প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

রং | প্রতিজ্ঞা

  বাতায়ন/ রং /সম্পাদকীয়/২য় বর্ষ/ ৩ ২তম সংখ্যা/ ২৯শে ফাল্গুন ,   ১৪৩১ রং | সম্পাদকীয়   প্রতিজ্ঞা "নির্ভীক একটি ফুলের মতো মেয়েকে চরম লাল...

Thursday, April 4, 2024

পূর্বরাগ | নাটক | ঝরা বকুলের ঘ্রাণ | অজয় দেবনাথ

বাতায়ন/পূর্বরাগ/নাটক/শিল্প-সংস্কৃতি/১ম বর্ষ/৩২তম সংখ্যা/২৩শে চৈত্র, ১৪৩০

পূর্বরাগ | নাটক | শিল্প-সংস্কৃতি

অজয় দেবনাথ

ঝরা বকুলের ঘ্রাণ

[সত্যাশ্রয়ী ঘটনার ছায়ায়, কল্পনার রঙে রচিত এই নাটকের সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে কোন মিল থাকলে তা নিতান্তই আকস্মিক ও অনিচ্ছাকৃত।]

[চরিত্র: বকুল, ক্যামেলিয়া, রাধা]

রাধা:            সুপ্রভাত বকুল-দা।

বকুল:           সুপ্রভাত সুপ্রভাত, বলুন রাধা, কেমন আছেন?

রাধা:            ভালো। আপনার গল্পটা পড়লাম। খুব ভালো লাগল।

বকুল:           কোন গল্পটা?

রাধা:            ওই যে ‘একটি প্রেমের গল্প’।

বকুল:           ওঃ ধন্যবাদ। ওসব অনেকদিনের কথা

রাধা:            আপনি এত ভালো গল্প লেখেন বলেননি তো আগে।

বকুল:           এতে বলবার কী আছে?

রাধা:            বা রে! এখন সবাই নিজের ঢাক নিজে পেটায়।

বকুল:           যে পেটায় পেটাক, আমার অত সময় নেই।

রাধা:            বাব্বা এত ব্যস্ত!

বকুল:           হুমম ব্যস্ততা আছে বইকি। কেন আপনি ব্যস্ত নন?

রাধা:            সংসারে একা হাতে সবকিছু, মেয়ের পড়াশোনা... ব্যস্ত তো থাকিই, কিন্তু তার

                 মধ্যেও...

বকুল:           লেখালিখি করেন?

রাধা:            না না, গল্পের বই পড়ি, ম্যাগাজিন পড়ি। আচ্ছা আপনি ছেড়ে দিলেন কেন!

বকুল:           কাকে!

রাধা:            লেখালিখি।

বকুল:           কে বলল?

রাধা:            এই তো আপনি বললেন, অনেকদিনের কথা!

বকুল:           ওই গল্পটা অনেকদিন আগে লেখা।

রাধা:            তার মানে আপনি এখনও লেখেন!

বকুল:           হ্যাঁ... নিয়মিত।

রাধা:            তবে আর কোথাও দেখতে পাই না কেন?

বকুল:           দেওয়া হয়ে ওঠে না।

রাধা:            কেন! ব্যস্ততা?

বকুল:           কিছুটা বলতে পারেন।

রাধা:            আর বাকিটা?

বকুল:           ইচ্ছে করে না।

রাধা:            আশ্চর্য!

বকুল:           আশ্চর্য! কেন?

রাধা:            সবাই লেখা ছাপানোর জন্য মরিয়া। এই তো আমার ননদ এবার বইমেলায় বই

                বের করল।

বকুল:           আপনার ননদ কী লেখেন?

রাধা:            আপনার কিন্তু উচিত লেখা প্রকাশ করা, বই বের করা।

বকুল:           কী হবে? ক’জন পড়ে?

রাধা:            তবুও...

বকুল:           লিট্‌ল ম্যাগাজিনগুলোর অবস্থা দেখেছেন? অধিকাংশ লেখা পাতে দেওয়া যায় না।

                 তার থেকে সিরিয়াসলি চর্চা করা অনেক বেশি জরুরি।

রাধা:            তবে লিখছেন কেন!

বকুল:           ধরুন নিজের জন্য।

রাধা:            মানা গেল না।

বকুল:           আজকের এই মোবাইল আর ইন্টারনেটের যুগে সবকিছু মেড-ইজি হয়ে গেছে।

             বাঙালি কত তাড়াতাড়ি নিজের মাতৃভাষা ভুলবে তার যেন প্রতিযোগিতা চলেছে। বাংলাদেশের অবস্থা তো আরও করুণ। ভাবতেও অবাক লাগে, এই ভাষাকে কেন্দ্র করেই একদিন বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে বাদ দিলে বাকিদের কথা যত ভুলে যাওয়া যায় ততই ভালো।

রাধা:           এ তো চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়া! যে-কোনো শিল্পীই তার সৃষ্টি পাঁচজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায়, আর আপনি তো এত ভালো লেখেন। তবে বই বের করুন।

বকুল:           প্রকাশক পাব না।

রাধা:            আপনি কি খোঁজ করেছেন?

বকুল:           সব জানা আছে। নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে বই বের করতে হবে।

রাধা:            করুন। তাছাড়া সোশ্যাল-নেটওয়ার্কিং-সাইটেও লেখা আপডেট করতে পারেন।

                 অনেকেই করে।

বকুল:           ওসব সস্তা মোহের মধ্যে আমি নেই। ছাড়ুন ওসব। অন্য কথা বলুন।

রাধা:            অমনি কথা ঘোরাচ্ছেন? আচ্ছা, একটা সত্যি কথা বলবেন বকুল-দা?

বকুল:           কী কথা!

রাধা:            আগে বলুন বলবেন।

বকুল:           হুঁ, বলব।

রাধা:            আমি কি আপনাকে বোর করছি?

বকুল:           হঠাৎ এ কথা!

রাধা:            আমি কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছি, আপনাকে কোন বিষয়ে চেপে ধরলেই এড়িয়ে

                যাচ্ছেন। অসুবিধা হলে স্পষ্ট বলতে পারেন, আর জ্বালাতন করব না।

বকুল:           হুমম, কী করবেন আমার সম্পর্কে জেনে?

রাধা:           এ মা! আপনি একজন লেখক মানুষ হয়ে এটুকুও জানেন না! মানুষ মানুষের কথা কেন জানে? বন্ধু বন্ধুর কথা কেন জানে?

বকুল:           বন্ধু!

রাধা:            কেন! আমার সঙ্গে বন্ধুত্বে আপনার আপত্তি আছে?

বকুল:           রাধা!

রাধা:            হ্যাঁ বকুল-দা।

বকুল:           আ-আপনি কী চান?

রাধা:            আপনি কী করেন? আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?

বকুল:           আমি বাংলার অধ্যাপক।

রাধা:            সে তো জানি। আর বাড়িতে কে কে আছেন?

বকুল:           কেউ না। বছর পাঁচেক আগে আম্মী মারা গেছেন।

রাধা:            বিয়ে করেননি? কাউকে ভালোবাসেন?

বকুল:           বিয়ে...! সে অনেক কথা... তখন ১৯৭৮ সাল। আমার ছাব্বিশ বছর বয়স... ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু হত্যা... ১৯৭১ স্বাধীনতা... ১৯৫২, ২১শে ফেব্রুয়ারি শহিদদিবস... ভাষাশহিদ...

 

[ফ্ল্যাশব্যাক]

বকুল:           ক্যামেলিয়া

                শুধুই অর্কিড তুমি

চেতনাহীন সজীব
প্রেমিকা কি নও!

নইলে কীসের জোরে

জিতে নিলে অমরতা
জানি সুন্দরী, রূপসী তুমি
তবু সকলেই পেয়েছে কি
তাঁর সৃষ্টির ছোঁওয়া?

কোন সে জাদুর টানে

মানবিক হলে
ছুঁয়ে গেলে ঘনিষ্ঠ আবেগে
আজ তবে আসবে না কেন
সংগোপনে হৃদয়ে আমার?

ক্যামেলিয়া:      বকুল, একা একা বসে কী করা হচ্ছে শুনি?

বকুল:          ওঃ ক্যামেলিয়া, এসো। বিশেষ কিছু না, একটু লেখালিখির চেষ্টা করছিলাম।

                অকাজ বলতে পারো।

ক্যামেলিয়া:      কী লিখছিলে দেখি।

বকুল:           কবিতা, দেখার মতো নয়। তার থেকে তোমার খবর বলো। কেমন আছ?

ক্যামেলিয়া:      খুব ভালো। আগে দেখাওদেখাও দেখাও...

বকুল:           এই এই, না না শোনো...

ক্যামেলিয়া:      ক্যামেলিয়া

 

নিছক অর্কিড তুমি

চেতনাহীন সজীব
প্রেমিকা কি নও!
উঁ উঁ... উঁ উঁ...

আবার আমার নামে প্রেমের কবিতা!

বকুল:           মোটেই এটা তোমার নামে নয়।

ক্যামেলিয়া:      হা হা হা। এটা আমার নাম নয়? তোমার মাথাটা এক্কেবারে খারাপ হয়ে গেছে

                বকুলক্যামেলিয়া আমার নাম নয়! হা হা হা... হাসালে...

বকুল:          হ্যাঁ, ক্যামেলিয়া তোমারই নাম কিন্তু পৃথিবীতে শুধু তোমার একারই নাম নয়।

                তাছাড়া এ অন্য ক্যামেলিয়া।

ক্যামেলিয়া:      কোন ক্যামেলিয়া শুনি।

বকুল:     রবীন্দ্রনাথের ক্যামেলিয়া। তুমি তো কখনও ঢাকায় যাওনি। গেলে বলদা  গার্ডেন অবশ্যই  ঘুরে এসো।

ক্যামেলিয়া:      কী করে যাব? কে নিয়ে যাবে পথ চিনিয়ে?

বকুল:           কেন! পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে ঘুরে এসো।

ক্যামেলিয়া:      ছাড়বে না অপরিচিত জায়গায়। তাছাড়া অত সাহসও নেই আমার। তুমি নিয়ে

                গেলে তবেই যাব।

বকুল:           আ-আমি...?

ক্যামেলিয়া:      হ্যাঁ, হ্যাঁ তুমি মশাই তুমি। সহযাত্রিণী হিসেবে আমিও মন্দ নই মোটেই।

বকুল:           কী সব বলছ! তুমি তুমি তুমি অপরূপা, কিন্তু... না না, আমার কথা বাদ দাও।

ক্যামেলিয়া:      কেন! বাদ দেব কেন? ব্রিলিয়ান্ট স্কলার তুমি। এম.এ.-তে ফার্স্টক্লাস পেয়ে রিসার্চ  করছ। কদিন বাদেই প্রফেসর হবে। তুমি কীসে কম শুনি।

বকুল:      আমার এখন অনেক কাজ। আমাকে সৎভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে,  ফাঁকতালে নয়। অনেক স্বপ্ন, অনেক দায়িত্ব। চাকরি করব, ছাত্র পড়াব, আম্মীকে... এখন... অন্যকিছু! না।

ক্যামেলিয়া:      আচ্ছা বকুল, তুমি দেশে যাবে কবে?

বকুল:           আমি তো দেশেই আছি।

ক্যামেলিয়া:      আমি বাংলাদেশের কথা বলছি।

বকুল:         আচ্ছা পশ্চিমবঙ্গ-ভারতবর্ষ কি আমার দেশ নয়? পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ, বাংলাভাষী  যে-কোনো বাঙালির দেশই, আমার দেশ। বঙ্গবন্ধুর নির্বাসিত দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাও তো ভারতের আশ্রয়ে দিল্লিতেই আছেন।

ক্যামেলিয়া:      তুমি কেবল ছুতো করে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ।

বকুল:           আহা কী মুশকিল! এড়িয়ে গেলাম কোথায়? তুমি বুঝতে পারছ না!

ক্যামেলিয়া:   জানো সেদিন স্বপ্ন দেখলাম... সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা গ্রামবাংলা... ভারত-বাংলাদেশ যেন এক হয়ে গেছে, মাঝে আর কাঁটাতার নেই।

বকুল:           সত্যি যদি তেমন হত!

ক্যামেলিয়া:      তেমন আর হবে না, না?

বকুল:           হুঁ! তবে কি আর বঙ্গবন্ধুকে অমন করে মরতে হত!

ক্যামেলিয়া:    বকুল, তুমি রাজনীতি কর-না কেন...? নতুন প্রজন্মই তো চিরকাল দিন-বদল  করেছে! তুমিও চাইলেই অনেক স্বপ্ন সফল হতে পারে।

বকুল:           সবকিছু সবার জন্য নয় ক্যামেলিয়া। নেতা হওয়ার সাধ বা সামর্থ্য কোনটাই আমার নেই। আর এখন কী আছে বাংলাদেশে!

ক্যামেলিয়া:      বাংলাদেশটা তো আছে।

বকুল:        মুক্তিযুদ্ধের ন’টা মাসে প্রায় সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের নিধন করেছে পাকিস্তানি সেনা। এমনকি বাঙালির সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানি আখ্যা দিয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপন এবং রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসবও বন্ধ করে দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার।

ক্যামেলিয়া:      চালু তো হয়েছে।

বকুল:         ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পর বাংলা নববর্ষ উদযাপন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়। বিদ্রোহীকবি কাজী নজরুল ইসলামকে মুসলিম কবির আখ্যা দিয়ে একটা সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার খেলা খেলার অপচেষ্টা করেছিল। তাতে কিছুটা সুবিধা করতে পারলেও বাঙালির অন্তরের ভালোবাসা রবীন্দ্রনাথের জন্য এতোটুকু কমেনি, বরং উভয় কবিকেই প্রবল ভালোবাসায় আপন করে নিয়েছে বাংলাদেশ ১৯৬১-তে রবীন্দ্র জন্মশত-বার্ষিকী উদযাপনে দেশের মানুষ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারপর ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।

ক্যামেলিয়া:      তবে তুমি নেগেটিভ ভাবছ কেন সব!

বকুল:        স্বাধীনতার পর একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন, অন্যদিকে অধিকাংশ  মানুষ নিজের নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। আমি কনফিউজড ক্যামেলিয়া।

ক্যামেলিয়া:      কেন এত কনফিউশন বকুল!

বকুল:          হিন্দু সম্প্রদায়, দরিদ্র মুসলিম তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো জীবনধারণ করছে। তুমি জানো শুধুমাত্র প্রাণের তাগিদে কত হিন্দুকে সর্বস্ব ছেড়ে রাতারাতি উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসতে হয়েছে! কত হিন্দুকে লুকিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হয়েছে! হুঁ! যেখানে রাতের অন্ধকারে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, সেখানে গণতন্ত্র, মানবতা আশা করা যায় না ক্যামেলিয়া।

ক্যামেলিয়া:      হবু অধ্যাপক, হতাশা তোমাকে মানায় না বন্ধু।

বকুল:           বন্ধু!

ক্যামেলিয়া:       নয়তো কি শত্রু?

বকুল:        না ক্যামেলিয়া, হতাশা নয়।  ওই সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আমি থাকতে চাই না।  সেজন্যই তো ভারতে এসেছি। কোন চালাকির আশ্রয়ে বাঁচতে চাই না আমি। পড়াশোনা করে যোগ্যতার সঙ্গে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করব। শিক্ষকতা আমার আদর্শ। বছরে একটি-দুটি ছাত্রও যদি তৈরি করতে পারি, যদি তাদের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ, আদর্শ জাগিয়ে তুলতে পারি, সেই হবে আমার পরম সার্থকতা।

ক্যামেলিয়া:     তুমি অবশ্যই পারবে বকুল, অবশ্যই পারবে। বাংলাদেশও দেখো একদিন ঠিকই  ঠিক হয়ে যাবে।

বকুল:         হয়তো... হয়তো আবার একদিন বাঙালির এক-সমুদ্র রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ তার গণতন্ত্র ফিরে পাবে। নানান পরীক্ষানিরীক্ষায় বাংলাদেশের জনগণতন্ত্র হয়তো সুশীল হবে একদিন। কিন্তু ততদিনে হয়তো আমি শেষ হয়ে যাব। তবু... প্রতীক্ষায় থাকব, শেষ হোক বিতর্কিত অধ্যায়।

ক্যামেলিয়া:      আচ্ছা বকুল, মুক্তিযুদ্ধের সময় তুমি কোথায় ছিলে? তোমার ভূমিকা কী ছিল?

বকুল:          হ্যাঁ...? মুক্তিযুদ্ধ? ঢাকাতেই ছিলাম, গৃহবন্দি হয়ে, চোখের সামনে দিয়ে  মুক্তিযুদ্ধের ঢেউ আছড়ে পড়েছে সারাদেশে অথচ আমি...

ক্যামেলিয়া:      সে কী! কেন?

বকুল:           আম্মীর নিষেধ, দিব্যি দিয়েছিল। আমি ছাড়া আর যে কেউ নেই তার।

ক্যামেলিয়া:      কিন্তু কেন!

বকুল:         সেসব অনেক কথা... জানো ক্যামেলিয়া... আমি জানি না আব্বু কেমন...! আব্বুর আদর কেমন হয়? আমার জন্মের তিনমাস আগে পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে আব্বু শহিদ হন। ভাষাশহিদ রফিকুল ইসলাম১৯৫২ সাল, ২১শে ফেব্রুয়ারি।

ক্যামেলিয়া:      এ তো গর্বের কথা!

বকুল:        কিন্তু লেখা নেই, সরকারি খাতায় তিনি নিখোঁজ। গর্বই বটে! আব্বু তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকুও পাননি। পাকিস্তানি পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে জোর করে বন্দুক উঁচিয়ে অনেক লাশ গুম করে দেয়। আব্বু তার মধ্যে একজন। আব্বুর লাশও দাফন করা যায়নি। হয়তো আব্বুর লাশ শেয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খেয়েছে। বরকত, জব্বার, রফিক, সালাম, শফিউর, আব্দুল, অহিউল্লাহ আরও কত কত তাজা প্রাণ, ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে। আর আমার আব্বু... । প্রতিবছর শহিদদিবসে সকলের মতো আমরাও যাই, শহিদ-বেদিতে মালা দিয়ে, জানা-অজানা সকল শহিদদের আত্মার শান্তিকামনা করি, সেইসঙ্গে আমার আব্বুর... আব্বু নিশ্চয়ই আসমান থেকে দেখে। আচ্ছা আব্বু কি আমাকে চিনতে পারে?

ক্যামেলিয়া:    বকুল শান্ত হও। আব্বুর জন্য আমার গর্ব হচ্ছে, আমিও আব্বুর আত্মার শান্তি  কামনা করি।

বকুল:           আব্বু... আমার আব্বু...

ক্যামেলিয়া:      বকুল বকুল, কী ছেলেমানুষি করছ? শান্ত হও বকুল।

বকুল:         এই বিশাল নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আম্মী একা কীভাবে যে নাকানিচোবানি খেতে খেতে  আমাকে মানুষ করেছেন, আমার মনে স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছেন, তা শুধু আম্মী জানেন আর হয়তো আল্লাহ জানেন।

ক্যামেলিয়া:      মায়েরা এমনই হয়। বকুল...

বকুল:           হুঁ...

ক্যামেলিয়া:      একটা কথা বলব? যদিও এখনই এমন কথার সময় নয়, তবু...

বকুল:           কী কথা? বলো... হেজিটেড করছ কেন!

ক্যামেলিয়া:      ভাবছি মা’কে বলব তোমার কথা, দিদিকে বলেছি।

বকুল:           কী বলেছ!

ক্যামেলিয়া:      বাবা-মা সেদিন বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করছিল।

বকুল:        ভালো তো!  আমাকে নিমন্ত্রণ করবে না?  তোমাদের বিয়েতে তো অনেকরকম  আচার-অনুষ্ঠান থাকে। পুরোটা আমার দেখার ইচ্ছে রইল। ছেলের বাড়ি কোথায়, কী করে?

ক্যামেলিয়া:      বাবা-মা’র পছন্দ করা ছেলেকেই যদি বিয়ে করব, তোমার সঙ্গে গল্প করতে যাব  কেন?

বকুল:           মানে!

ক্যামেলিয়া:      তুমি কি কচি খোকা নাকি! কিছু বোঝো না?

বকুল:           না, বুঝি না। যা বলার স্পষ্ট করে বলো।

ক্যামেলিয়া:      এর থেকে স্পষ্ট করে বলার কিছু নেই। আমি কি এমনি এমনি তোমার কাছে ছুটে আসি? এমনি এমনি তুমি আমাকে নিয়ে কবিতা লেখ? এমনি এমনি তুমি আমাকে সময় দাও?

বকুল:          বন্ধুত্ব আর প্রেম এক নয় ক্যামেলিয়া। এতদিন তোমাকে আমি বন্ধু বলেই ভেবে  এসেছি।

ক্যামেলিয়া:      এখন থেকে অন্যকিছু ভাবো।

বকুল:           কী পাগলামো করছ? তা হয় না ক্যামেলিয়া তা হয় না।

ক্যামেলিয়া:      কী আমি পাগল! আমার প্রেম, আমার ভালোবাসা পাগলের প্রলাপ?

বকুল:       কেন বুঝতে চাইছ না? তোমার সমাজ আমার সমাজ আলাদা। তোমার সমাজ  আমাদের মেনে নেবে না। অনেক গ্লানির মধ্যে পড়তে হবে তোমাকে। জীবনটা ছেলেখেলা নয়।

ক্যামেলিয়া:     ছেলেখেলা আমি করছি না। এইই তুমি ধর্মনিরপেক্ষতার বড়াই করো! এই তুমি  নিজেকে অসাম্প্রদায়িক বলো! হিপোক্রিট তুমি।

বকুল:          ক্যামেলিয়া! অবশ্যই আমি ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক। ধর্মান্ধতা মানি না আমি।  আমি বিশ্বাস করি, ধর্ম, ধর্মের গোঁড়ামি সব মানুষের তৈরি। পৃথিবীতে আগে মানুষ পরে ধর্ম। মানবতাই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু... কিন্তু তার জন্য আমি কাউকে সামাজিক অনিশ্চয়তার মধ্যে টেনে নামাতে পারি না।

ক্যামেলিয়া:    পৃথিবীতে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে আগে হয়নি?  নজরুল বিয়ে করেননি  প্রমীলাকে?

বকুল:           নজরুল আর আমি এক নই।

ক্যামেলিয়া:     বেশ! সে তোমার ব্যাপার। তবে তুমিও জেনে রাখো, অন্য কাউকেই আমি বিয়ে করব না। আর তুমি আমাকে খুঁজেও পাবে না।

 

[ফ্ল্যাশ-ফরোয়ার্ড]

 

রাধা:            তারপর? বিয়ে করলেন?

বকুল:           হুমম করলাম, রেজিস্ট্রি ম্যারেজ।

রাধা:            আম্মীকে আনলেন? কী বললেন আম্মী?

বকুল:          বিয়ের পর ওকে নিয়ে দেশে গেলাম। আম্মী আদর করে বরণ করে নিলেন। বেশ  চলছিল জানেন, কিন্তু...

রাধা:            কিন্তু কী!

বকুল:           মৌলবাদীদের আগ্রাসনের হাত থেকে ওকে বাঁচাতে পারলাম না।

রাধা:            ও মা! কী বলছেন!

বকুল:          একদিন বিকেলে বেড়াতে বেরিয়েছি। বসন্তকাল, আকাশে-বাতাসে তার সমারোহ,  প্রকৃতি যেন উজার করে দিয়েছে। দুজনে হাঁটছি পাশাপাশি, হাত ধরাধরি করে... খুব এনজয় করছিলাম আমরা, হঠাৎ... হয়তো আমাকেই, কিন্তু টার্গেট মিস করে একটা বুলেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল ওকে। আমার বুকে মাথা রেখে, আমারই কোলের মধ্যে... সব শেষ হয়ে গেল।

রাধা:            পুলিশ-প্রশাসন কিছু বলল না? মামলা করলেন না?

বকুল:           তখন ওখানে একনায়কতন্ত্র, কে কার কথা শোনে?

রাধা:            তারপর কী করলেন?

বকুল:           কী আর করব! আম্মীকে নিয়ে চলে এলাম দেশ ছেড়ে। সেই থেকে এই-ই আছি।

রাধা:            বদলা না নিয়ে এভাবে চুপচাপ ছেড়ে দিলেন!

বকুল:         আমার আদর্শ অন্য কথা বলে রাধা।  হিংসা দিয়ে হিংসাকে জয় করা যায় না।  এখন মানবাধিকার, আইন-সালিশি, নারীবাদ অনেক এগিয়েছে, তবু সুকৌশলে সবই পুরুষতন্ত্রের হাতের পুতুল।

রাধা:            কেন! শেখ হাসিনা তো ওখানকার প্রধানমন্ত্রী।

বকুল:         একা হাসিনা কী করবেন, মানুষের বিবেক যদি না জাগে? লোভ, সবকিছুর মূলে  আছে মানুষের অন্তহীন বস্তুগত লোভ। সব থেকে খারাপ কী লাগে জানেন?

রাধা:            কী?

বকুল:        মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে গিয়ে যে দেশ স্বাধীনতা অর্জনের পথে এগিয়ে গেল,  ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিল, বিশ্বের মধুরতম ভাষারও শিরোপাও যার দখলে। সেই বাংলাভাষারই আজ অবহেলা! যেটুকু আছে, সবই লোকদেখানো বাহ্যিক উৎসব, প্রাণের তাগিদ যেন হারিয়ে গেছে। সরকারের তরফে বলছি না, কিন্তু সাধারণ জনগণ মনে মনে বিদেশি ভাষার গোলামিই যেন বেশি পছন্দ করছে।

রাধা:            আচ্ছা এই যে উৎসব, উৎসবে স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান, এই যে প্রাণের আবেগ, এ কি এমনি এমনি হয়!

বকুল:       আমরা পলিমাটির সন্তান রাধা, আমাদের আবেগ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু...  সবকিছুর মধ্যেই কোথায় যেন একটা বিরাট বড়ো ফাঁক থেকে যাচ্ছে, যা হয়তো আর কোনদিনই পূরণ হবার নয়। আসলে দিনদিন জাত্যভিমান, দেশপ্রেম হারিয়ে ফেলছে, স্বার্থপরতা গ্রাস করছে সব।

রাধা:            সরি, না জেনে তোমাকে আঘাত দিলাম।

বকুল:           রাধা!

রাধা:       হ্যাঁ... তোমাকে তুমি বললে আপত্তি করবে? আবেগ থেকে বলছি না, যথেষ্ট  ভেবেচিন্তেই বলছি।

বকুল:           দাউদাউ আগুনের মতো দুর্ভাগ্যের সঙ্গে কেন নিজেকে জড়াতে চাইছেন?

বকুল:        আগুনের সঙ্গে আগুন মেলে ভালো আর ওই যে বই প্রকাশ করবে বলে, চলো আজই  তোমাকে নিয়ে বেরবো।

বকুল:           কিন্তু...

বকুল:         আমি কোন কথাই আর শুনব না। আজ থেকে আমিই তোমার লোকাল গার্জেন,  চলো।

বকুল:           চলো...

 

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)