ধারাবাহিক গল্প
বিস্মৃতবীর
পূর্বানুবৃত্তি অর্ধেন্দু তমলুকে তার এক কালের জমিদার বাড়িতে ছুটি কাটানোর জন্য মনোজিৎ আর স্বর্ণেন্দুকে নিয়ে এসেছে। ওরা প্রেসিডেন্সির ছাত্র। শিকার করার জন্য ওরা তৈরি হয়েই এসেছে, সঙ্গে এয়ারগানও আছে। কিন্তু কোথায় কী! বিকেলে চা খেতে একটা গুমটি চায়ের দোকানে গেল। এক বৃদ্ধ দোকানি ওদের বসতে বলে চায়ের তোড়জোড় করছেন এবং ওদের কথা শুনছেন। কথায় কথায় প্রকাশ পেল ওই দোকানি স্বাধীনতা সংগ্রামী। তারপর…
বৃদ্ধ চুপ করে থাকেন। আকাশের
দিকে তাকান। মেঘ গুড়গুড় করছে। বলেন,
লন্ঠনের আলোয় গুমটির
ভেতরে এসে তিন জনে বসল। বৃদ্ধ তিনটি বাটিতে মুড়ি সরষের তেল মেখে দিলেন। তারপর
শুরু করলেন - আমরা মূলত যার নির্দেশে পরিচালিত হয়েছিলাম তিনি মাস্টারদা সূর্য
সেন, চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানের নায়ক। আমার ব্যক্তিগত কোন গল্প নেই। আমি তারই গল্প
বলব। শোনো। মাস্টারদার আর আমার গ্রাম ছিল এক। চট্টগ্রামের নয়াপাড়া। বর্ধিষ্ণু
বাড়ি ওদের। রাজমনি কাকামশাই আর শশী কাকিমার ছেলে সূর্যদা। ওরা ছয় ভাই-বোন,
সূর্যদা চতুর্থ। কাকাবাবু খুব অল্প বয়সেই গত হন। সূর্যদা ওর কাকা গৌরমনির স্নেহ
আদরে বড় হয়েছেন। কী যে দুষ্টুমি করতাম আমরা! গাঁয়ের পাঠশালায় পড়ার সময়
লুকিয়ে আমবাগানে তামাক খেতাম। ব্রাহ্মণদার সে কী মার! ধরা পড়াতে কাকিমা বললেন, ‘বাবুদের
কয়েক ছিলিম তামাক সেজে দাও, ভাত খেয়ে আর কাজ নেই।’ সত্যি খেতে দেননি সেদিন!
কর্ণফুলী নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি, মাছ ধরা। পাঠশালার পাঠ শেষ করে আমরা ভর্তি হলাম
নয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে এসে আমাদের চরিত্র পুরোপুরি বদলে গেল
হেমেন্দ্রবাবুর পাল্লায় পড়ে। অসাধারণ জ্ঞানী ও স্বদেশপ্রেমিক মানুষ। ক্লাসের
মধ্যে উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন - তেজোহীন বীর্যহীন ততোধিক পরাধীন আমাদের হায়/
কোন পাপের এ ফল, করে ভিক্ষাপাত্র, কণ্ঠে দাসত্ব শৃঙ্খল - আমাদের বুকের ভেতরটা কেমন
করত! দেশটেশ তখন অত বুঝতাম না।
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করলেন। সেই সময় আমরা একদিন যুক্তি করে ঠিক করলাম প্রতিবাদ সভা করব। হেমেন্দ্রবাবুকে বলতে উনি নিজেই স্কুলের মাঠে সব আয়োজন করলেন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর কথা উল্লেখ করে উনি বললেন, 'বড়লাট বলছেন partition is a settled fact. সুরেন্দ্রবাবুর কথার প্রতিধ্বনি করে চলো আমরা সবাই ডাক দিই we will unsettle the settled fact!' কী যে আনন্দ হয়েছিল সেদিন! বাঁধন ছেঁড়ার আনন্দ! উনিই আমাদের পড়তে দিয়েছিলেন সখারাম গণেশ দেউস্করের লেখা 'দেশের কথা।' উনি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ। মনে আছে আমি, সূর্যদা, তারক, বুটু লুকিয়ে লন্ঠনের আলোয় পড়েছিলাম।
মনে হতো সত্যানন্দ স্বামী
যেন আমাদের জিজ্ঞেস করছেন,
এরপর আমরা ভর্তি হলাম
কৃষ্ণনাথ কলেজে। দিব্যি কলেজের দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। সূর্যদা এই সময় থেকে কেমন
জানি অন্যমনস্ক থাকত। কলেজে ঢোকার বাইরে এখন আমরা প্রায় দিন পোস্টার দেখতে পেতাম।
কলেজের দেয়ালে কেউ সেঁটে দিয়ে গেছে রাতের অন্ধকারে - 'ব্রিটিশ ভারত ছাড়ো!
সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক!' সূর্যদা একদিন আমাকে বলল- 'জানিস তো? এগুলো দেখে আমার
কেমন গা শিরশির করে।' একদিন কলেজ হোস্টেলে পুলিশের হামলা হল। আমাদের সহপাঠী
নলিনাক্ষকে মারতে মারতে নিয়ে গেল, ও নাকি স্বদেশী করে! আমরা স্তম্ভিত হয়ে রইলাম!
সূর্যদা গুম মেরে গেল! মাসখানেক বাদে সমীরণ ছুটতে ছুটতে হোস্টেলে এলো - 'নলিনাক্ষ
ফিরে এসেছে, শিগগির চল!' ওর পিছন পিছন দৌড়াতে দৌড়াতে কলেজের পিছনের কাঁটা ঝোপ,
আমবাগান পেরিয়ে একটা টালির ঘরের সামনে আমরা পৌঁছোলাম। দেখলুম এক ব্যক্তিকে ঘিরে
কয়েকজন যুবকের জটলা তার মধ্যে নলিনাক্ষও আছে। সূর্যদা পিছন থেকে এসে ওর কাঁধে হাত
রাখতে ও ঘুরে দাঁড়ালো। ঠোঁটের পাশে কাটা দাগ। চোখে মুখে অত্যাচারের চিহ্ন ফুটে
আছে। সূর্যদার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল,
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment