প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

ভিক্ষুক গাছ | তৈমুর খান

বাতায়ন/মাসিক/কবিতা/২য় বর্ষ/১৮তম সংখ্যা/২৩শে কার্ত্তিক , ১৪৩১ চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা | কবিতা তৈমুর খান ভিক্ষুক গাছ দু - একটি ভিক্...

Saturday, June 24, 2023

মুছে যাওয়া দিনগুলি | ডঃ হর্ষময় মণ্ডল

বাতায়ন/ধারাবাহিক/১ম বর্ষ/১১তম সংখ্যা/৮ই আষাঢ়, ১৪৩০


ধারাবাহিক
ডঃ হর্ষময় মণ্ডল
[১ম পর্ব]

মুছে যাওয়া দিনগুলি

পিকলু বলল, “বাপি তোমার লেখার টেবিলে একটা চিঠি আছে।” সুকোমলের ছেলের নাম পিকলু। সুকোমল টেবিলের কাছে এসে দেখল চিঠিটা। আশ্চর্য হয়ে গেল চিঠিটি দেখে। চিঠির কথা শুনে ভেবেছিল কোন সাহিত্য সভার চিঠি হবে।


আজকাল সুকোমলের পড়াশোনার ঘরে সাহিত্য সভার নিমন্ত্রণের চিঠি ছাড়া কোন আত্মীয়স্বজনের চিঠি এসেছে বলে তো মনে পড়ছে না বা সুকোমল কাউকে দু'কলম লিখে চিঠি দিয়েছে বলে মনে পড়ছে না। যা কথা চালাচালি ভাবের আদানপ্রদান হয় তা হল ফোনে বা পথ চলতে চলতে যদি দেখা হয় বা কোন অনুষ্ঠানে। চিঠির বাইরে প্রেরকের নাম নেই। হাতের লেখা  চেনা চেনা মনে হলেও চিনে উঠতে না পারার জন্য একটু কৌতুহল বশত চিঠিটা খুলে ফেলল সুকোমল। ইতি লেখার জায়গায় তোমার শেফালীদি দেখে চমকে উঠল সুকোমল। মুহূর্তে রক্তপ্রবাহ দ্বিগুণ হয়ে মাথা থেকে পায়ে আসা যাওয়া শুরু করল। আবেগ উত্তেজনা মিলেমিশে মাথায় তোলপাড় শুরু হল। নিজেকে সামলে নিয়ে দেখল ইন-এন্ড-লেটারটি। কোথাও তিল ঠাঁই নাই। সুকোমল পড়তে শুরু করল—

স্নেহের ভাই সুকোমল,


দীর্ঘকাল যাবৎ তোমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। অবশ্য যোগাযোগ না থাকার জন্য দায়ী আমি। কারণ তোমার সাথে খুব দুর্ব্যবহার করেছিলাম। যতদিন তুমি আমার কাছাকাছি ছিলে ততদিন আমার সুখে-দুঃখে, না সুখে নয় দুঃখে সর্বদাই আমার পাশে দাঁড়িয়েছ এবং যথাসাধ্য সাহায্য করেছ। কিন্তু সে সাহায্যের দাবি, অধিকার আমি আমার নিজের দোষে হারিয়েছি। আমি জানি তুমি অন্য মানুষ আর পাঁচটা সাধারণ লোকের সঙ্গে তোমার মেলানো, মূল্যায়ন করা যায় না। তাই সেই ভরসায় লিখছি।

 

বর্তমানে আমার জীবন দুর্বিষহ। অঞ্জনদার কথা তো তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই। কারণ অঞ্জনদার কারণেই তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিলাম। তা কি তুমি ভুলতে পার না ভোলা সম্ভব? সেই অঞ্জনদা আমাদের পথের ভিখিরি করে দিয়েছে।

পুরনো ক্ষতে আবার ধাক্কা। রক্ত তো বেরোবেই। বহু বছর পেরিয়ে গেছে ক্ষত উপরে শুকিয়ে গেলেও ভিতরের ঘা যেমন থাকার তেমনই ছিল আজ আবার নতুন করে বুঝতে পারল সুকোমল। ভালবাসার বাঁধনটা এমনই প্রগাঢ়, হয়তো কিছুদিন, কয়েক মাস, কয়েক বছর দূরে থাকা যায়। কিন্তু ভালবাসার অন্তরের যে টান তা কি নষ্ট হয়, না হবার জিনিস? সব ভুলে যেতে চেয়েছিল সুকোমল হয়তো ভুলে গিয়েছিল, কালের প্রভাবে অতীতের সব কথা স্মৃতিপটে ভেসে উঠল সুকোমলের এই চিঠির দৌলতে।

সুকোমলের বয়স তখন কত বড় জোর আঠেরো-কী-উনিশ বছর। হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে হোমিওপ্যাথিতে ভর্তি হয়েছে সুকোমল। বাংলা মিডিয়ামের ছাত্র আর হোমিওপ্যাথিক কোর্স সম্পূর্ণ ইংরেজিতে। ফলে ক্লাস ফলো করা খুবই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত সুকোমল। ডিকশনারির সাহায্য নিয়েও খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না এমন পরিস্থিতিতে সুকোমলেরই কলেজের লাস্ট ইয়ারের ছাত্রীর সাথে পরিচয় হল, নাম শেফালী। ক্রমশ ঘনিষ্ঠতা বাড়ল, বাড়িতে আসা যাওয়া শুরু হল। ফলে দু’জনের মধ্যে দিদি-ভাইয়ের সম্পর্কটা অল্প দিনের মধ্যেই দানা বেঁধে উঠল। শেফালী সব বইপত্র সুকোমলকে দিয়েছিল ও পড়াশোনা বুঝিয়ে দিত। ফলে সুকোমলের পড়াশোনার যে অসুবিধা হচ্ছিল সেগুলো মিটে যেতে লাগল।

শেফালীর দুই ভাই। দুই ভাই কলেজে পড়ে। শেফালীর বাবা একটি নামি ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। মাইনেপত্র ভাল। বাড়িতে কোন অভাব নেই। কেবল দুঃখ বলতে শেফালীর মা খুবই অসুস্থ থাকতেন। ক্রমাগত রোগে ভুগে ভুগে জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে গেছিলেন। শেফালীরা কোম্পানির কোয়ার্টারে থাকত। কোয়ার্টার থেকে হোমিও কলেজ মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। ফলে শেফালীর কলেজ যাতায়াত ও পড়াশুনাতে বেশ সুবিধাই ছিল।

সুকোমল সেকেন্ড ইয়ারে উঠল। আর শেফালীর ফাইনাল ইয়ার শেষ হয়ে গেল। ছ’ মাস হাউস সার্জেনশিপ করার পর ডাক্তারি সার্টিফিকেট নিয়ে কোয়ার্টারেই টুকটাক প্র্যাকটিস শুরু করল। সুকোমল সময় মতো শেফালীর কাছে প্র্যাকটিসের জ্ঞান লাভ করছিল। এইভাবে চলছিল।

সুকোমলের যখন ফাইনাল ইয়ার সেই বছর শেফালীর মা মারা যান। এমনিতেই সুকোমল শেফালীদের ঘরের লোক হয়ে গিয়েছিল, মা মারা যাবার পর পরিবারের গার্জিয়ান হয়ে উঠল। সব কিছু দেখাশোনা করা, তাদের কাপড় কেচে দেওয়া, খেতে দেওয়া এমনকি শ্রাদ্ধের জন্য বাজারহাট খরচখরচা সব সুকোমল একা হাতে সামলেছে।

শেফালীর বাবা বলতেন সুকোমল আমার গত জন্মে ছেলে ছিল। শেফালীর মা মারা যাওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই শেফালীর বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তখন ওই একই ভূমিকা ছিল সুকোমলের। শেফালীদের আত্মীয়স্বজন তেমন কিছু ছিল না। সেটা দেখেছিল শেফালীর মা মারা যাওয়ার সময়। পাশাপাশি লোকেদের নিয়ে শ্রাদ্ধশান্তি হয়েছিল‌।

শেফালীদের আদি নিবাস বসিরহাটে। সেখানে কাকা-জ্যাঠারা সবাই আছে কিন্তু কেউ কারো খোঁজ রাখে না। শ্রাদ্ধের দিন তিনেক আগে শেফালীর এক জ্যেঠতুতো দাদা এল নাম অঞ্জন। জায়ান্ট ফিগার। ভুঁড়িটিও বেশ বড়সড়, সারা গায়ে লোমে ভর্তি, কিন্তু মাথায় একটিও চুল নেই। পরচুল পরে থাকে। অঞ্জনের সাথে সুকোমলের পরিচয় হল। শেফালীর সম্পর্ক ধরে অঞ্জনকে সুকোমল অঞ্জনদা বলতে শুরু করল। কিন্তু অঞ্জনকে সুকোমলের একটুও ভাল লাগল না। কেমন যেন স্বার্থপর স্বার্থপর চেহারা। অঞ্জন আসার পরের দিনেই সুকোমল দেখল সবাই যেন কেমন বদলে বদলে গেছে শেফালী ও শেফালীর ভাইরা সুকোমলকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। কোন কাজের দায়িত্ব দেয়নি বরং যে কাজের দায়িত্বগুলো ছিল সেগুলোও অঞ্জনকে দিয়েছে। কোন ভূমিকাই থাকল না সুকোমলের।

সুকোমল এই পরিবর্তনে অবাক। এমনটা হয় কী করে? সুকোমলের ত্রুটি কী? কী তার অপরাধ? মানুষ কী করে এত সহজে সবকিছু ভুলে স্বার্থপর হয়ে যায়? সুকোমল ভাবল শেফালীরা কি অঞ্জনদাকে নির্ভরযোগ্য গার্জিয়ান ঠাওরেছে! যদি তাই হয় তাতে তো আমি কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়নি! তাহলে আমাকে এত এড়িয়ে চলার মানে কী? নিঃশব্দে এই অপমান সহ্য করা দায় হয়ে দাঁড়াল সুকোমলের।

সুকোমল বরাবরই একটু অভিমানী। ভালবাসার কাঙাল। খুব বন্ধুবান্ধব প্রিয়। এখানে শেফালী, শেফালীর ভাইদের বন্ধুদের, পরিচিতদের এত ভালবাসা পেত যে সবাই বন্ধু হয়ে উঠেছিল। সুকোমলের তাই দিনের মধ্যে ঘন্টা কয়েক এই শেফালীদের ঘরে অতিবাহিত করত। কিন্তু এ কী হল, যে ভালবাসার টানে শেফালীদের ঘরে প্রাণপাত করে দিয়ে চলেছে সেই শেফালীদি যেন চিনতেই পারছে না বড় আহত হল সুকোমল। সাথে আত্মাভিমানে ঘা লাগল।

শ্রাদ্ধশান্তি চুকে গেছে, বাড়ি খালি। দূরের আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ আসেনি যারা এসেছিল শ্রাদ্ধের পরের দিনেই চলে গেছে। কেবল অঞ্জন রয়ে গেছে।

শ্রাদ্ধের দিন দুই পরে সুকোমল শেফালীদের বাড়িতে এসে দরজায় কড়া নাড়ল। কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে পিছনের দরজার দিকে গেল। এক অদ্ভুত কায়দায় এই দরজার ছিটকিনি খোলা যায়, এটা শেফালী শিখিয়ে দিয়ে বলেছিল আমরা কেউ না থাকলে তুমি দরজা খুলে ঘরের ভিতরে বসবে। সেই মতো আজও করল। ভিতরে ঢুকে হতবাক দেখল ভিতরের ঘরে অঞ্জন রন্টি বলে একটা মেয়ের সাথে আপত্তিকর অবস্থায় শুয়ে আছে। খালি ঘর শেফালীদি ও ভাইয়েরা কেউ নেই। এই দৃশ্য দেখে সুকোমল তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল।

 

ক্রমশ

2 comments:

  1. ভালো লাগল। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete
  2. ভালো লাগলো!

    ReplyDelete

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)