ছেলেমেয়েগুলো আসে হই হই করতে করতে। স্কুলের পরে কিছু আসে আবার স্কুলের আগেও কিছু
আসে। নামী স্কুলের কাছেই ওদের বাড়িটা হওয়ায় খুব সুবিধা।
অনিকেত বেরিয়ে যায় সকাল আটটায়। তারপর থেকে সারাদিন ওর অখণ্ড অবসর। তখনই চলে আসে
ছেলেমেয়েগুলো। কলকল করে, দাপাদাপি, চেঁচামেচিতে ঘরটা ভরিয়ে দেয়। দশটার সময় সবাই
স্কুল চলে যায়। আবার এক দল ঢোকে স্কুল ছুটি হলে বিকাল পাঁচটার সময়। তাদের মায়েরাও
নিশ্চিন্ত, আন্টির কাছে ওদের টিফিন খাওয়া, অনেকের জামাপ্যাণ্ট পাল্টানো, হাত-পা ধোওয়া
ইত্যাদি ব্যাপারে। বাড়ি থেকে সবাই টিফিন আনে। তবু কে খেল, কে খেল না, কেন খেল না,
সব নজর রাখা, তাকে খাইয়ে দেওয়া বা প্রয়োজনে তার জন্য অন্য কিছু পছন্দসই বানিয়ে
দিতেও মোটেই ক্লান্তি নেই চন্দনার। এগুলো ও স্বেচ্ছায় ভালবেসেই করে। ফলে সব
মায়েরাও নিশ্চিন্ত থাকে, শুধু পড়াশোনা নয়, সন্তানের সমস্ত ব্যাপারে, একেবারে মায়ের
মতোই।
মাঝে মাঝে ক্লান্তিও লাগে। অনিকেত বলে, কী দরকার, ছেড়ে দাও না, এত চাপ নিচ্ছ কেন! চুপ
করে থাকে চন্দনা। সে আর কিছু বলতে চায় না, যদিও না বললেও সবটাই বোঝে অনিকেত। সে-ও
চুপ করেই থাকে।
ছেলেমেয়েরা এতদিন আসা-যাওয়ার ফলে গোটা বাড়িটাই নিজেদের বাড়ির মতো ব্যবহার করে, কোন
বাধা তো নেই ঘরে কোথাও। নিজেদের মা’কেই ওরা খুঁজে পায় চন্দনার মধ্যে। নিজেদের
মধ্যে চেঁচামেচি, হুড়োহুড়ি, ভাব, গল্প সব চলে। বাড়ি একেবারে জমজমাট। আনন্দই পায়
চন্দনা। মনটা ওর ভরে যায়। যেদিন কেউ না আসে, ওর কেমন যেন শূন্যতায় ভরে যায় মন।
একটা ছাত্র নতুন ভর্তি হল সেদিন। ছেলেটা একটু অন্য রকম। খুব স্বার্থপর, ঝগড়াটে। কথায়
কথায় খারাপ কথা বলে বন্ধুদের। অন্য সবার সঙ্গে যেন ঠিক খাপ খায় না।
চন্দনা জানে, বাচ্ছারা এক-এক জন এক-এক রকম হয়। ও ভাল ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে। গল্প
বলে, কখনও মিষ্টি কী কোন ভাল লজেন্স দেয়, যাতে ওকে সংশোধন করা যায়।
একদিন চন্দনা, কোন ছাত্রের জন্য কিছু একটা খাবার করতে ভিতরে গেছে রান্নাঘরে। শুনতে
পেল ভিতর থেকে সেই নতুন ছেলেটি, খুব খারাপ কিছু গালাগাল দিচ্ছে অন্য একটি ছেলেকে। হাতাহাতি,
কান্নাকাটির শব্দও পেল।
চন্দনার হঠাৎ খুব রাগ
হয়ে গেল, এত বলে বুঝিয়েও ওকে ঠিক করতে পারছে না। এর আগে ওর মা’কেও কয়েকবার
ব্যাপারটা আড়ালে বলেছে। কিন্তু উনি ছেলের কোন দোষই মানতে রাজি নন।
হঠাৎ এই ব্যাপারে প্রচণ্ড রাগ হওয়াতে, বেরিয়ে এসে দেখল, সেই ছেলেটি আর একটি ছেলের
বুকের উপর বসে মারছে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল ওর। ও জোর করে ছেলেটিকে ছাড়িয়ে এনে
অল্প একটি চড় মেরে ওকে বকল। এরকম করা যে উচিত নয়, বোঝানোর চেষ্টা করল। ছেলেটি আরও
জোরে কান্নাকাটি শুরু করল।
পর দিন বিকালে ছেলেটির মা এসে বাড়িতে বেশ জোরে জোরে কয়েকবার কলিং-বেল বাজিয়ে
চন্দনাকে ডাকল। তখন অনিকেত নেই। ছাত্ররাও কেউ ছিল না। ভদ্রমহিলা এসেই, চন্দনাকে
যাচ্ছেতাই বলে অভদ্রের মতো উচ্চগ্রামে, তার ছেলেকে বকা-মারার জন্য অভিযোগ করে
কৈফিয়ত তলব করল। চন্দনা চেষ্টা করল অবস্থা-পরিস্থিতি সাম্য ভাবে বোঝাতে। ছেলেদের
তৈরি করতে গেলে যে ভালবাসার সঙ্গে কখনও কখনও শাসনও প্রয়োজন তা বোঝাতে গেল। কিন্তু
মহিলা কিছুই শুনতে রাজি নয়, শেষে হঠাৎ ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বলে বসল, ‘নিজের
ছেলেমেয়ে তো নেই, কী করে আর বুঝবেন ছেলেমেয়ের মর্ম–’
কথাটা চন্দনার বহু দিনের সযত্নে গোপন করা ক্ষতস্থানে এসে একেবারে সজোরে বিষাক্ত
তিরের মতো আঘাত করে হৃদপিণ্ড যেন ছিন্নভিন্ন করে দিল।
ও কোন রকমে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মাথাটা ঘুরে গিয়ে চোখটা কেমন অন্ধকার হয়ে
গেল।
অনেকক্ষণ বালিশটাকে
জোরে আঁকড়ে ধরে শুয়ে রইল ও। সেটা ধীরে ধীরে ভিজতে লাগল।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment