খোলা মনে
–ওই যে কী হবে - হিন্দু আর
মুসলমানের, তা-ই!
সন্ধের পর লন্ঠন জ্বেলে পড়তে বসেছি,
মা ঢেঁকিশালে গুঁড়ি কোটাতে ব্যস্ত পাড়ার অনেকের সাথে। এ পাড়ার মধ্যে শুধু আমাদেরই
ঢেঁকি আছে। সামনে পিঠেপার্বণ। তাই ঢেঁকিতে পাড়ার লোকের ভিড়। হঠাৎই একটা শোরগোল
শোনা গেল পাকা রাস্তার দিকে। দাদার গলার আওয়াজ। গিয়ে দেখি, তিনটে ছই ঢাকা গোরুর
গাড়ি, রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে। বোঝা যাচ্ছে ভেতরে ঠাসা মেয়েরা। এক মধ্য বয়স্ক মুসলমান
হাত জোড় করে বলছেন,
-বাবারা দয়া করে ছেড়ে দাও! গাড়িতে
কিচ্ছু লাই গো! শুধু মেয়েরা আছে।
তার কথা শুনে দাদা তার সামনে গিয়ে
বলল,
–চাচা, ঠিক করে বল তো, কোথায় কার
বাড়ি যাবে? বিহার থেকে আসছ না তো!
উনি সবিনয়ে বললেন,
-না বাবা! আসছি সিমলাপাল থিকে।
চাঁদাবিলার মকসেদ মল্লিকের বাড়ি যাব, আমাদের আত্মীয়।
দাদা,
-ঠিক আছে, ঠিক আছে! আর কিছু বলতে হবে
না। চলে যান!
দাদার এই উদারতার কারণ বুঝলাম। মকসেদ
চাচা বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওঁদের বাড়ি গিয়েছি বেশ কয়েক বার। উনিও আসতেন বাবার
সাথে গল্প করতে। আমাদের গ্রামের পাশের জঙ্গল পার হলেই ওঁদের বাড়ি। খুব মিষ্টি মনের
মানুষ।
পরের দিন সকাল বেলা চাঁদাবিলা থেকে
নারাণ চাচা এসে চিৎকার শুরু করেছে,
-ক-ই! কুথা গেলি বাপ বিনা!
দাদার নাম বিনয়। লোকে বিনা বলেই
ডাকে। দাদা আসতেই চাচা হাত দুটো জোড় করে উপরে তুলে শুরু করল,
-তোর বাপের পায়ে হাজার গড়, তোরা
এবারে শাঁক বাজানা বন্দ কর! ভাত খেতে বসেছি, ওমনি শাঁক বেজে উঠল। ব্যস, সব ফেলে
দে-ছুট বনের দিকে! আর পারিনি বাপ! তার চেয়ে বরন লে, আমার মাথাটা কেটে লে! তাতে
যেদি শান্তি হয়!
তখন মাঝে মাঝেই শুনতাম চারদিকে
গ্রামে গ্রামে এক যোগে বেজে উঠছে শাঁখ। ওটা নাকি বিপদ সংকেত! তাই ওই সময় মুসলমানরা
ভয় পেত, হয়তো ওদের উপর আক্রমণ হবে! কিন্তু হয়নি কোন দিন পাশাপাশি কোথাও। যদিও আমরা
আওয়াজ তুললাম আমাদের খেলার মাঝে মাঝে,
-বিহারের বদলা নোয়াখালি।
কোথায় কী ঘটেছিল জানতাম না। এই স্লোগান কে শিখিয়েছিল তা-ও মনে নেই। কিন্তু এখানে
দেখেছিলাম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ এক জোটে শরণার্থীদের সাহায্যে হাত লাগিয়েছিল।
গ্রামে গ্রামে চাল-ডাল-আলু, পুরানো কাপড়-জামা সংগ্রহ করে শরণার্থীদের পৌঁছে দিত।
আজ এখানেই শেষ!
শুভেচ্ছা—
বিমল চন্দ্র রায়
দাঙ্গার দগদগে ঘা।
ReplyDelete