শেষ চিঠি
মিনতিদি এসে আমাকে এক কাপ চা দিয়ে বললো, 'আজ কী রান্না হবে গো দিদিমণি?' আমি বললাম আজ নারকেল দিয়ে খিচুড়ি করো তার সাথে আলুর দম আর ডিম ভাজা। আর শোনো একটু বেশি করে করবে তোমার মেয়ে মালুর জন্য নিয়ে যেও। মিনতিদি বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, বলেই ঘর থেকে চলে গেল। দীর্ঘ বিশ বছর ধরে মিনতিদি এই বাড়িতে কাজ করে। মা ওকে বাড়িতে এনেছিল ওর যখন বারো বছর বয়স। মা-বাপ মরা মিনতিদি পাশের বস্তিতে থাকত। অর্ধেক দিন খেতে পেত না। মা ওকে আমাদের বাড়িতে এনে পড়াশোনা শিখিয়েছে মাধ্যমিক পাশ করে আর পড়েনি মিনতিদি। তারপর বিয়ে, সংসার আর আমাদের বাড়ির দেখাশোনা সব এক হাতেই সামলায়।
চা খেতে খেতে আমি খবরের কাগজটা পড়ছি হঠাৎ বাইরের কলিং বেল বেজে উঠল। মিনতিদি গিয়ে দরজা খুলল। তারপর একটা চিঠি নিয়ে এসে আমার হাতে দিল। আমি অবাক হলাম এই সোশ্যাল আপডেটের দুনিয়ায় কে এমন হাতে লিখে চিঠি পাঠাল! চিঠিটা খুলতেই একটা এ ফোর সাইজের পেজে একটা হাতে আঁকা বাড়ির ছবি বেরিয়ে পড়ল বিছানার ওপর। ছবিটা চিনতে দেরি হল না। এই ছবিটা আমারই হাতে আঁকা অনির্বাণকে উপহার দিয়েছিলাম তার জন্মদিনে।
বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। বাইরের বৃষ্টির ছাঁট মনে হল কয়েক
মুহূর্তে ভিজিয়ে দিল আমাকে।
চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলাম। প্রথমেই লেখা রয়েছে -
প্রিয় আবিরা,
আশা করি তুমি ভাল আছো। তোমার প্রতি আমার কোনোদিন কোনো অভিযোগ
ছিল না আজও নেই। ভালবাসা ছিল, শ্রদ্ধা ছিল। যদিও বা এখনো আছে ভবিষ্যতেও থাকবে।
তুমি ভাবছ, এতগুলো বছর পর কেন লিখছি এসব!
তবে আজ সত্যিই তার কারণ আছে। আমি এ জীবনে তোমাকে ছাড়া আর কোনোদিনই কাউকে গ্রহণ করতে পারিনি এটা তুমি খুব ভাল করেই জানো। বিগত আট বছর তোমার থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও আমার কোনো নারীর প্রতি বিন্দুমাত্র মোহ জন্মায়নি। একদিনের জন্যও নয়। জানি তুমি ফিরবে না তবু অপেক্ষা করেছি। আসলে কিছু মানুষ কোনোদিনই কারোর সাবস্টিটিউট হয় না। তারা যতই দূরে সরে যাক। তারা কোনো কিছুই নিয়ে যেতে পারে না। নিজেকেও না। বুকের ভেতর সযত্নে থেকেই যায়। আবিরা আমার এখনো মনে পড়ে যখন আমরা কলেজে পড়ি বেঞ্চের ওপর তোমার নাম লিখতাম আর তুমি লজ্জায় কেমন লাল হয়ে যেতে। সেদিন যখন মাঘ মাসের কনকনে শীতের রাতে অফিস টুরে মানালি যাচ্ছিলাম সারা রাত দুজনে ট্রেনে কথা বলতে বলতে গেছি। তার জন্য পাশের সিটের আমাদের অফিস কলিগদের কত অভিযোগ ছিল। আমরা নাকি তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছি।
তারপর সেই হোটেলের রাত মনে পড়ে আবিরা?
বাইরে তখন মাইনাস বারো। সবাই একসাথে আড্ডা দিয়ে যখন যে যার
রুমে চলে গেল, আমি যেতে পারিনি তোমাকে ছেড়ে। মনে হয়েছিল তুমি ছাড়া আলাদা কোনো
রুম নেই আমার আর নেই কোনো ঠিকানা। আমার যে বড় শীত করে আবিরা। নিঃসঙ্গতার শীত। এ
খবর কি তুমি রাখো না! যাক, যাক আমার সব চলে যাক আমার চেতনা, বোধ, আত্মপ্রত্যয় সব।
হারিয়ে যাক রুমের চাবি। শুধু তুমিই একমাত্র ঈশ্বর হয়ে ওঠো আমার। হারিয়ে যেতে
দাও তোমার চোখের অতলান্তিক সাগরে, তোমার শরীরে মুখ ডুবিয়ে পান করতে দাও অমৃত
সুধা। তুমি আমায় সেদিন ফিরিয়ে দাওনি। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে চুমু খেয়েছিলে ঠোঁটে।
তারপর একটা অনবদ্য ঘুম। আমি শিশুর মতো তোমার কোলে শুয়ে ছিলাম আর তুমি কপালে বিলি
কেটে দিচ্ছিলে সমুদ্রের হাওয়া এসে যেভাবে চুল এলোমেলো করে যায়। মা-হারা সন্তানের
কাছে প্রেমিকার কোলও যে এতটা শান্তির তা সেদিনই প্রথম বুঝেছিলাম।
এতগুলো বছর তুমি আমার সাথে যোগাযোগ রাখোনি। তুমি হসপিটালে অ্যাডমিট শুনে সেদিন অফিস থেকে ছুটে গিয়েছিলাম তোমাকে দেখতে। তুমি ঘুমোচ্ছিলে। আমাকে দেখলে তুমি যদি বিব্রত হও তাই নার্সিংহোমের বাইরে আমি মিনতিদিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কী হয়েছে তোমার? মিনতিদি বলেছিল তেমন কিছু না পেটে হঠাৎ ব্যথা উঠে ছিল তোমার। মিনতিদিকে বলে এসেছিলাম তোমার যাতে ভাল করে যত্ন নেয়। খুব বেশি মশলাদার খাবার যাতে না বানিয়ে দেয়। আশা করি মিনতিদির কাছ থেকে সে খবর তুমি পেয়েছ।
আবিরা আমিও একটা সংসার চেয়েছিলাম আমাদের। ভালবাসার সংসার। যেটা আর সম্ভব হবে না। হঠাৎ কী এমন করলাম আমি যে এতটা বদলে নিলে নিজেকে। একবার বলতে পারতে আমার সামনে দাঁড়িয়ে সব শুধরে নিতাম। স্বপ্ন দেখতে তুমিই তো শিখিয়েছিলে আমায়। আমাদের একটা নিজের সংসার আর একটা ছোট্ট আবিরা থাকবে। এমনটাই তো কথা ছিল তবে হঠাৎ কেন দূরে সরিয়ে দিলে আমায়? তোমার জীবনে কি নতুন কেউ এসেছে? কেন সেদিন আমাকে ফোনে ওভাবে বললে তুমি আর সম্পর্ক রাখতে চাও না এই উত্তর আমি কি কোনোদিন পাবো না? তুমি আমাকে দেখতে চাওনি বলেই আমি অফিসে রেজিগনেশন লেটার দিয়েছিলাম। তুমি একবারও আমাকে আটকাতে আসোনি। সে-কারণেই চাকরি বদল করেছিলাম যাতে আমাকে আর তোমায় সহ্য করতে না হয়।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment