প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

রং | প্রতিজ্ঞা

  বাতায়ন/ রং /সম্পাদকীয়/২য় বর্ষ/ ৩ ২তম সংখ্যা/ ২৯শে ফাল্গুন ,   ১৪৩১ রং | সম্পাদকীয়   প্রতিজ্ঞা "নির্ভীক একটি ফুলের মতো মেয়েকে চরম লাল...

Thursday, April 4, 2024

সুনন্দিনী শুক্লা | বিস্মৃতবীর

বাতায়ন/ধারাবাহিক/১ম বর্ষ/৩২তম সংখ্যা/২৩শে চৈত্র, ১৪৩০

ধারাবাহিক গল্প

সুনন্দিনী শুক্লা

বিস্মৃতবীর

[২য় পর্ব]

পূর্বানুবৃত্তি অর্ধেন্দু তমলুকে তার এক কালের জমিদার বাড়িতে ছুটি কাটানোর জন্য মনোজিৎ আর স্বর্ণেন্দুকে নিয়ে এসেছে। ওরা প্রেসিডেন্সির ছাত্র। শিকার করার জন্য ওরা তৈরি হয়েই এসেছে, সঙ্গে এয়ারগানও আছে। কিন্তু কোথায় কী! বিকেলে চা খেতে একটা গুমটি চায়ের দোকানে গেল। এক বৃদ্ধ দোকানি ওদের বসতে বলে চায়ের তোড়জোড় করছেন এবং ওদের কথা শুনছেন। কথায় কথায় প্রকাশ পেল ওই দোকানি স্বাধীনতা সংগ্রামী। তারপর…

- আপনি কি ব্রিটিশ পুলিশ বা আর্মিতে ছিলেন?
- আর্মিতেই। তবে ব্রিটিশ আর্মি নয়, ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা।

তিনজনের মধ্যে স্বর্ণেন্দু প্রথম নীরবতা ভাঙে। বলে,
- মানে সূর্য সেন প্রতিষ্ঠিত সেই আর্মি? মানে যারা অস্ত্রাগার লুন্ঠন… বাপ-রে! আপনি স্বাধীনতা সংগ্রামী?
বৃদ্ধ মলিন হাসেন।
- অত ভারী শব্দের কোন প্রয়োজন নাই। দেশকে ভালবেসে দেশের জন্য কাজ করেছিলাম।
তিনজনে লাফিয়ে ওঠে। এমনি এখানে দিনগুলো নষ্টই হচ্ছে। এমন মানুষকে পেয়ে সন্ধেবেলাটা মাটি হতে দেওয়া যায় না। তিনজনের মাথায় তখন অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শোনার ভূত চেপেছে। বৃদ্ধ বিব্রত হন।
- এসব তোমাদের ভাল লাগবে না। এখন এসব বলে কী হবে? দেশ তো স্বাধীন! পাঠ্য বইয়ে তো লেখা আছে কীভাবে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমেই শেষ পর্যন্ত ইংরেজ বিতাড়ন সম্ভব হল! আমাদের গল্পের আর কোন রেলিভেন্স নেই।
- আমরা শুনব জেঠু। না করবেন না! সত্য সবসময়ই রেলিভেন্ট। কেউ মানুক বা না মানুক।
স্বর্ণেন্দু বলে। ও দর্শন শাস্ত্রের ছাত্র। বেশ ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথার জাল বিস্তার করতে পারে।

বৃদ্ধ চুপ করে থাকেন। আকাশের দিকে তাকান। মেঘ গুড়গুড় করছে। বলেন,

- আপত্তি না থাকলে ভিতরে গিয়ে বসি? বৃষ্টি আসছে।

লন্ঠনের আলোয় গুমটির ভেতরে এসে তিন জনে বসল। বৃদ্ধ তিনটি বাটিতে মুড়ি সরষের তেল মেখে দিলেন। তারপর শুরু করলেন - আমরা মূলত যার নির্দেশে পরিচালিত হয়েছিলাম তিনি মাস্টারদা সূর্য সেন, চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানের নায়ক। আমার ব্যক্তিগত কোন গল্প নেই। আমি তারই গল্প বলব। শোনো। মাস্টারদার আর আমার গ্রাম ছিল এক। চট্টগ্রামের নয়াপাড়া। বর্ধিষ্ণু বাড়ি ওদের। রাজমনি কাকামশাই আর শশী কাকিমার ছেলে সূর্যদা। ওরা ছয় ভাই-বোন, সূর্যদা চতুর্থ। কাকাবাবু খুব অল্প বয়সেই গত হন। সূর্যদা ওর কাকা গৌরমনির স্নেহ আদরে বড় হয়েছেন। কী যে দুষ্টুমি করতাম আমরা! গাঁয়ের পাঠশালায় পড়ার সময় লুকিয়ে আমবাগানে তামাক খেতাম। ব্রাহ্মণদার সে কী মার! ধরা পড়াতে কাকিমা বললেন, ‘বাবুদের কয়েক ছিলিম তামাক সেজে দাও, ভাত খেয়ে আর কাজ নেই।’ সত্যি খেতে দেননি সেদিন! কর্ণফুলী নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি, মাছ ধরা। পাঠশালার পাঠ শেষ করে আমরা ভর্তি হলাম নয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে এসে আমাদের চরিত্র পুরোপুরি বদলে গেল হেমেন্দ্রবাবুর পাল্লায় পড়ে। অসাধারণ জ্ঞানী ও স্বদেশপ্রেমিক মানুষ। ক্লাসের মধ্যে উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন - তেজোহীন বীর্যহীন ততোধিক পরাধীন আমাদের হায়/ কোন পাপের এ ফল, করে ভিক্ষাপাত্র, কণ্ঠে দাসত্ব শৃঙ্খল - আমাদের বুকের ভেতরটা কেমন করত! দেশটেশ তখন অত বুঝতাম না।

১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করলেন। সেই সময় আমরা একদিন যুক্তি করে ঠিক করলাম প্রতিবাদ সভা করব। হেমেন্দ্রবাবুকে বলতে উনি নিজেই স্কুলের মাঠে সব আয়োজন করলেন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর কথা উল্লেখ করে উনি বললেন, 'বড়লাট বলছেন partition is a settled fact. সুরেন্দ্রবাবুর কথার প্রতিধ্বনি করে চলো আমরা সবাই ডাক দিই we will unsettle the settled fact!' কী যে আনন্দ হয়েছিল সেদিন! বাঁধন ছেঁড়ার আনন্দ! উনিই আমাদের পড়তে দিয়েছিলেন সখারাম গণেশ দেউস্করের লেখা 'দেশের কথা।' উনি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ। মনে আছে আমি, সূর্যদা, তারক, বুটু লুকিয়ে লন্ঠনের আলোয় পড়েছিলাম।

সত্যানন্দ স্বামী জিজ্ঞেস করছেন,
— যতদিন না মাতার উদ্ধার হয়, সকল পরিত্যাগ করিবে? 
— করিব!
— মাতাপিতা?
— করিব!
— ভ্রাতা-ভগিনী?
— করিব!
— দারাসুত?
— করিব!
— রণে ভঙ্গ হবে না?
— না!
— প্রতিজ্ঞা যদি ভঙ্গ হয়?
— জ্বলন্ত চিতায় প্রবেশ করিব!

মনে হতো সত্যানন্দ স্বামী যেন আমাদের জিজ্ঞেস করছেন,

— তোমরা দীক্ষিত হবে?
— বৃদ্ধ জ্বলজ্বলে চোখে লন্ঠনের দিকে চেয়ে রইলেন। 
মনোজিৎ বলল - তারপর?

এরপর আমরা ভর্তি হলাম কৃষ্ণনাথ কলেজে। দিব্যি কলেজের দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। সূর্যদা এই সময় থেকে কেমন জানি অন্যমনস্ক থাকত। কলেজে ঢোকার বাইরে এখন আমরা প্রায় দিন পোস্টার দেখতে পেতাম। কলেজের দেয়ালে কেউ সেঁটে দিয়ে গেছে রাতের অন্ধকারে - 'ব্রিটিশ ভারত ছাড়ো! সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক!' সূর্যদা একদিন আমাকে বলল- 'জানিস তো? এগুলো দেখে আমার কেমন গা শিরশির করে।' একদিন কলেজ হোস্টেলে পুলিশের হামলা হল। আমাদের সহপাঠী নলিনাক্ষকে মারতে মারতে নিয়ে গেল, ও নাকি স্বদেশী করে! আমরা স্তম্ভিত হয়ে রইলাম! সূর্যদা গুম মেরে গেল! মাসখানেক বাদে সমীরণ ছুটতে ছুটতে হোস্টেলে এলো - 'নলিনাক্ষ ফিরে এসেছে, শিগগির চল!' ওর পিছন পিছন দৌড়াতে দৌড়াতে কলেজের পিছনের কাঁটা ঝোপ, আমবাগান পেরিয়ে একটা টালির ঘরের সামনে আমরা পৌঁছোলাম। দেখলুম এক ব্যক্তিকে ঘিরে কয়েকজন যুবকের জটলা তার মধ্যে নলিনাক্ষও আছে। সূর্যদা পিছন থেকে এসে ওর কাঁধে হাত রাখতে ও ঘুরে দাঁড়ালো। ঠোঁটের পাশে কাটা দাগ। চোখে মুখে অত্যাচারের চিহ্ন ফুটে আছে। সূর্যদার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল,

- এই যে সতীশদা, আমাদের মেজদা।

ক্রমশ…

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)