প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

রং | প্রতিজ্ঞা

  বাতায়ন/ রং /সম্পাদকীয়/২য় বর্ষ/ ৩ ২তম সংখ্যা/ ২৯শে ফাল্গুন ,   ১৪৩১ রং | সম্পাদকীয়   প্রতিজ্ঞা "নির্ভীক একটি ফুলের মতো মেয়েকে চরম লাল...

Saturday, September 23, 2023

গহনার পুতুল | সীমা ব্যানার্জী-রায়

বাতায়ন/ধারাবাহিক/১ম বর্ষ/২০তম সংখ্যা/৫ই আশ্বিন, ১৪৩০

ধারাবাহিক গল্প
সীমা ব্যানার্জী-রায়

গহনার পুতুল
[২য় পর্ব]

 

পূর্বানুবৃত্তি বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে নিনার বিয়ে হয় বাড়ির কাছাকাছি পার্থর সঙ্গে। সামাজিক রীতি মেনে নিনাকে গা ভরতি গহনায় সাজিয়ে দেন তার বাবা-মা। শ্বশুরবাড়িতে কোন কাজই করতে দেন না শাশুড়ি, এমনকি পার্থর অফিস যাওয়া এবং ফেরার সময়ও তিনি নিজে হাতেই পার্থকে খেতে দেন। রাত্রে পার্থ বাবা-মা’র সঙ্গে গল্প করে যখন ঘুমোতে আসে ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ে নিনা। তারপর…

এদিকে নিনা এবং পার্থ বুঝতে পারছিল যে, ওদের বিয়ে ওদের প্রয়োজনের জন্য হয়নি। পার্থ নিনার কাছে যেন একটা পুরুষ মাত্র। সে যখন নিনার কাছে আসে। তাকে দেখেই নিনার কচি-কোমল মুখ বিষাদে কালো হয়ে ওঠে। পার্থ অসহায় বোধ করতে লাগে! বৌয়ের বিষণ্ণ মুখ, মায়ের সতর্ক দৃষ্টি সবকিছু তাকে অসহ্য করে তুলল। ফলে পার্থ সময় মতো ঘরে ফেরার উৎসাহই হারিয়ে ফেলল। নতুন বিয়ে করায় ঘরে তাড়াতাড়ি ফেরার যে একটা ইচ্ছা ছিল, সেটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হতে লাগল রোজ দিন। এটাই তাহলে সবল অনুমান যে, পার্থ নিনাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছিল।

যে কাজগুলো ঘরে নিয়ে আসা যেতে পারত অথবা সেক্রেটারিকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারত। সে কাজগুলোও পার্থ অফিসে বসেই করতে লাগল। যদিও ওর সেক্রেটারি ওকে সাহায্য করার জন্য সর্বদা মুখিয়ে থাকত।

 

পার্থর সেক্রেটারি প্রিয়া খুবই আকর্ষনীয়া, বুদ্ধিমতী, ডিভোর্সি। এখন কাজের ফাঁকে ফাঁকে পার্থর আনমনা মুখ লক্ষ্য করে। খারাপ লাগে কি তার?

 

পার্থ জানলা দিয়ে একটু বাইরে তাকিয়ে দেখল দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। অথবা কলকাতার কোনও প্রান্তে। বাতাসে মৃদু হিমের স্পর্শ। এক ঝলক স্নিগ্ধ অনুভব। ক'দিন ধরেই একটা গুমোট অবস্থা চলছিল। আকাশে মেঘের ধূসর আস্তরণ। তবি বৃষ্টি হচ্ছে না। মেঘের আস্তরণে তেজি রোদ যেন আরও অসহনীয় হয়ে উঠেছিল।

 

যাক, এখানে না হোক, তবু কোথাও তো বৃষ্টি নেমেছে। ঠান্ডা বাতাস বুক ভরে টেনে নিল। বহুকাল চেয়ে রাখা একটু দীর্ঘশ্বাস বেরুবার আর পথ পায় না। আঁকুপাঁকু করে মনের ভিতর। এ তো আর অভিমান নয়, এও তো এক পিপাসা।

 

সেদিন ছিল শনিবারের বিকেল। অফিস থেকে একে একে সবাই বাড়ি চলে গেল। পার্থ নিজের অফিসে বসে আছে। ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। পার্থ বলল, 'কাম ইন!' প্রিয়া ট্রেতে চা এবং খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল। পার্থর নজর পড়ল, প্রিয়া আজ বেশ সেজে এসেছে। জিজ্ঞেস করল, ‘আজ কোথাও পার্টি আছে নাকি, প্রিয়া?’ প্রিয়ার মুখ লাল হয়ে উঠল, 'না স্যার, এমনিই। জীবনে তো কিছু পাইনি, তাই ইচ্ছে হলেই সাজি।' তারপর গলা নামিয়ে বলল, 'আজ শনিবার, সবাই চলে গেছেন, আপনি এখনও কাজ করছেন, স্যার?' পার্থ একটু ব্যস্ত হয়ে, 'হ্যাঁ, তা ঠিক,' বলে হঠাৎ আনমনা হয়ে গেল। প্রিয়া আবার জিজ্ঞেস করল, 'আপনার স্ত্রী নিশ্চয়ই আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।' পার্থ মিথ্যে করে বলল, 'উনি বাপের বাড়ি গেছেন। আর সব কাজ তো বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যায় না?'

প্রিয়ার বুঝতে অসুবিধা হল না যে কোথাও কালো মেঘ জমে আছে। প্রিয়া মুখ নীচে করে বলল, 'আমি এবার যাই স্যার?' পার্থ ওর মুখের দিকে চেয়ে এক মুহূর্তের জন্য ভাবল, প্রিয়া সুন্দরী, শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী, তবু ওর বিয়ে টিকল না কেন? প্রিয়া ওর অনুমতির জন্য অপেক্ষা করছে দেখে ভারী গলায় বলল, 'আপনি কি আর কিছুক্ষণ থাকতে পারেন না? আপনার পথ চেয়ে তো কেউ বসে নেই ঘরে। অবশ্য এটা আপনার ব্যাপার।' প্রিয়া খুশি মনেই রাজি হল।

 

তারপর থেকে পার্থর ঘরে ফিরতে বেশ রাত হতে লাগল। নিনার জন্য পার্থর কষ্ট হত খুব। কিন্তু ও তো ভাল করেই জানে, ঘরে ফিরে ছোট ছেলের মতোই চলতে হবে। আর নিনার অপ্রসন্ন ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ওকে বিদ্ধ করতে থাকবে। সে যে কেন নিনার জন্য কিছু করতে পারছে না, তাও বুঝতে পারছে না।

 

পার্থর দেরি করে ঘরে ফেরার জন্য অনন্যাদেবী নিনার বিরুদ্ধেই অভিযোগ করতে লাগলেন, 'বাব্বা! কী এক বিষাদের প্রতিমা ঘরে এনেছি, ছেলে আমার ওর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমার ছেলে অসুখে না পড়ে যায়। কী জ্বালা হল বিয়ে দিয়ে।'

 

মানসিক অত্যাচার দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল, তাই নিনা আর শ্বশুরবাড়িতে থাকা যুক্তিযুক্ত মনে করল না। সেও অশিক্ষিতা নয়। বাবা-মা’কে সব কথা খুলে বলল। প্রবালবাবু-রূপাদেবী মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে অস্থির হয়ে উঠলেন। মেয়ে-জামাইকে একসাথে ওনাদের বাড়িতে আসার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। নিনার সঙ্গে পার্থ এল না! এল নিনা একা। নিনাকে একা আসতে দেখে ওনাদের মনে কু আসতে লাগল। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে নিনাকে ওর বাবা-মা আর শ্বশুরবাড়ি পাঠানো যুক্তিসংগত মনে করলেন না।

 

পার্থ রোজ নিনাকে ফোন করে অফিস থেকে। দু-চার কথার পর বলে, 'আমি এখন খুব ব্যস্ত, তুমি বাড়িতে ফোন কোরো।' নিনা ফোন করে কখনই পার্থকে পায় না। অনন্যাদেবী বলেন, 'পার্থ এখনও ফেরেনি, বাড়ি এলে বলব।' নিনা পার্থকে চিঠি লেখে, সে চিঠি পার্থর হাতে পৌঁছায় না। এভাবে নিজেদের অজান্তেই দু’জন দু’জনের মন থেকে সরে যেতে লাগল।

 

একদিকে পার্থ নিনাকে আনতে যাচ্ছে না বলে নিনা অভিমানে চোখের জল ফেলে অপেক্ষা করতে লাগল নিনা। অন্যদিকে নিনা বাপের বাড়ি থেকে আসছে না বলে নিনার ওপর পার্থর অভিমান বাড়তে লাগল। নিনার ওপর পার্থর যতই অভিমান বাড়তে লাগল ততই সে প্রিয়ার প্রতি আকর্ষণ বেশি করে অনুভব করতে লাগল। ফলে আস্তে আস্তে ওদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে শুরু হল। প্রিয়ার বাবা-মা ব্যাপারটা জানতে পেরে খুশিই হলেন কারণ ওদের আরো দুটি মেয়ে অবিবাহিত, তার ওপর প্রিয়া ডিভোর্সি! এইসব ভেবে তারা পার্থকে প্রায়ই বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে লাগলেন। এবং যে স্ত্রী বাপের বাড়ি থেকে আসছে না, তার জন্য অযথা অপেক্ষা না করে, তাকে ডিভোর্স করে প্রিয়াকে বিয়ে করার জন্য উৎসাহ যোগাতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তারা সে প্রস্তাব নিয়ে অনন্যাদেবীর কাছেও এসে হাজির হলেন। ছ মাস হয়ে গেল নিনা বাপের বাড়ি গিয়ে আর ফিরে আসেনি। নিনার বাবা-মায়ের ব্যবহারে অনন্যাদেবী ক্ষিপ্ত তখন। ওঁর মনে তখন প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিতে তার একটুও দেরি হল না। ছ মাস হয়ে গেছে। আরও ছ মাস অপেক্ষা করে পার্থ নিনাকে ডিভোর্স করে আবার বিয়ে করবে। আবার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। এবার পাত্রী চাকুরিরতা। ঘরবাড়ি দামী দামী জিনিসে ভরে উঠবে। পার্থ-নিনার পরস্পরের অভিমানের চরম ফল ফলল— ওদের ডিভোর্স হয়ে গেল। পার্থ প্রিয়াকে বিয়ে করল। অনন্যাদেবীর আহ্লাদের সীমা নেই। দারুণ প্রতিশোধ নিতে পেরেছেন নিনা এবং ওর বাবা-মায়ের ওপর! পার্থর মনে শান্তি নেই- কাজটা কী ঠিক হল? নিনার সরলতায় ভরা মুখটা বার বার মনে পড়তে লাগল। সে যে খুব ভালবেসে ফেলেছিল সহজ সরল মেয়েটাকে।

 

ক্রমশ

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)