বিরহ
| ছোটগল্প
সুধাংশু চক্রবর্তী
চন্দ্রানী
মানুষটির
মুখে আজও সেই ‘খোকাবাবু’ ডাকটা শুনে খুব হাসি পেল আমার। পঞ্চাশ বছরের একটা মানুষকে
কেউ ‘খোকাবাবু’ বলে সম্বোধন করলে হাসি পাবে না? অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে তাঁকে বললাম–
বউমা থাকলে তবেই না তাঁকে সঙ্গে আনার কথা উঠবে ভবানী কাকা। আমি আজও বিয়ে করিনি। শুনে
ভবানীকাকা অবাক হলেন খুব –কেন খোকাবাবু? শুনেছিলাম তুমি নাকি বিদেশি মেমসাহেবকে বিয়ে
করেছ? মৃদু হেসে বললাম– মিথ্যে কথা বলেছিলাম।
এই
ব্যাপারে আর কথা না বাড়িয়ে ভবানীকাকা হেসেই বললেন– বেশ-বেশ। কেমন বিদেশিদের মতো লাল
টুকটুকে চেহারা হয়েছে তোমার! এখন দেখে কে বলবে তুমি আমাদের সেই খোকাবাবু?
হেসে পাশ
কাটিয়ে গেলাম। কেন-না আমার মাথার ভিতরে এখন অতীতের কথার স্রোত বয়ে চলেছে। মা-বাবাকে
মিথ্যে কথা বলা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমার কাছে। বিয়ে করিনি জানতে পারলে তাঁরা
যে আমাকে ঘাড় ধরে বসিয়ে দিতেন বিয়ের পিঁড়িতে। অথচ আমার তখন দম নেবার সময়টুকুও ছিল না।
তখন আমি রেসের ঘোড়ার মতো ছুটতে ছুটতে ক্রমাগত জিতেই চলেছি একটার পর একটা রেস। আমার
উন্নতির গ্রাফও চড়চড় করে উঠে চলেছে ওপরের দিকে। তাই মিথ্যে বিয়ের কথা বলে নিস্কৃতি
পেতে চেয়েছিলাম বাবা-মায়ের হাত থেকে।
শুধু ভবানীকাকা
নয়, মা-বাবাও জানতে পারেননি আমার বিয়ে না করার পিছনে আসলে কী কারণ ছিল। কলকাতা ছেড়ে
রাশিয়ায় পড়তে যাবার সময় একজনকে কথা দিয়েছিলাম, তাকেই আমার জীবনসঙ্গিনী করব। রক্ষণশীল
পরিবারের সন্তানদের অনেক জ্বালা। চাইলেই যাকে খুশি বিয়ে করার উপায় নেই। জানতে
পারলে মা-বাবা কিছুতেই রাজি হতেন না আমাদের বিয়েতে।
রাশিয়ায়
থাকাকালীন সময়ে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তার সঙ্গে আমার সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল।
অবশ্য আমারই দোষ ছিল। তখন আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত হবার পথে তড়তড়িয়ে
এগিয়ে চলা। সে-কারণে আমিও তেমন চেষ্টা করিনি তার খোঁজ রাখার। পরিণামে নিজের অজান্তেই
একদিন ভুলে গেলাম তাকে।
**
আজ
নতুন বছরের পয়লা জানুয়ারি। ঘুম থেকে ওঠার পর পরই সেলফোন বেজে ওঠায় তাকিয়ে দেখি এক রাশিয়ান
বন্ধু ফোন করেছেন। তিনি জানালেন গত রাতেই কলকাতায় এসে উঠেছেন পার্ক স্ট্রিটের একটা
হোটেলে। ভারতে বেড়াতে এসেছেন দিন কয়েকের জন্য। তিনি ফোনেই আবদার ধরেছেন, তাঁকে আজই
দেখাতে হবে কলকাতা শহর, ‘দ সিটি অব জয়’।
অগত্যা
নববর্ষের বিকেলেই চলে এলাম পার্ক স্ট্রিটে। হোটেলে এসে বন্ধুটির রুমে বসে বার্তালাপের
ফাঁকেই এক কাপ কালো কফি খেলাম। কফি খেয়ে তাঁকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম হোটেল থেকে। হোটেল
থেকে বেরোনোর সময় ভেবে নিয়েছি, একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে গোটা রাত ঘুরে ঘুরে কলকাতা শহর
দেখিয়ে দেব তাঁকে।
রাস্তায়
নেমে এসে ট্যাক্সির খোঁজ করতে করতে ফুটপাথের ওপর দিয়ে হাঁটছি। সহসা চোখ গেল সেই বয়স্কা
মহিলাটির দিকে কফি খেতে খেতে একটু আগেই যাকে দেখেছি হোটেলের খোলা জানালা থেকে। একটা
ব্যাপার দেখে খুবই অবাক হলাম। মহিলাটি এখনো একই স্থানে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন! কেন!
ভাল করে
তাকালাম মহিলাটির দিকে। বয়স অনেকটা পরিবর্তন ঘটিয়ে দিলেও কেন যেন মহিলাটিকে খুব চেনা
মনে হল আমার। চন্দ্রানী! পরক্ষণেই ভাবলাম, তা কী করে সম্ভব? চন্দ্রানী বর্ধমানের
মেয়ে। পড়াশোনা করত শিবপুরেই একটা লেডিজ হোস্টেলে থেকে।
আমার মতো
চন্দ্রানীও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছিল ওই কলেজে। আমি ছিলাম ওর দু’বছরের
সিনিয়ার। পড়া শেষ করে আমি চলে গেলাম রাশিয়ায় আর ও থেকে গেল শিবপুরে।
শেষ যে-বার
ওর সঙ্গে এই পার্ক স্ট্রিটে এসেছিলাম নববর্ষ উদ্যাপন করার জন্য, সে-বারই ছিল আমার
কলেজ জীবনের শেষ বছর। সেই রাতে আমার বুকে মাথা রেখে চন্দ্রানী বলেছিল, ‘আচ্ছা স্বপ্নেন্দু,
প্রতিবছর এই দিনটায় এখানে এসে নববর্ষ উদ্যাপন করতে পারি না আমরা? কথা দাও, বিয়ের
পর ঘোর সংসারী হয়ে গেলেও এই নিয়মটাই আমরা বজায় রাখব।’
চন্দ্রানীকে
কথা দিয়েও সেই কথা রাখতে পারিনি আমি। বাবা আচমকা জেদ ধরে বসেছিলেন, ‘এখনই চাকরি নয়।
আরও পড়াশোনা করে এসো বিদেশে গিয়ে। আমারই অফিসের এক
কলিগের সাহায্যে তোমার রাশিয়ায় থেকে পড়াশোনা করার সমস্ত ব্যবস্থা
করে রেখেছি। তুমি আগামীকাল সকালেই ফ্লাইটে চাপবে’।
আমার কোনো আপত্তি ধোপে টেকেনি। সে-কারণে চন্দ্রানীর
সঙ্গে আর দেখা করা হয়ে ওঠেনি আমার। তবে সেলফোনেই জানিয়েছিলাম, রাশিয়া থেকে শিক্ষান্তে
ফিরে এসে ওকেই বিয়ে করে সংসারী হব। কিন্তু সেটাও আর করা হয়ে ওঠেনি উচ্চাকাঙ্ক্ষার লোভে।
রাশিয়াতেই থেকে গেলাম নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। এর পর একদিন চন্দ্রানীর সঙ্গে সমস্ত
যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
সহসা
কী মনে হতে রাশিয়ান বন্ধুটিকে ফুটপাথে দাঁড় করিয়ে চলে এলাম
অপর দিকের ফুটপাথে। মহিলাটি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন ওই একই স্থানে। কাছে
গিয়ে বিনম্র গলায় শুধোলাম– কারও জন্যে অপেক্ষা করছেন আপনি?
মহিলাটি ঘুরে তাকালেন আমার দিকে- হ্যাঁ।
একজন কথা দিয়েছিল। জানেন, সে ছিল আমার খুবই
কাছের মানুষ। স্বপ্নেন্দু চট্টরাজ। কথা দিয়েছিল, এই নববর্ষের দিনেই এখানে এসে আমার
সঙ্গে উদ্যাপন করবে নববর্ষের রাত। সেই থেকে প্রতিবছর নববর্ষের দিন এখানে এসে প্রথম
বিকেল থেকে রাত গভীর হওয়া ইস্তক তারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকি। বিগত চব্বিশ বছর না আসতে
পারলেও আমার মন বলছে এ’বছর নিশ্চয়ই আসবে সে। আসতেই হবে তাকে। কথা দিয়েছিল যে।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment