বাতায়ন/ধারাবাহিক/১ম বর্ষ/৩২তম সংখ্যা/২৩শে চৈত্র, ১৪৩০
ধারাবাহিক
গল্প
জয়িতা ঘোষ হালদার
[অশ্রুলেখার চিঠি]
শান্তি কোথায়
[২য় পর্ব]
পূর্বানুবৃত্তি
মনামীর বিয়ে হয়েছে কোটিপতি ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তার সবই আছে, কিন্তু কথা বলার একটাও
মানুষ নেই। এমনকি বাড়ির বাইরে এক পা-ও গাড়ি ছাড়া যাবার হুকুম নেই। এটা নাকি তার
শ্বশুরবাড়ির ঐতিহ্য। একদিন সে লোকাল ট্রেনে করে ঘুরবে ঠিক করল। টিকিট কাটতে গিয়ে
দেখল তার কাছে পাঁচশো টাকার নোট ছাড়া কোন খুচরো নেই। তারপর…
হরেক রকম ফেরিওয়ালা একের পর এক আসছেই কামরায়। তারা বড় বড়
ঝুড়ি মাথায় নিয়ে— কেউ আপেল, কেউ মুসাম্বি লেবু, কেউ পেয়ারা, কেউ বাক্স ভরে
ঝালমুড়ি, কেউ শশা, কেউ বা চুড়িদারের জামা, ওড়না, ব্যাগ বিক্রির চেষ্টায়
তারস্বরে বিভিন্ন ধরনের গলার স্বরে হেঁকে চলেছে।
একটার পর একটা স্টেশন আসছে। ট্রেনে লোকজন ওঠানামা করছে। তার
সামনে একটি মেয়ে এসে বসল এবার। সবেমাত্র খড়দহ স্টেশন ছাড়ল ট্রেন। মেয়েটির
চোখমুখের চেহারা দেখেই বোঝা যায় খুব ক্লান্ত। মনামী তার হাতঘড়ির দিকে তাকালো। সকাল
মাত্র দশটা বেজেছে। এত কী কাজ করেছে মেয়েটি! এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে? কী মিষ্টি
ফর্সা সুন্দর মেয়েটি।
ওর মুখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল এবার মনামী। ব্যাগ থেকে একটা
মিষ্টি পাঁউরুটি বের করে খাওয়া শুরু করেছে সে। পাউরুটির গুঁড়ো ঝুরঝুর করে ওরই
জামায় পড়ছে। খুব সস্তার একটা টপ আর স্কার্ট পরা। নিশ্চয়ই খুব বাসি পাউরুটিটা। রোগা
চেহারার মেয়েটির ব্যাগের ফোন বাজছে।
খাওয়া বন্ধ করে ডানহাতে ব্যাগ খুলে ফোন ধরেই বলল— হ্যাঁ দিদি।
আমি আসছি। আজ এই রাতের ডিউটির মাসিমা খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। তাই এতটা দেরি
হয়ে গেছে গো। আমি আসব আসব অবশ্যই। আপনি সেন্টারে জানাবেন না কিন্তু দিদি। প্লিজ
প্লিজ।
হ্যাঁ, হ্যাঁ । আমি বুঝতে পারছি দিদি। আমার জন্য আপনার অফিস
কামাই হয়ে গেল আজ। আমার খুব খারাপ লাগছে দিদি।
না না দিদি। আজকের দিনটা এরকম হয়ে গেল। আমি তো নিরুপায়।
ওনাদের শুধু রাতের আয়া। হ্যাঁ দিদি। পেশেন্ট ফেলে বেরোতে দেরি হয়ে গেছে। সত্যি
বলছি দিদি।
ঠিক আছে। ঠিক আছে দিদি। আমি আসছি।
সবেমাত্র ফোন রেখে একটা কামড় দিয়েছে মেয়েটি। আবার ফোন বাজতে
শুরু করল।
মনামীর খুব মায়া লাগছিল। মেয়েটার চোখমুখে রাত জাগার
ক্লান্তিতে কালো প্রলেপ পড়ে আছে। খাওয়াও হয়নি ঠিক মতো। তবুও এইটুকু খাবার মুখেই
তুলতে পারছে না।
হ্যাঁ বলুন স্যার।
হ্যাঁ আমি তো দিদিকে বলেছি এইমাত্র আমি যাচ্ছি। আমার আগের
বাড়ির পেশেন্ট…
ও আচ্ছা। দেখুন স্যার, আপনি তো আমার বাড়ির অবস্থা জানেন। প্লিজ
এ বেলার কোনো একটা পার্টি কি হবে না আর?
আসলে, আমি বাড়ি ফিরে যেতে পারব না আগামী ১৫ দিন। আমার যতদিন
না টাকার অঙ্কটা তুলতে পারব আমার বাড়ি ফেরা হবে না। আপনি তো জানেন সবই।
আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তাহলে কল্যাণীতে নামছি। আপনি অ্যাড্রেসটা
একটু হোয়াটসঅ্যাপে লিখে দিন স্যার।
আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ স্যার।
মেয়েটির দিকে তাকিয়েই রয়েছে মনামী। ওর একতরফা কথাগুলো— ওর
সম্বন্ধে অনেকটাই জানিয়ে দিয়েছে ওকে।
ওর কথাবার্তায় উচ্চারণে এটা স্পষ্ট যে, ও বেশ শিক্ষিত। খুব জানতে ইচ্ছে করছে ও পড়ানোর টিউশন বা স্কুল টিচার এসব
পেশায় না গিয়ে এত কষ্টের আয়ার কাজ কেন করে? কিন্তু, স্বভাবজাত অথবা স্ট্যাটাস আপডেট হওয়ার ফলে সে সহজে
কারো সঙ্গে কথা বলতে পারে না আজকাল। স্কুলের সেই হাসিখুশি ছটফটে মনামী হারিয়ে
গেছে আজ।
মেয়েটি হঠাৎ চোখ তুলে তার দিকে তাকাতেই চোখ সরাতে পারল না
মনামী। বলল— একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
হ্যাঁ, বলুন।
আপনার কথাগুলো কানে এলো তাই, আপনি তো শিক্ষিতা বেশ। তবে, এ
পেশায় কেন?
কেন? এটা কি খারাপ কাজ?
না না, সরি, আমি একদম সেটা বলিনি। এটা একটা মহৎ কাজ। কিন্তু
প্রচণ্ড পরিশ্রম তো। তাই জানতে চাইছিলাম। কিছু না। থাক, আপনার ইচ্ছা না করলে বলবেন
না। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।
মেয়েটি খাওয়া শেষ করেছে ততক্ষণে। এবার নরম গলায় বলল— আসলে,
টিউশন করা সম্ভব নয়, আমি একদম গ্ৰামের ভিতরে থাকি। ওখানে কেউ অতটা পড়াশোনা করে
না যে প্রাইভেট টিউটর লাগবে। আমি ডিসটেন্সে এমএ পাশ করে প্রচুর চেষ্টা করেছি
চাকরির। তখন বাবা ছিলেন। বাবা হঠাৎ চলে গেলেন। তিন বোন, দুই ভাই আর মা। সংসারের
হাল আমাকেই ধরতে হয়েছে, আমিই বড় তো। অগত্যা এই কাজটা ধরলাম।
মনামী স্তব্ধ হয়ে গেছে। সে মাত্র টুয়েলভ পাশ। আর এই মেয়েটা…
সে বলল, আমাকে তোমার ফোন নম্বরটা দেবে? যদি তোমার উপযুক্ত কোন
কাজের সন্ধান পাই তাহলে যোগাযোগ করতে পারি।
হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। আমি আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকব। লিখে নিন
আমার ফোন নম্বর।
ফোন নম্বরটা সেভ করতে না করতেই হঠাৎ মনামীর চুলে প্রচণ্ড টান।
হতচকিত হয়ে মাথাও ঘোরাতে পারছে না সে। পাশ দিয়ে যাওয়া ফেরিওয়ালার হাতের রিং-এ
ঝোলানো ব্লাউজের হুক তার চুলে গেছে আটকে। ফলে এই অবস্থা। তার সাধের লম্বা একরাশ
কালো চকচকে মসৃণ চুলের খোঁপা নষ্ট হয়ে গেল।
মনামী বহু বছর কোনো ট্রেনেই ওঠেনি, তার ওপর এমন ভিড়, এত রকম
কাণ্ডকীর্তি— সে বেশ অস্বস্তি নিয়ে ভাবল এবার নেমেই পড়ি। কিন্তু, এতটাই ভিড় যে
সিট থেকে ওঠার সাহস হলো না।
— দিদি সরি, সরি, বলতে বলতে ফেরিওয়ালা চুল থেকে হুক খুলে
দিয়ে এগিয়ে চলে গেছে। দূর থেকে অনেকক্ষণ ধরে গানের আওয়াজ আসছিল। এবার দেখল, এক
বৃদ্ধ মুখে মাইক আর কোলের কাছে একটা বাক্স ধরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান গেয়ে
চলেছে।
সে মুগ্ধ হয়ে গেল তার গানে। সবাই একটা-দুটো কয়েন তার হাতে
দিচ্ছে। গান শুনতে শুনতে এগিয়ে এলো গায়কের হাত তার সামনে। সে ব্যাগ থেকে একটা
একশো টাকার নোট দিতেই গায়ক গান থামিয়ে বলল— ও দিদি খুচরো নেই তো আমার কাছে।
না না, আমি ওটা আপনাকেই দিলাম।
বৃদ্ধ গায়ক চোখে জল নিয়ে দুই হাত জোড় করে গাইতে শুরু করেছেন
আবার— চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না নিয়ো না সরায়ে…
ট্রেনের কামরায় কথোপকথন যেন কয়েক মুহূর্ত থেমে ছিল।
"বিকায়ে বিকায়ে দিন আপনারে,
পারি না ফিরিতে দুয়ারে দুয়ারে…"
আর পারছে না মনামী। সামনের মেয়েটি ফোন নম্বর দেওয়ার পর কখন
যেন নেমে গেছে ট্রেন থেকে।
এবার ভিড় খানিকটা হালকা হয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতেই
পাশে দাঁড়ানো এক মহিলা তার পায়ের ওপর এক বিশাল সবজির ঝুড়ি দিয়ে ঘষে দিলো।
যন্ত্রণায় কাতরে উঠল মনামী।
উঃ…
ওঃ লাগল দিদি। আমি বুইতে পারিনি কো। এগোয়ে যাও। নামবে তো
এগোয়ে যাও দিদি।
মনামী আর কথা না বাড়িয়ে ট্রেনের গতি স্তব্ধ হতেই নেমে পড়ল। এটা
পায়রাডাঙা স্টেশন। বেশ অনেকক্ষণ ধরে ট্রেনের বাইরে জানালায় চোখ চলে যাচ্ছিল বার
বার। বাইরের সবুজ ক্ষেত, আর ঘন ঝোপঝাড় মাঝে মাঝে টানছিল তাকে। কিন্তু, ট্রেনের
কামরায় ঘটে চলা ঘটনাগুলো তাকে এতটাই নাড়া দিচ্ছিল যে বাইরের প্রকৃতি তার মন
ছুঁয়ে যায়নি।
এবার চারিদিকে গাছপালায় ভরা স্টেশনে নেমে বেশ স্বস্তি লাগল। গলাটা
তেষ্টায় শুকিয়ে গেছে। ছোট ছোট অজস্র দোকান স্টেশনের পাশের রাস্তায়। সেখান থেকে
জল কিনে নিয়ে খেতে খেতে ফোন বেজে উঠল তার।
অচেনা ফোন নম্বর— হ্যালো…
হ্যাঁ, হ্যাঁ আমিই মনামী। ওঃ আচ্ছা, সুরশ্রী। আচ্ছা আমি তোকে
পরে ফোন করব। এখন বাইরে আছি রে।
ফোন কাটতেই আবার রিং। এবার বাড়ি থেকে কেয়ারটেকার কাকা।
হ্যাঁ, কাকা। আমি বাড়ি ফিরছি। এই একটু এসেছিলাম এদিকে। হ্যাঁ, হ্যাঁ। গাড়ি
পাঠাতে লাগবে না কাকা। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক ফিরে যাব।
ফোনে এবার উবের অ্যাপটা খুলে গাড়ি বুক করে ফেলল মনামী। এবার
বাড়ি ফেরার পালা।
মিনিট পনেরো লাগবে গাড়ি আসতে। তার ফর্সা টুকটুকে গায়ের রং
লালচে হয়ে উঠেছে। ডানহাতে লক্ষাধিক টাকা দামী রিস্ট ওয়াচে তখন মধ্যাহ্নের আভাস। বাঁ
হাতে একটা হীরে বসানো সোনার নোয়াবাঁধানো। পরনে সহস্রাধিক মূল্যের শাড়ি। পায়ের
দামী জুতোয় ধুলো ভর্তি। পায়ের কড়ে আঙুলের কাছটা চিরচির করছে যন্ত্রণায়। যন্ত্রণাটা কি শুধু পায়ের আঙুলের! না কি মনের গভীরে ক্ষত থেকে
রক্তক্ষরণের?
তার বিশাল বিপুল বৈভবের প্রাচুর্যে তার সময় কাটে না। তার কোনো
অপূণর্তা নেই জীবনে। তবুও তার ভাল লাগে না। আর আজ এইটুকু সময়ে একটা ট্রেনের
কামরায় সে কী দেখল? এই তো তার গরিব দেশ। তার দীন-দরিদ্র জননী, বাংলা-মা। সে নিজেও
ছিল কোনো এক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। আজ সে বিত্তের চোখ ধাঁধানো আলোয় কি দৃষ্টি
হারিয়ে ফেলেছে?
গাড়িটা এসে গেছে। সিটে বসে পিঠে নরম গদির আলগা স্পর্শ আর
ঠান্ডা এসির বাতাসে মনামীর মনে হলো— আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। আমি যা
পেয়েছি জীবনে তা সবটাই আমার যোগ্যতার অতিরিক্ত। আর কখনো ভাবব না আমার ভাল লাগছে
না। এত লড়াই করে মানুষ বাঁচার চেষ্টা করে। আর এত সহজ সুখী জীবনেও আমি শান্তি
খুঁজে বেড়াই!
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment