয়ে দু’জনে গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়ায়। শ্যামলা হলেও বেশ লম্বা ও বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা প্রশান্তর। বিএসসি পাস করে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ার ইচ্ছা প্রশান্তর। অজন্তা অঙ্কে অনার্স নিয়ে পড়ে। সে প্রশান্তকে গুরু বলে ডাকে। অজন্তা জানে প্রশান্তর মতো ছেলে কোনদিন কারোর ক্ষতি করতে পারে না। দু’জন মানুষের মধ্যে প্রেম হতে হলে আগে ভরসা ও শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি হওয়া দরকার।

প্রশান্তর বাবা ক্যানসারে মারা যাবার পর সে বর্তমানে টিউশন করে সংসারের ব্যয় ভার বহন করে। অজন্তাকে কোন কথাই লুকায়নি প্রশান্ত। বর্ধমানের ভেতর দিকে গ্রামের বাড়িতে প্রশান্তর মা আর ভাই থাকে। ভাই ক্লাস নাইনের ছাত্র। প্রশান্ত বর্ধমান শহরে একটি ঘর ভাড়া নিয়েছে সপ্তাহে চার দিন পড়াবে বলে। তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা মাইনে দিতে পারে না, তারা কেউ কেউ চাষের কাজ করে বা ফল বেচে সংসারে টাকা দেয়। প্রশান্তর কথায় “কষ্টে মানুষ হলে তবেই তো পড়াশোনার মূল্য বুঝবে!” প্রশান্তর সরলতা অজন্তাকে মুগ্ধ করে।

বেশ কিছু দিন প্রশান্ত কলেজে আসছে না। অজন্তার ফোনও ধরছে না। প্রশান্তর এক কাছের বন্ধু জানায় প্রশান্তর ভাই গুরুতর অসুস্থ। এরপর যে রাতে ম্যানেনজাইটিসে প্রশান্তর ভাই মারা যায়, সেই রাতেই শোকে, দুঃখে প্রশান্তর মা বিষ খান। এ সব ঘটনা প্রশান্তকে জগৎ সংসার থেকে বিমুখ করে। অজন্তা প্রশান্তর কষ্ট অনুভব করতে পারে।

অজন্তার বাবা-মা দু’জনেই সরকারি চাকুরে, অজন্তা একমাত্র সন্তান জেনেও প্রশান্ত অজন্তার থেকে কোনদিন কোন আর্থিক সাহায্য চায়নি। কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে প্রশান্ত নিখোঁজ হয়ে যায়। অজন্তা নিজের মায়ের কাছে প্রশান্তর প্রতি তার দুর্বলতার কথা প্রকাশ করে। প্রশান্তর সঙ্গে অজন্তার আর্থিক অবস্থার পার্থক্য থাকায় অজন্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা প্রশান্ত হয়তো কোনদিনই ভাবেনি। অজন্তার মা মেয়েকে অনেক বোঝান। অজন্তা ধীরে ধীরে নিজেকে সামলাতে শেখে। তবে সে একটি বার প্রশান্তকে দেখতে চায়। মাস তিনেক পর হঠাৎ করেই অজন্তার বিয়ে ঠিক হয়। পাত্রটি অজন্তার কাকিমার দূর সম্পর্কের ভাই। তাঁরা উচ্চ বংশ ও অবস্থাপন্ন। অজন্তার বাবা-মা রাজি হয়ে যান।

অজন্তার স্বামী অখিলেশ ইনকাম ট্যাক্স অফিসার হলেও ফটোগ্রাফির শখ। বেশ উদার ও মার্জিত ছেলে অখিলেশ। অজন্তার অনুরোধে বিয়ের পর অখিলেশ অজন্তাকে গোপীনাথের মেলায় নিয়ে আসেন। অজন্তা দেখে মেলার পরিবেশ ও লোকসমাগম একই আছে। এখানে প্রতি বছরের মতো এবারেও চারশো-পাঁচশো আখড়া তৈরি হয়েছে দর্শনার্থীদের সেবার জন্য। অজন্তা অখিলেশকে বলে, “কথিত আছে শ্রীচৈতন্য গোপীনাথের বিগ্রহ নির্মাণ করিয়ে এখানে প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিষ্য গোবিন্দ ঘোষের হাতে গোপীনাথের সেবার ভার অর্পণ করে নীলাচলে গমন করেন। গোবিন্দ ঘোষের মৃত্যু তিথিতেই তো মেলা শুরু হয়।” অজন্তা এত কিছু জানে দেখে অখিলেশ অবাক হন। অজন্তা তার প্রশান্তদার বলা কথাগুলো আজও ভুলতে পারেনি। এই মেলায় ছড়িয়ে আছে অজন্তার স্মৃতির সজীব টুকরোগুলো।

অখিলেশ নানান লোকজনের ছবি তুলতে ব্যস্ত। হঠাৎ ছাইভস্ম মাখা এক সাধু পাশ থেকে অজন্তাকে বলেন, “সুখী রহো, তুম সুখী রহো।” কণ্ঠস্বর হুবহু প্রশান্তদার মতো। অজন্তা মুহূর্তের জন্য চমকে ওঠে। কিন্তু জটাজুটোর ফাঁকে চেনার উপায় নেই চেহারা। অখিলেশ হাঁটতে হাঁটতে কিছু দূর এগিয়ে গেছেন। কিন্তু পেছন ফিরে অজন্তাকে না দেখতে পেয়ে অজন্তার নাম ধরে ডাকেন। ঘোর ভাঙে অজন্তার। কোথায় সেই সাধু! আশেপাশে অগণিত মানুষের ভিড়। অজন্তা অখিলেশকে খোঁজার জন্য এগিয়ে যায়। অখিলেশকে সেই সাধুর কথা অজন্তা বলতে পারে না।

অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ খুবই জাগ্রত। অজন্তার মনে হয় গোপীনাথের কৃপায় এক বারই মেলার মধ্যে সে তার প্রশান্তদার উপস্থিতি অনুভব করেছে, কিন্তু কিছু বোঝার আগেই আর তাকে খুঁজে পায়নি। গোপীনাথের মেলার প্রতি অজন্তার চিরকাল এক আত্মিক টান থেকেই যাবে, যা তাকে বার বার এই মেলায় নিয়ে আসবে!

 

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)