বাতায়ন/গদ্য/১ম বর্ষ/২৩তম সংখ্যা/১০ই কার্তিক, ১৪৩০
গদ্য
উপেক্ষিৎ শর্মা
অন্যরকম [৩]
মানবিক মুখ
বুকটা ধড়াস ধস করে ওঠানামা করছে। মুখ দিয়ে ভুসভুস করে নিঃশ্বাস পড়ছে যেন পঁচিশ বছরের পুরনো গাড়ির এক্সহস্ট। হবেনাই বা কেন? এদিকের এস্কালেটর অচল। মেট্রো স্টেশনের বাহান্ন ধাপের সিঁড়ি উঠতে উঠতে খান ত্রিশেক মাত্র উঠেছি। হৃদযন্ত্রের দুর্বলতাকে মান্যতা দিয়ে এখন একটু হাঁপ নিচ্ছি চড়াইয়ের অর্ধেক পথে। অফিস টাইম। সিঁড়ি দিয়েই ওঠানামা করছে অগণিত যাত্রী। যে যার মতো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে আমাকে। ওদের দেখে হিংসে হচ্ছে আমার। ওদের স্বাচ্ছন্দ্য, ওদের সুস্থতা, ওদের অন্যের প্রতি উদাসীনতা, ওদের স্বার্থপরতা দেখে। এও আমার এক ধরণের হীনম্মন্যতা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপ সামলাচ্ছি আর...
আর ওই যে নির্মেদ যুবতী তন্বী, টাইট জিন্স, সতেল শরীরে চেপে বসা হালকা সবুজ আঁটো টপ মেয়েটা সবল পদক্ষেপে সিঁড়ি ভাঙছে, ওকে লক্ষ্য না করে পারছিলাম না। হাঁপ নিতে নিতে আনমনে ওর হিলিহিলে শরীরের ছন্দবদ্ধ ওঠানামা পরখ করছিলাম। হঠাৎ মনে হল ও, কেন যেন, আমাকে নিশানা করে আমার দিকেই সরে সরে আসছে। হ্যাঁ, আমার কাছে আসছে। একদম কাছে। মনে মনে আড়ষ্ট হয়ে পড়ছি। ততক্ষণে আমার মুখোমুখি এসে থমকে দাঁড়াল। আমার দিকে সোজা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্পষ্ট মোলায়েম স্বরে বেজে উঠল,
— কোনও কষ্ট হচ্ছে, আঙ্কল?
কেমন যেন হতচকিত হয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললাম,
— হ্যাঁ, ওই আর কী! একটু হার্টের ব্যামো...
— চলুন, আমি হেল্প করে দিচ্ছি
বলে খপ্ করে আমার কব্জিটা চেপে ধরল। ওর দ্বিধাহীন পেলব কোমল হাতের স্পর্শে আবিষ্ট আমি মুহূর্তে কেমন এক পরম নির্ভরতার আশ্বাস পেলাম। ওর সাহায্যের বদান্যতায় আর মানবিক সৌরভে মনে সাহস পেলাম। ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠতে লাগলাম। তন্বীর অকৃত্রিম সাহচর্যে বাকি চড়াইটা পার হয়ে যখন একটু স্থিতু হয়ে ওকে ধন্যবাদ জানাতে যাব ঠিক তার আগেই,
— চলি আঙ্কল। এখন কোন অসুবিধে নেই তো?
বলে আমার হাত ছেড়ে নিজ গন্তব্যের দিকে পা বাড়াল। চকিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বোধগম্য হওয়ার আগেই ওর হনহন করে চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখতে দেখতে মন ভরে ওকে পরখ করতে লাগলাম। পুজো শেষে শান্তিজলের মতো এইটুকু আকাঙ্খিত সাহায্যের হাত ইদানিং এতই মহার্ঘ্য হয়ে উঠেছে যে এটাকে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ওকে নিজের মেয়ের মতো বুকে টেনে নিয়ে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করি। ও চলে গেল। আমার ভেতরে জমে থাকা সমস্ত শুভাকাঙ্খা ওর ওপর বর্ষিত হতে থাকল। আর মনে মনে প্রার্থনা করলাম, আমার কন্যাও যেন এরকম সংবেদী হয়। ঠিক এরকম।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment