পূর্বরাগ | ছোটগল্প
একটুকু ছোঁয়া লাগে
পাঠানকোট থেকে ট্রেন ছাড়তে কিছু সময় বাকি। সঞ্জীব বাড়িতে একটা ফোন করে নিল। এরপর ট্রেনে যদি ঠিকমতো সিগনাল না পায়। শ্রাবণীর লাজুক মুখটা মনের মধ্যে সযত্নে আগলে রাখল। আর মাত্র আঠারো ঘন্টা, তারপর ওরা সামনাসামনি, মুখোমুখি আলিঙ্গনবদ্ধ। উজার করে দেবে নিজেকে তার প্রিয়ার কাছে। শাঁখা-পলা পরা ওই বাহুযুগলের বন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়বে। হারিয়ে যাবে ওর দিঘল কালো চোখের তারায়।
ওই চোখ দুটোই তো সেদিনও টেনেছিল না হলে অমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কারোকে কিছু জানানোর অবকাশও পায়নি। যথা সময়ে ট্রেন স্টেশন ছাড়ল, রাতের খাওয়া আগেই সেরে নিয়েছে, সাইড সিটের জানলায় হেলান দিয়ে বসল সঞ্জীব। ট্রেন ছুটছে জোরে, আরো জোরে। অপেক্ষার প্রহর কমছে, মনের সুপ্ত ইচ্ছেগুলো যেন ট্রেনের বেগের চেয়েও বেশি জোরে ছুটছে। ওদিকে যে তার প্রিয়া একা শয্যায় অপেক্ষারত।
বসে বসে বিয়ের দিনের কথা মনে পড়তে লাগল। ছুটি শেষ, ফেরার ঠিক আগের দিনের ঘটনা। ছোটবেলার বন্ধু বিকাশের মামাতো বোনের বিয়ে, একপ্রকার জোর করেই ওকে নিয়ে গেল। 'তুই আর থাকিস ক'দিন, দুটো স্টেশন পরেই মামাবাড়ি, চল ঘুরে আসবি, একসাথে আনন্দ করি একদিন।' পরের দিনই বেরোনো, আগের দিন তাই কোথাও যাওয়া বেশ চাপের। মা-ও ব্যাগ গুছিয়ে দেবার আশ্বাস দিয়ে বলেছিল 'ঘুরে আয়, কাল থেকে তো আবার ওই এক ডিউটি।'
ভালই হাসিঠাট্টা, হইহুল্লোড়ে বিয়ে বাড়ি বেশ জমজমাট। কিন্তু বরপক্ষের কিছু বিরক্তিকর আচরণে সুর কাটতে থাকল। কখনো বাইকের কোম্পানি পছন্দ না হওয়া তো কখনো গয়নার পরিমাণ কম, নানা অজুহাতে অপমান করতে থাকল মেয়েপক্ষকে। বিষয়টা চরমে উঠল যখন মেয়ের গায়ের রং নিয়ে নানা কু মন্তব্য ছুঁড়ে দিতে থাকল বরযাত্রীর দল। সব লোকের মাঝে প্রথম প্রতিবাদ কনে নিজেই করেছিল। 'আপনারা ফিরে যান, এ বিয়ে হবে না' সকলে হইহই করে উঠেছিল, অনেক বোঝানোর পরেও মেয়ের সেই এক গোঁ। নানারকম কুকথা ছুঁড়ে দিয়ে বিদায় নিয়েছিল বরপক্ষ।
সমস্ত বাড়িতে কান্নার রোল, আগুন ঝরা চোখ দুটি এখন জল ভরা দিঘি। মেয়ে লগ্নভ্রষ্টা, এত রাতে কোথায় পাবে পাত্র। লোকের কাছে মুখ দেখাবে কী করে, মেয়ের মা তো এসব ভেবে কেঁদে আকুল। 'আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি বিয়েতে রাজি, তবে আমাকে কালই ফিরতে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অফিসে সব জানিয়ে আমি এসে ওকে নিয়ে যাব।' এ যেন কোন দেবদূত, শ্রাবণীর বাবা ওর হাত ধরে কেঁদে ফেললেন। বিকাশ গাড়ি নিয়ে তাড়াতাড়ি ওর বাবা-মা আর ছোট বোনকে আনতে ছুটল। চার হাত এক হয়ে গেল। শ্রাবণীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা আর জানার সময় হল না সঞ্জীবের তবে শুভদৃষ্টির সময় ওর চোখে একটা বিশ্বাস ভরা চাহনি ছিল। ওই রাতেই নতুন বউ নিয়ে বাড়ি চলে আসে। রাতটুকু দু-চার কথা ছাড়া বিশেষ কিছু বলার আর সুযোগ হয়নি। পরদিন ভোরে বেরিয়ে গেছিল ট্রেন ধরতে। যাবার সময় দরজায় দাঁড়ানো শ্রাবণীর দিকে একবার হাত নেড়েছিল। শ্রাবণীর চোখে ছিল এক মায়াময় আকুতি।
আজ ছেলে ফিরছে। সারাদিন রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, সব টিপটপ সাজিয়েছেন সঞ্জীবের বাবা-মা। দুটো ফুলের বোখে দিয়ে ঘরের টেবিলটা সাজিয়েছে ননদ। বউদিকে দু-গোছা বেলফুলের মালা দিয়েছে খোঁপায় সাজানোর জন্য। শ্রাবণীর আর তর সইছে না। ট্রেনের টাইম সেই বিকেলে। তবু বারবার বাইরে গেটের দিকে নজর যাচ্ছে। সারাটা দুপুর নিজেকে সাজিয়ে তুলতেই কেটে গেল শ্রাবণীর। শাশুড়ির দেওয়া একটা লাল টুকটুকে শাড়িতে নিজেকে বেশ মোহময়ী করে তুলেছে। হালকা মেকআপ, পাউডার, লিপস্টিকে সেজে উঠেছে ওর রূপ। সিঁথির সিঁদুর একটু কপাল পর্যন্ত নেমে এসে মুখটা আরো রাঙিয়ে তুলেছে। গয়নায়, শাড়িতে ওকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। বারবার আয়নায় নিজেকে দেখছে, কোথাও বেমানান লাগছে না তো। আজ যেন সে ওকে দেখে চোখ ফেরাতে না পারে। সময় যেন আর কাটছে না। এক একটা মিনিট যেন এক এক ঘন্টার মতন। এদিকে দূরপাল্লার ট্রেন যথারীতি চার ঘন্টার বেশি লেট। অ্যাপে দেখাচ্ছে তেমনটাই। সন্ধে গড়িয়ে রাত আটটা। ও বারবার ঘর আর বারান্দা করছে। শ্বশুরমশাই শান্ত হয়ে বসার উপদেশ দিয়ে ক্ষান্ত হয়েছেন। মাঝে-মাঝে আবার নিজের ঘরে গিয়ে সাজটা দেখে আসছে। ঠিকঠাক আছে তো, ক্লান্ত লাগছে না তো?
মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। ট্রেন হাওড়ায় পৌঁছেছে অনেকক্ষণ, তবে এত দেরি হচ্ছে কেন? বারান্দার গ্রিল ধরে বৃষ্টি ভেদ করে গেটের দিকে দৃষ্টি শ্রাবণীর। জলের ঝাপটায় সাজ কিছুটা বিধ্বস্ত। সামনের দিকে চুল ভিজে অবিন্যস্ত। বাড়ির সামনে ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো। বহু কাঙ্ক্ষিত সেই ক্ষণ। সঞ্জীব গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেল শ্রাবণী দাঁড়িয়ে ওর অপেক্ষায়। একে অপরের দিকে অপলকে চেয়ে আছে। গাড়ি থেকে গেট পর্যন্ত আসতেই ভিজে গেছে, ওর গায়ের জামাটা লেপ্টে আছে শরীরের সাথে। সুঠাম ওই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে মন চায় শ্রাবণীর। সঞ্জীবও দেখছে ওকে। কী অপূর্ব স্নিগ্ধ সুন্দর লাগছে । চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। ছুটে গিয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।
ননদ এসে একটা ছাতা দিয়ে 'দাদাকে নিয়ে এসো, ও তো ভিজে যাচ্ছে' বলায় সম্বিত ফিরল শ্রাবণীর। ছাতা হাতে এগিয়ে যায় সঞ্জীবের দিকে। হাওয়া আর বৃষ্টিতে ও ভিজে যাচ্ছে। সঞ্জীব ওর হাতের ওপর হাতটা রেখে শক্ত করে ছাতাটা ধরে। দুজনে ভিজতে থাকে প্রেমের বন্যায়। একে অপরের নিঃশ্বাস টের পাচ্ছে। স্পর্শ অনুভব করছে। এতদিনের প্রতীক্ষার অবসান। দুজন দুজনায় হারিয়ে যেতে থাকে। শুধু তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে। সময় যেন থমকে গেছে। এ মধুর সময় যেন না ফুরায়। সঞ্জীব অন্য হাতে ওর কাঁধটা জড়িয়ে ধরে, কেঁপে ওঠে শ্রাবণীর সমস্ত শরীর। আস্তে আস্তে আরো কাছে সরে আসে। দুজনে এক ছাতায় ভিজে সারা, এগিয়ে যায় বারান্দার দিকে। অনেক কথা, অনেক দেওয়া বাকি, কিছুক্ষণের অপেক্ষা আর, ওরা পুরোপুরি চিনে নেবে পরস্পরকে। স্বতঃস্ফূর্ত আত্মসমর্পণ করবে, সারাজীবনের ভরসা হবে দুজন দুজনার।
সমাপ্ত
খুব সুন্দর। প্রতীক্ষার অবসান।
ReplyDelete