বাতায়ন/ধারাবাহিক/১ম
বর্ষ/২৫তম সংখ্যা/১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩০
ধারাবাহিক গল্প
সুনীল কুমার হালদার
প্রথম উষ্ণতা
১ম পর্ব
১৯৭৩ সাল, আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গেছে,
ফল প্রকাশের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা ছাড়া হাতে আর কোনো কাজ নেই।
আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা, শিক্ষকগণের আশা, পরীক্ষায় আমি অসাধারণ ফল করব।
কিছু কিছু শিক্ষকের এমনও ধারণা যে আমার মতো ভাল ছাত্র স্কুলে বহু বছর আসেনি। অবশ্য
১৯৭১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় স্টার ও জাতীয় বৃত্তি পেয়ে নাথদা স্কুলের নাম
উজ্জ্বল করে গেছেন আর সেই সাথে শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের মনে অনেক আশাও সৃষ্টি করে
গেছেন।
নাথদা’র সম্মানে
হেডস্যার একদিনের ছুটি ঘোষণা করেছিলেন, আমি তখন জানালার ধারে বসে পড়ছিলুম। যখন
স্কুলের ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে এই ছুটির বিষয়ে বলাবলি করতে করতে ঘরে ফিরছিল,
কথাগুলো আমার কানে এসে একটা জেদ সৃষ্টি করেছিল, নাথদা পারলে আমাকেও পারতেই হবে, ভাল
ছেলে তকমা আমার ক্লাস সিক্স থেকে, তার সম্মান তো রাখতেই হবে, এমনই ভাবনা মনে গেঁথে
গিয়েছিল।
ভাল ছেলে তকমা ছাড়া একজন কিশোরের জীবনে আরো কত কিছু থাকে, যেমন খেলাধুলো করা,
গানবাজনা, নাটক-অভিনয় ইত্যাদি করা, কিন্তু এগুলোর কোনোটাই আমার মধ্যে স্ফুরিত
হয়নি, বিকশিত হবার সুযোগ পায়নি। একেবারে বালক বয়সে, যখন আমার মধ্যে ভাল ছেলে হবার
কোনো লক্ষণগুলো ফুটে ওঠেনি, তখন আমি ছিলুম একেবারে একা, নির্বান্ধব, নির্জনতার
অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত অবহেলিত বালক মাত্র, অস্তিত্বের কোনো প্রকাশ ছিল না। সেই পাঁচ
বছর বয়সে নিজের মা-বাবা-ভাই-বোনদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাসিমার সংসারে উড়ে এসে
জুড়ে বসেছি। মাসিমার দশজনের সংসার, কোনো এক বিকেলে, সেই সংসার সমুদ্রে আমাকে হঠাৎই
নিক্ষেপ করা হয়েছিল। মাসিমার বাড়ির পিছনে পালেদের জঙ্গলে পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের
আলো। একটু একটু করে নিভে যাচ্ছিল, অন্ধকার নেমে আসছিল চারিদিকে, জঙ্গলের অন্ধকারে
জোনাকিরা জ্বলে উঠছিল, জঙ্গলের মাথায় একটা একটা করে তারা ফুটে উঠছিল, জোনাকি আর
তারাদের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ দিয়ে তখন জল গড়াচ্ছিল। তারারা সব অবাক চোখে মিটিমিটি
করে তাকিয়ে ছিল পাঁচ বছরের এক বালকের দিকে, বিহ্বলতায় আকুল হয়ে তাদেরও চোখ থেকে জল
ঝরছিল, এক সান্ধ্য আর্দ্রতা নেমে আসছিল আকাশ থেকে, হালকা হিমেল হওয়ায় ভর করে।
যাঁরা সমস্ত খুইয়ে ওপার বাংলা থেকে এক কাপড়ে এপার বাংলায় আশ্রয় নিতে বাধ্য
হয়েছিলেন, ছিন্নমূল শব্দটায় তাঁরা সাবলীল, কিন্তু পাঁচ বছরের এক অবুঝ শিশুকে, যখন
তার বুকের দুধ খাবার বয়স চলে যায়নি, যখন তার মা ছাড়া অন্য কাউকে চেনার বয়স হয়নি,
যখন তার মায়ের কোল ছাড়া আর কোথাও মুখ লুকোবার জায়গা তৈরি হয়নি, যখন তার মায়ের
শাড়ির আঁচলের গন্ধ ছাড়া অন্য কোনো গন্ধের সাথে পরিচয় হয়নি, তাকে মায়ের বুক থেকে
টেনে হিঁচড়ে অন্য এক সংসারে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এই জবরদস্তির, এই অপরাধের, এই
অমানবিকতার কী নাম দেওয়া যাবে? তার নাম ছিন্নমূল দেওয়া যাবে কি, না তার থেকে
কঠোরতর কোনো শব্দ অভিধানে সৃষ্টি করতে হবে।
কিন্তু সময় জীবনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ভাসতে ভাসতে আমি যত বড় হতে লাগলুম, ততই
সংসারের কাজের দায়িত্ব আমার উপরে আসতে লাগল, মেসোমশাইয়ের অসুস্থতার সময় আমি
প্রায় কর্তা ব্যক্তি হয়ে উঠলুম। ১৯৭২ সালের গোড়ায় মেসোমশাইয়ের গলায় একটা টিউমার
ধরা পড়ে। মনে আছে, এর আগে, প্রায়ই তিনি টনসিলের অসুখে ভুগতেন, গার্গল করতেন, তাতে
কাজ না হলে গ্রামের ভেনা ডাক্তার ওষুধ লিখে দিতেন। সরারহাটে দাসেদের ওষুধের দোকান
থেকে একটা ছোট শিশিতে করে সেই লাল রঙের ওষুধ আমিই কিনে আনতুম। এক বিঘত লম্বা ঝাঁটা
কাঠির আগে একটু তুলো জড়িয়ে সেই তুলোর মুন্ডি লাল ওষুধে ডুবিয়ে আয়নার সামনে মেসোমশাই
হাঁ করে টনসিলে লাগাতেন। সঙ্গে সঙ্গে গলা থেকে গড়গড়ে লালা বেরিয়ে আসত, সারা উঠোন
লালায় ভেসে যেত। বড়ো হয়ে মনে হয়েছে, ক্যানসারের সাথে টিউমার, টিউমারের সাথে টনসিলের
একটা কো-রিলেশন আছে।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment