প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

রং | প্রতিজ্ঞা

  বাতায়ন/ রং /সম্পাদকীয়/২য় বর্ষ/ ৩ ২তম সংখ্যা/ ২৯শে ফাল্গুন ,   ১৪৩১ রং | সম্পাদকীয়   প্রতিজ্ঞা "নির্ভীক একটি ফুলের মতো মেয়েকে চরম লাল...

Saturday, September 23, 2023

কবিতা পাঠ | শংকর ব্রহ্ম

বাতায়ন/অন্য চোখে/১ম বর্ষ/২০তম সংখ্যা/৫ই আশ্বিন, ১৪৩০

অন্য চোখে
শংকর ব্রহ্ম

কবিতা পাঠ

               

বিশেষ প্রকারের আনন্দ দেওয়াই কবিতার প্রধান কাজ। কবিতা পাঠের আনন্দ আর অন্য পাঁচ রকমের আনন্দ থেকে আলাদা, বুঝতে হবে। আর তা না হলে, সাধারণ আমোদ-প্রমোদ বা কবিতা পড়ার আনন্দের মধ্যে কোন তফাৎ থাকে না।

কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ কবিতা পাঠের আনন্দের মধ্য দিয়েই তার লক্ষণ বিচার করেছেন। তবে তারা কবিতা পাঠের আনন্দকে অন্যান্য আনন্দ থেকে আলাদা করে দেখাননি। ফলে, সমালোচনার হাত থেকে তারা রেহাই পাননি।

টলস্টয়ের মতে, "কবিতার কাজ যদি শুধু আনন্দ দানই হয়, তবে তাকে নৈতিকতার দিক থেকে কোন গৌরবের বস্তু মনে হয় না। কিংবা ট্রাজেডি যে ধরণের আনন্দ আমাদের দেয়, তাকে তো সাধারণ অর্থে আনন্দ বলা যায় না। পরের দুঃখে আনন্দ পাওয়া কোন গৌরবের বস্তু নয়।"

এই বিপর্যয় এড়াবার জন্য, গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্‌ল বললেন, ট্রাজেডিতে এক ধরণের বিশেষ আনন্দ আছে। কিন্তু সেই বিশেষ আনন্দ কী, তা আবার তিনি ব্যাখ্যা করেননি। দার্শনিক কান্টও, এই বিশেষ আনন্দের দ্বারা কাব্যর লক্ষণ বিচার করেছেন। সে আনন্দ-ইন্দ্রিয়জনিত সুখ, জ্ঞান ভিত্তিক কিংবা নীতি মূলক আনন্দ হতে পারে। সুতরাং কবিতা আমরা পড়ি, তা থেকে বিশেষ ধরণের আনন্দ পাই বলেই। কবি লংগাহনাস, কবিতা পাঠে,

"তূরীয় আনন্দের" কথা বলেছেন। আলংকারিক অভিনবগুপ্ত এই আনন্দকে 'অলৌকিক চমৎকার' বলেছেন। অন্য ভারতীয় আলংকারিকরা এই আনন্দকে, 'ব্রহ্ম স্বাদ সহোদরা' আখ্যা দিয়েছেন। এর দ্বারা মনন তৃপ্ত হয়। আর এই অলৌকিক আনন্দ সৃষ্টি করেন কবিরা, ভাষার মাধ্যমে। এই জন্যই বোধহয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিদের বলেছেন "ভাষার জাদুকর"।

কবি কবিতায় শুধু শব্দের অর্থ জ্ঞাপনের কাজটি করে সন্তুষ্ট হতে পারেন না, তিনি শব্দের ধ্বনির সাহায্য নেন তার ভাব প্রকাশের জন্য, কবিতায় চমৎকারিত্ব সৃষ্টির জন্য। এ তো গেল, কবিতায় আনন্দ দানের দিকটির কথা। অন্যদিকে, কবি কিট্‌স কবিকে 'সত্য ও সুন্দরের' পূজারী বলে আখ্যা দিয়েছেন। ররীন্দনাথেরও এ' মতে সায় ছিল।

গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্‌ল কবিকে বলেছেন "সমাজের জাগ্রত প্রহরী"। অথচ তার গুরু সক্রেটিস বলেছেন, সমাজে কবির কোন ভূমিকাই নেই। সে সমাজে অপাঙ্‌ক্তেয়। সমাজে তার কোন দরকার নেই। সমাজ থেকে তাকে বহিষ্কার করা উচিৎ। অথচ ভারতীয় ঋষিরা কবিকে এমন উচ্চ মর্যাদায় স্থান দিয়েছিলেন যে তারা মনে করতেন, "কবিতা পাঠে ঈশ্বর প্রাপ্তির স্বাদ অনুভব যায়।" কবিতা পাঠে সত্য ও সৌন্দর্যের উপলব্ধিতে, যে আনন্দ পাওয়া যায় সে আনন্দ বিশেষ ধরণের আনন্দ, সাধারণ বা লৌকিক আনন্দ থেকে তা পৃথক, তা হল জ্ঞান উপলব্ধির আনন্দ।

ফরাসি কবি মালার্মে বলেছেন, কবি নিজের সাথে কথা বলে, আমরা পাঠকরা তা আড়ি পেতে শুনে, মজা বা আনন্দ পাই, আর তাই বলেই তা শুনি। কবির কাজ নয় তা শোনানো। কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন, কবিরা যখন ভাবাক্রান্ত হন তখন কবিতা লেখেন, আবার কবি বিষ্ণু দে বলেন, 'সংবাদ মূলত কাব্য’।

ধ্বনিকার আনন্দবর্ধন মনে করেন, কবিতায় শব্দ এমন ভাবে ব্যবহার করা হয় যে তাদের বাচ্যার্থের মধ্য দিয়ে এবং তাকে ছাড়িয়ে একটি ব্যঞ্জনার্থ প্রকাশিত হয়, যা কাব্যের প্রধান অর্থ হয়ে চিত্তকে দোলা দিয়ে যায়, একটা চমৎকারিত্বের আস্বাদ দেয়। শরীরের লাবণ্য যেমন, শরীরের ভিতরেই প্রকাশিত হয়েও তা শরীর অতিক্রম করে একটি স্বতন্ত্র ভাববস্তু রূপে প্রতিভাত হয়, কাব্যের ধ্বনি সেই ভাবেই কবিতায় উপস্থিত হয়। ভাবকে রসে উন্নীত করতে হলে, শব্দের বাচ্যার্থের চেয়ে, তাদের ব্যঞ্জনার্থের বেশি সাহায্য নিতে হয় তবুও এই রসই সেই কাব্যানন্দের স্বরূপ।

এত সব বিবেচনা করে অবশ্য কোন পাঠকই কবিতা পড়েন না। যারা কবিতা পড়েন তারা কবিতা পড়ে কিছু পান বলেই কবিতা পড়ে থাকেন বলে আমার বিশ্বাস।

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)