বাতায়ন/হাপিত্যেশ/ছোটগল্প/২য়
বর্ষ/৫ম সংখ্যা/৩২শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
হাপিত্যেশ | ছোটগল্প
শ্রীময়ী গুহ
রিয়েলি ইউ আর টুউউউ হট
"এক বন্ধু আমাদের বৌভাতের সন্ধ্যাবেলায় আমাকে হাঁ করে দেখছিলেন, উনি কবিটবি ছিলেন বোধহয়! তেমনই তো বলেছিলেন তোমাদের দাদু, তেনারা ছিলেন ছোটবেলার অভিন্নহৃদয় বন্ধু। আমি তো ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ি একগাদা লোকজনের সামনে, চোখ নামিয়ে ফেলি। উনি দেখেই যাচ্ছিলেন দেখেই যাচ্ছিলেন! মরণ! বিরক্তিকর বাবা। তাআআআ! তোমাদের দাদু রাতের বেলায় আমাকে বললেন, ফিশফিশ করে"
"এক বন্ধু আমাদের বৌভাতের সন্ধ্যাবেলায় আমাকে হাঁ করে দেখছিলেন, উনি কবিটবি ছিলেন বোধহয়! তেমনই তো বলেছিলেন তোমাদের দাদু, তেনারা ছিলেন ছোটবেলার অভিন্নহৃদয় বন্ধু। আমি তো ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ি একগাদা লোকজনের সামনে, চোখ নামিয়ে ফেলি। উনি দেখেই যাচ্ছিলেন দেখেই যাচ্ছিলেন! মরণ! বিরক্তিকর বাবা। তাআআআ! তোমাদের দাদু রাতের বেলায় আমাকে বললেন, ফিশফিশ করে"
-বেএএএএএএশ লাগছে
কিন্তু!
চুক চুক করে পুরোটা
চিকেন স্ট্যু, আয়ার হাত থেকে শেষ করে, গাল তোবড়ানো ফোকলা মাড়ির, চোখ কোটরে বসা
প্রায় কঙ্কালসার বুড়ি মুখটা এগিয়ে দিল, কোঁচকানো ঠোঁট দুটো উঁচু করে
- মুছিয়ে দাও!
- আহা-হা! দিদা ঝ্যানো
ছেলফি দিচ্ছেন গো!
বলে মুচকি হেসে মুখ
মুছিয়ে দিল রানু আয়া
- এবার চুপটি করে শুয়ে
পড়ো দিকিনি।
- জানো! এই যে মুখ
করলাম, এটাকে বলে পাউট, দিদিভাইরা বন্ধুরা মিলে ফটো তোলে, বৌমা আর আমার মেয়েরাও
তোলে তো— আর এমন উঁচু ঠোঁট হলে নাকি খুব ভাল লাগে জানো? হট! হট লাগে বুঝলে!
একটু গলা নামিয়ে বলল
বৃদ্ধা,
- শোনো! কানেকানে বলি,
তোমাদের দাদুর এক বন্ধু আমাদের বৌভাতের সন্ধ্যাবেলায় আমাকে হাঁ করে দেখছিলেন, উনি
কবিটবি ছিলেন বোধহয়! তেমনই তো বলেছিলেন তোমাদের দাদু, তেনারা ছিলেন ছোটবেলার
অভিন্নহৃদয় বন্ধু। আমি তো ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ি একগাদা লোকজনের সামনে, চোখ নামিয়ে
ফেলি। উনি দেখেই যাচ্ছিলেন দেখেই যাচ্ছিলেন! মরণ! বিরক্তিকর বাবা। তাআআআ! তোমাদের
দাদু রাতের বেলায় আমাকে বললেন, ফিশফিশ করে,
- অত রাগলে কেন গো তখন?
তোমাকে হট লাগছিল তো, তাই ও দেখছিল।
আমি যে নতুন বৌ, সেটা
ভুলে গিয়ে চোখ তুলে বরের দিকে তাকিয়ে বললাম-
- হট কী গো? মানুষ হট
হয়? এবাবা! ছি! ছি! ওসব তো বিচ্ছিরি পাড়ার কথা! তুমি বলছ কেন?
তোমাদের দাদু বললেন,
- বিচ্ছিরি কেন হবে গো?
তোমাকে সত্যিই হট লাগছিল—
- সত্যি বলছি রানু,
আমার অবস্থা তখন কেমন যেন হয়ে গেল এ কথা শুনে! আমি কোথায় লুকাই তখন লজ্জায়! নতুন
বৌ আমি শ্বশুরবাড়ি ভর্তি লোকজন, শাশুড়ি মায়ের দমক কী! বাপরে বাপ, এমনি বকেননি
অবশ্য সবে তো ঢুকেছি এ বাড়িতে তখন, বেশিরভাগ আত্মীয়কে চেনাই হয়নি, তখন তো আর
এখনকার মতো নিজেরা দেখে বিয়ে হত না, সম্বন্ধ করেই হত। আমারও তাই। উনি বয়সে কত
বড় কেমন ভয় ভয় লাগছিল জানো ফুলশয্যার রাতে প্রথম যখন কথা বলছিলেন। তবে মানুষটা
খুব সহজ। কেমন হেসে হাসিয়ে গল্প করে আমার ভয় ভাঙিয়ে দিলেন কিন্তু বাড়ির
অন্যরা? কে জানে কেমন… এই চিন্তা খেয়ে যাচ্ছিল আমায়। তবে পরে পরে সবাই আপন করে
নিয়েছিল, ভুলচুক হয়নি বা মন কষাকষি হয়নি তা নয় কিন্তু আবার মিলেমিশে যেতাম।
বড্ড ভাল ছিল গো তখন, এত লোকজনের মাঝে একা একা কখনও মনে হত না। আর ওই হট? উনি সেই
রাত থেকেই, যখনই আমি রেগে যেতাম বা শাশুড়ি মা বকেছেন বলে মুখ ভার করে জানলার
খড়খড়ি ধরে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করতাম— পিছনে এসে কানের কাছে বলতেন,
- আহা কাঁদলে তুমি আরোও
হট!
- আর আমি ফিক করে হেসে
ফেলতাম জানো!
- দিদা তুমি তো তাইই
গো! ওই যে হট... হি হি হি!
বলে ফিক করে হাসে রানু
আয়া। বৃদ্ধা বেশ গম্ভীর হয়ে বলেন,
- থাক হয়েছে আর হাসতে
হবে না। শোনো! এখন যে ঠোঁটটা করলাম ওটার মানে জানো? অ্যাঞ্জেল জুলি গো! অ্যাঞ্জেল
জুলি! সিনেমা করে, যাক গে, ওসব তুমি বুঝবে না। ইংরেজি সিনেমা তো! আমি জানি! দেখেছি
কতোওওওওওওও!
আয়া হেসে বলে-
- ওমাআআআ! তাই নাকি?
তুমি তাহলে ঐ জুলি দিদা! তা দাদু তো ওপর থেকে দেখতেছে, না গো দিদা?
- ফাজলামি করছ?
***
- মা! পুজো হয়েছে?
খাবার দেব?
- থাক! তোমার আর দিয়ে
কাজ নেই। আমি নিজেই নিয়ে নেব ‘খন, ওসব তোমাকে ঘাঁটতে হবে না, সব ছোঁয়ানাড়া করবে
তুমি।
ভীষণ বিরক্তির সাথে বলে
উঠলেন শাশুড়ি মা তাঁর বৌমাকে,
- না মা আমি তো
- বললাম তো থাক! ওসব
মাছ-মাংসের ছোঁয়ায় আমার অসুবিধা হয়।
- কিন্তু মা! ডাক্তারবাবু
তোমাকে মাছ মাংস ডিম খেতে বলেছেন। তোমার আগের অভ্যাস মাছের ঝোল ভাত, হঠাৎ করে সেটা
ছেড়ে দিলে যে প্রোটিনের ঘাটতি হবে মা। এই বয়সে বেশি শরীর খারাপ হবে। আর মা! বাবা
যদি থেকে যেতেন, তুমি আগে চলে যেতে তাহলে বাবা কী সব ছেড়েছুড়ে—!
- কীইইই সব অলুক্ষণে
কথা তোমার অ্যাঁ! কে আগে যেত, কে থাকত, এত কথা তোমার না বললেই নয়? আর পুরুষ
মানুষের আবার ছোঁয়ানাড়া বিচারে কিছু হয় নাকি? অদ্ভুত! আমি বিধবা, এখন এসব খেতে
অস্বস্তি হয়, লোকে শুনলে… ছি! ছি! আর ভালও বাসি-না আমি। তুমি যাও নিজের কাজে, আমাকে
বিরক্ত কোরো না তো এখনও পুজোর বাকি আছে অনেক, শুধু শুধু বকবক করে বেলা করিও না
আমার আর। বাপের বাড়ি থেকে এটুকু শিখে আসোনি? আজকালকার মেয়ে-বউরা যেন কেমন! ধূপের
গন্ধ ছাপিয়ে যেন হালকা মাছের ঝোলের গন্ধ ভেসে আসছে, ধূপটা খোকা এবার চন্দনের
আনেনি, কড়া গন্ধওলা ধূপ আনাতে হবে এবার। মনোনিয়োগ করতেই হবে পুজোতে, আচার-বিচারে,
গুরুদেবের আদেশ। শুদ্ধাচারে রাখতে হবে নিজেকে। আবারও গন্ধ আসে নাকে, এই তো কিছুদিন
আগেও পাতের পাশে ছোট্ট এক টুকরো মাছ না দেখলে গলা দিয়ে ভাতই নামত না, আর আজ! নাহ্
নাহ্! ছি! ছি! এসব আবার ভাবার বিষয় নাকি? নারায়ণ কৃপা করো! ঠাকুর! গন্ধ নেব না
ওসব! ঠাকুর পাপ দিও না!
***
- কোথায় নিয়ে যাচ্ছ
আমাকে বৌমা? কোথায়? আমি পড়ে গেছিলাম? নাকি মরেই গেছিলাম?
কেউ কিচ্ছু বলে না! মুখ
গম্ভীর সব্বার। কেমন যেন থমকে দেওয়া সময়! কঠিন বড্ড শ্বাস নেওয়া তখন! ডুবে যেতে
যেতেও আবার ভেসে উঠলেন বৃদ্ধা। ক'দিন প্রায় অচেতন থেকে, আবার সাইরেন বাজিয়ে
বাজিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে করে বাড়িতে ফেরৎ।
- মা! খেয়ে নাও! নইলে
উঠতে পারবে না!
- উঁ?...
জিজ্ঞেস করতে গেলেন
বৃদ্ধা, গলা দিয়ে শব্দ বেরোলো না কিন্তু বৌমা বুঝল ঠিকই
- চিকেন স্ট্যু।
একটু খানি চুপ করে,
বৌমাটির মুখের দিকে তাকিয়ে হাঁ করলেন বৃদ্ধা।
- বৌমা! মাছের ঝোল ভাত
কবে দেবে? বড্ড ভালবাসতাম গো। এমন ভাবে পড়ে থেকে তোমাদের কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না
জানো! যাওয়ার আগে স্বাদটা আবার নিয়ে যাই। সত্যিই তো! তোমাদের বাবা যদি থাকতেন আর
আমি চলে যেতাম উনি কী এসব মানতেন? আমি আবার আমার মাধবীলতা, টগর, জুঁই, বেলি, জবা
গাছেদের দেখতে চাই! বৌমা! আবার তোমার সাথে একটু ঝালটক ঝগড়াও চাই যে! আবার খোকা
এলে সব্বার নামে নালিশও করতে চাই। বৌমা! আমার সব ভুলগুলো শুধরে নিতে চাই। তুমি
সুযোগ দেবে আরেকবার ভাল বন্ধু হওয়ার? সুযোগ দেবে তো জীবন আবার আমাকে?
শুকনো শীর্ণ হাত দুটো
দিয়ে বৌমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরেন চোখ ছলছলে বৃদ্ধা শাশুড়ি!
- জীবনটাই যে হট গো!
টের পেয়েছি যখন শ্বাস নিতে পারছিলাম না। বড্ড দরকার এই উত্তাপটার! এই যে ছুঁয়ে
আছো তুমি, এইটার, বড্ড দরকার এটা শোনার যে, হ্যাঁ! এখনও তুমি খুব হট!
বৌমা হেসেকেঁদে জড়িয়ে
ধরে শাশুড়িকে।
- মা! রিয়েলি ইউ আর
টুউউউউ হট!
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment