বাতায়ন/গদ্য/১ম বর্ষ/১৭তম সংখ্যা/৮ই ভাদ্র,
১৪৩০
গদ্য
উপেক্ষিৎ শর্মা
অন্যরকম [১]
নাম
ভিড় মেট্রোয় উঠতে গিয়ে সামনের
ভদ্রলোককে, ‘দাদা একটু সরে দাঁড়াবেন’, বলতেই তিনি বেশ হেয় তাচ্ছিল্যের সুরে হেঁকে
উঠলেন,
-কে হে তুমি, তোমার জন্যে পথ মুক্ত করে দাঁড়িয়ে
থাকতে হবে?
-কে আবার, আমি, আমি।
-আমি মানে? আমিটা কে? আবার ঝাঁঝিয়ে উঠলেন দাদা।
বললুম,
-আমি মানে আমি। আমার আমিত্বে আপনার কোন সন্দেহ
আছে? এবার আমার দিকে সোজা তাকিয়ে দেখলেন, যাকে বলে আগাপাশতলা। তির্যক স্বরে বললেন,
-বলি নাম-ধাম কিছু আছে তো, নাকি? উত্তরে
কমলাকান্তের মতো বলতে পারতাম, আছে বইকি! নাম হচ্ছে মানুষ, অমানুষও বলতে পারেন; আর
ধাম হচ্ছে এই ধরা, যাকে আমরা সরা জ্ঞানে ভুলতে বসেছি যে এটা আমাদের নিতান্ত অধরাই
থেকে গেল। যা হোক লোভ সংবরণ করে বললুম,
-আমার নাম চক্রমিতা চক্রবর্তী
চক্রবর্তী। ধাম দমদম। এই নামটা শুনে সাধারণ ভাবে সকলেই যেমন ভ্রূ কুঁচকে তাকায় ঠিক সেই ভাবে
কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে সরস ভঙ্গিতে বললেন,
-বাব্বা, নামের মধ্যে বেশ পান (pun) আছে তো! তা তোমার চক্রবর্তীটা দ্বিত হল কেন?
-কেন আবার, আমার মায়ের নাম পারমিতা চক্রবর্তী
আর বাবার নাম চক্রধর চক্রবর্তী, দুজনের নামের আদ্য অংশ নিয়ে চক্রমিতা আর যেহেতু কেউই
নিজের পদবি ছাড়তে রাজি নয়, তাই, চক্রবর্তী চক্রবর্তী...
কী, এবার বোঝা গেল?
-ও, তাহলে তোমার বাবা-মা তোমার মধ্যে দিয়ে
স্ত্রী-পুরুষের সমানাধিকারের সাংবিধানিক অধিকারবিধি প্রয়োগ করেছেন! বাহ্! বেশ,
বেশ! কিন্তু...
-আপনি কিন্তু এখনও আমায় ভেতরে যাবার জায়গা
দেননি। সেই অধিকারটুকু পেতে
পারি কী?
-ও, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এসো, এসো... আসলে তোমার
চক্রব্যূহে এমন ভাবে আটকে পড়েছিলাম...
-চক্রব্যূহে নয়, বলুন চক্রাবর্তে। বললুম বটে, কিন্তু আসলে নিজেই পুরুষের
চক্রাবর্তে আটকে পড়লুম। চারিদিকে সোঁদা নিঃশ্বাস আর আদিম পৌরুষের ধকল সামলিয়ে নিজেকে স্থিতু করলুম
যেখানে সেখানে আরেক গায়ে পড়া দাদা বললেন,
-আপনাদের কথা শুনে আমার একটা প্রশ্ন মনে এল,
কিছু যদি মনে না করেন,
-নির্দ্বিধায় বলে ফেলতে পারেন
-আচ্ছা, এরপর আপনার ছেলেমেয়েদের নাম কী হবে?
-কেন, আমার ছেলের নামই তো জয়দ্রথ ত্রিচক্র।
আমারও হাজব্যাণ্ড চক্রবর্তী, তাই, তিন বার ‘চক্রবর্তী’, সংক্ষেপে ত্রিচক্র। আর যদি আমার হাজব্যাণ্ডের চক্রবর্তী পদবি না
হয়ে অন্য কোন পদবি হত, মানে ঘোষ, বোস, মিত্র, তাহলে ছেলেরটা এভাবে বলা যেত, ‘চক্রবর্তী
চক্রবর্তী ঘোষ’ বা ‘চক্রবর্তী চক্রবর্তী মিত্র’, এই রকম আর কী! একটু ছোট করে
‘দ্বিচক্র বোস’ হলেও চলতে পারে। হাত খানেক দূরে দু’জন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে
শুনতে পাচ্ছি,
-আচ্ছা ধর, ওই ভদ্রমহিলার হাজব্যাণ্ডের টাইটেল
চ্যাটার্জ্জী চ্যাটার্জ্জী, তাহলে ওর ছেলের নাম কী হবে?
-কী আবার, জয়দ্রথ দ্বিচক্র দ্বিচ্যাট, হা হা
হাঃ! এই হাসির মধ্যে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ বিদ্বেষ ছাড়াও আশপাশ জুড়ে একটা স্থূল
অশ্লীলতার দুর্গন্ধ চারিয়ে গেল। ঘাড় উঁচু করে দেখতে চাইলাম এদের মুখগুলো। বলতে
ইচ্ছে করল, তা আপনাদের এত চ্যাটচ্যাটানি কীসের? তখনই ভেসে এল আরেকটা কথোপকথন,
-নামে কী এসে যায় রে? নাম তো শুধু ডাকের জন্যে।
-না, না, ঠিক বললি না। নাম শুধু ডাকের জন্যে
নয়, নামডাকের জন্যেও।
-মানে?
-মানে, তোকে যদি স্টিফেন হকিং বলে ডাকি,
স্টিফেন হকিং-এর যে নামডাক তা তোর সাথে মানাবে?
-হুঁ! ও ফিজিক্সের ‘পি’ জানে? স্টিফেন হকিং! নামতে
নামতে অদ্ভুত একটা ব্যক্রোক্তি করে ওদের অন্য এক সঙ্গী নেমে গেল নিজ গন্তব্যে।
আলোচনাটা শুনতে শুনতে মনে হল, সত্যিই তো, নাম তো শুধু ডাকের জন্যে নয়, নামডাকের জন্যেও। কথাটা মন্দ বলেনি। আমার নামটা তো শুধু ডাকের জন্যে, নামডাকের জন্যে তো নয়। তাহলে আর এত চক্রব্যূহই বা কেন আর এত চ্যাটচ্যাটানিই বা কীসের? এবার থেকে আমার নাম চক্রমিতা, শুধুই চক্রমিতা।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment