বাতায়ন/হাপিত্যেশ/গদ্য/২য়
বর্ষ/৫ম সংখ্যা/৩২শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
হাপিত্যেশ | গদ্য
পিয়ালী সেন
হাপিত্যেশের গল্পেরা…
"পিসিরবাড়ির পাড়ার কাজলদিদি বলেছিল জোনাকির বন দেখাবে, যেখানে শয়ে শয়ে জোনাকির দেখা মেলে, হাত বাড়ালেই আঙুলের ডগায় এসে বসে তারা, জ্বলে আর নেভে"
আমাদের ছোটবেলাটা ছিল তাল-নারকেল পাতার
ছায়া ঘেরা। সকালে তাদের শীতল ছায়া জুড়িয়ে দিত শরীর, সন্ধে নামলে ছায়ারা হতো দীর্ঘতর—
শাঁখের আওয়াজের সাথে সাথে জানিয়ে দিত খেলার পালা শেষ করে আমাদের সময় হয়েছে বাড়ি ঢোকার;
আর রাত গভীর হলে সেই ছায়াই সারা কুয়োতলা জুড়ে লুটোপুটি খেত; শিশু মনগুলোতে সঞ্চার করত
শিরশিরানি এক ভয়ের! হাপিত্যেশ করে বসে থাকতাম সকালের... কখন দিনের আলো ফুটবে আর চেনা
চেনা নারকেল, তাল, সুপুরিগাছের সারি মাথা হেলিয়ে চেনা ছন্দে অভিবাদন জানাবে আমাদের।
সেই আমার প্রতীক্ষার শুরু… সেই আমার হাপিত্যেশ করে বসে থাকার সূচনা।
ছোটবেলায় আমরা প্রায় সব ভাইবোনেরাই পড়াশোনা শুরু করেছিলাম স্থানীয় একটি ছোট স্কুলে। স্কুলের পাশেই ছিল শীতলা মায়ের মন্দির। মন্দিরে প্রতি শনিবারে গ্রহরাজের পুজো হতো, এছাড়া ছিল বেশ বড় একটি মা কালীর বিগ্রহ… সেখানেই আমার পরিচয় ঘন্টাদাদুর সাথে। সামান্য খাটো করে পরা সাদা ধুতি ও আধময়লা ফতুয়া গায়ে প্রতিদিন মানুষটি মন্দির প্রাঙ্গণ জল দিয়ে ধুতেন, যত্ন করে মুছতেন, আর তারপরেই দুহাত মাথায় তুলে "মা মা" বলে সটান উপুড় হয়ে পড়তেন মন্দির প্রাঙ্গণে। সে ডাকে এমন এক আন্তরিকতা, এমন এক আর্তি মিশে থাকত যা চোখ বুজলে অনায়াসে আমি আজও অনুভব করতে পারি। তখন অবশ্য আমার সেসব নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল না, বরং যাবতীয় আগ্রহ ছিল নাগালের বাইরে থাকা মন্দিরের ঘন্টার দিকে। লাফিয়ে লাফিয়ে সেটা বাজাবার বৃথা চেষ্টা করতাম রোজ আর দাদু হাসতে হাসতে এসে আমায় কোলে করে উপরে তুলে ধরতেন। একদিন দাদুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি ঠাকুরকে এত জোরে জোরে ডাকেন, ঠাকুর কি সাড়া দেন? উত্তরে দাদুর চোখে-মুখে অদ্ভুত এক আলো দেখেছিলাম… বলেছিলেন "শুধু সাড়াই দেন না রে, মা আমার সাথে কথা বলেন, আমার কথা শোনেন।" সত্যি বলতে একেবারেই বিশ্বাস হয়নি সেসব কথা... এমনিতেই বাড়িতে বড়দের দেখতাম স্নান করে, জামা ছেড়ে তবে পুজোয় বসতে আর দাদু তো ময়লা জামাকাপড় পরেই, হাত-পা ভাল করে না ধুয়েই ঠাকুরের কাছে চলে যেতেন! এমন করলে ঠাকুর কিছুতেই তাঁর সাথে কথা বলতে পারেন না... একদিন বলেও বসলাম সে কথা... বললাম 'তুমি বলো মা কথা বলেন তাহলে আমি শুনতে পাই না কেন!" দাদু মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন "একদিন তুইও শুনবি, তোকেও শোনাব আমার পাগলি মায়ের কণ্ঠ" সেই থেকে হাপিত্যেশ করে বসে আছি দাদু... তোমার সাথেও আর দেখা হলো না, সে কণ্ঠস্বরও শোনা হলো না...
একদম ছোটবেলার দিনগুলো ছিল জ্যাঠা, জেঠিমা, কাকা, পিসি, দিদি, দাদা, পাড়ার বন্ধু, পাশের বাড়ির কাকিমা; যাকে বলে সবাইকে নিয়ে একদম জমজমাট সংসার। তারই মধ্যে আমি ছিলাম আমার বড় জ্যাঠার বিশেষ প্রিয় পাত্রী। শরীরচর্চার জন্য বাবা কাছেই একটি ক্লাবে ভর্তি করে দিয়েছিলেন, কিন্তু ক্লাব থেকে আমায় বেশিরভাগ দিনই আনতে যেতেন জ্যাঠা। আমিও তাঁকে হাজমোলা কিনব, চানাচুর কিনব, হজমি কিনব বলে যথেচ্ছাচারে জ্বালিয়ে খেতাম। অবশ্য জ্যাঠা মনে হয় এসব আবদার মিটিয়ে খুশিই হতেন। মনে আছে একবার একটানা বৃষ্টিতে চারিদিকে জলটল জমে একাকার। আমরা তখন অন্য একটি বাড়িতে চলে এসেছি, ঠাম্মার নির্দেশে জ্যাঠা আমাকে ওঁদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন কাঁধে চাপিয়ে, দুই বাড়ির দূরত্ব খুব একটা কম ছিল না, কিন্তু জ্যাঠা তখন ছিলেন খুবই কর্মঠ মানুষ। প্রতিবছর চড়কের মেলা বসত বিটি রোড সংলগ্ন রাস্তায়। চড়ক বা গাজন হয় সাধারণত চৈত্র মাসে, কিন্তু এই মেলাটি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে এখানে বসতে বসতে প্রায় ২রা, ৩রা বৈশাখ গড়িয়ে যেত। প্রতি বছর জ্যাঠা সেই মেলায় আমায় নিয়ে যাবেনই। রাজ্যের মাটির জিনিস কিনে বাড়ি ফিরতাম; কখনো মাটির কুঁড়েঘর, কখনো কচ্ছপ, হাতি, বাঁদর; তো কখনো মাটির ফল-সবজি। আর প্রতিবারই নানান আকারের মাটির ভাঁড় কিনতাম, বলা ভাল জ্যাঠাই কিনে দিতেন উদ্যোগী হয়ে, সঞ্চয়ের অভ্যাস তিনিই প্রথম গড়ে দিয়েছিলেন আমার মধ্যে। বাড়ি ফেরার সময় আধা-অন্ধকার গলি দিয়ে ফিরতে ফিরতে জ্যাঠা দেশের বাড়ির চড়ক মেলার গল্প শোনাতেন, বলতেন "এ মেলা তো কিছুই নয়, গ্রামে বিরাট চড়কের মেলা হতো গোটা মাঠ জুড়ে। পিঠের চামড়ায় লোহার আংটা ফুটিয়ে একটা বাঁশের দুই দিকে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো দুজনকে আর মাচায় দাঁড়িয়ে খৈ-বাতাসা ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতেন আর একজন। কাঠ-কয়লা দিয়ে বেশ খানিকটা লম্বা করে আগুন বানানো হতো এক জায়গায় আর তার উপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যেত কিছু মানুষ।" বলাই বাহুল্য সেই বয়সে এইসব কাহিনি আমার শিশুমস্তিষ্কে কী প্রকার উত্তেজনার সৃষ্টি করত। ইচ্ছে হতো সেই মেলা চাক্ষুষ করার। জ্যাঠা বলতেন "একবার নিয়ে যাবো তোকে, সামনে থেকে দেখবি, বুট ভাজা খাবি, মেলার গরম জিলিপি চেখে দেখবি, সে স্বাদই আলাদা।" আজ আর বসে না থাকলেও অনেকদিন হাপিত্যেশ করে বসেছিলাম সে মেলায় যাবার জন্য। কিন্তু যাওয়া হয়নি, পরে শুনেছি আমাদের এরকম কোনো বিশেষ দেশের বাড়িই ছিল না, বহু যুগ আগে সেরকম কিছু থাকলেও বাবা-জ্যাঠা কেন আমার দাদুও সেখানে বাস করেননি কোনোদিন! তবে কি জ্যাঠাও কারোর মুখে গল্প শুনে হাপিত্যেশ করে বসে ছিল সে মেলা দেখার জন্য?
এমনিভাবে নানান হাপিত্যেশের গল্প জমা
হতে থেকেছে মনের সিন্দুকে... স্কুলের বন্ধুর মামারবাড়ির গল্প যেখানে কিনা মাঝেসাঝেই
প্রেতাত্মার দেখা মিলত, তবু যাবো যাবো করেও যাওয়া হয়ে উঠল না কোনোদিন। পিসিরবাড়ির
পাড়ার কাজলদিদি বলেছিল জোনাকির বন দেখাবে, যেখানে শয়ে শয়ে জোনাকির দেখা মেলে, হাত
বাড়ালেই আঙুলের ডগায় এসে বসে তারা, জ্বলে আর নেভে, কিন্তু যাওয়া হয়নি, কাজলদিদিকেই
হারিয়ে ফেলেছি কবে মনে নেই। এখন সিন্দুক খুললে দেখা যাবে আমার আশায় হাপিত্যেশ করে
বসে বসে হয়তো সেসব গল্পই ধুলোয় ভরে উঠেছে... অভিমানে হারিয়ে গেছে কেউ কেউ গূঢ়
অন্ধকারে...
ছোটবেলায় আমরা প্রায় সব ভাইবোনেরাই পড়াশোনা শুরু করেছিলাম স্থানীয় একটি ছোট স্কুলে। স্কুলের পাশেই ছিল শীতলা মায়ের মন্দির। মন্দিরে প্রতি শনিবারে গ্রহরাজের পুজো হতো, এছাড়া ছিল বেশ বড় একটি মা কালীর বিগ্রহ… সেখানেই আমার পরিচয় ঘন্টাদাদুর সাথে। সামান্য খাটো করে পরা সাদা ধুতি ও আধময়লা ফতুয়া গায়ে প্রতিদিন মানুষটি মন্দির প্রাঙ্গণ জল দিয়ে ধুতেন, যত্ন করে মুছতেন, আর তারপরেই দুহাত মাথায় তুলে "মা মা" বলে সটান উপুড় হয়ে পড়তেন মন্দির প্রাঙ্গণে। সে ডাকে এমন এক আন্তরিকতা, এমন এক আর্তি মিশে থাকত যা চোখ বুজলে অনায়াসে আমি আজও অনুভব করতে পারি। তখন অবশ্য আমার সেসব নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল না, বরং যাবতীয় আগ্রহ ছিল নাগালের বাইরে থাকা মন্দিরের ঘন্টার দিকে। লাফিয়ে লাফিয়ে সেটা বাজাবার বৃথা চেষ্টা করতাম রোজ আর দাদু হাসতে হাসতে এসে আমায় কোলে করে উপরে তুলে ধরতেন। একদিন দাদুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি ঠাকুরকে এত জোরে জোরে ডাকেন, ঠাকুর কি সাড়া দেন? উত্তরে দাদুর চোখে-মুখে অদ্ভুত এক আলো দেখেছিলাম… বলেছিলেন "শুধু সাড়াই দেন না রে, মা আমার সাথে কথা বলেন, আমার কথা শোনেন।" সত্যি বলতে একেবারেই বিশ্বাস হয়নি সেসব কথা... এমনিতেই বাড়িতে বড়দের দেখতাম স্নান করে, জামা ছেড়ে তবে পুজোয় বসতে আর দাদু তো ময়লা জামাকাপড় পরেই, হাত-পা ভাল করে না ধুয়েই ঠাকুরের কাছে চলে যেতেন! এমন করলে ঠাকুর কিছুতেই তাঁর সাথে কথা বলতে পারেন না... একদিন বলেও বসলাম সে কথা... বললাম 'তুমি বলো মা কথা বলেন তাহলে আমি শুনতে পাই না কেন!" দাদু মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন "একদিন তুইও শুনবি, তোকেও শোনাব আমার পাগলি মায়ের কণ্ঠ" সেই থেকে হাপিত্যেশ করে বসে আছি দাদু... তোমার সাথেও আর দেখা হলো না, সে কণ্ঠস্বরও শোনা হলো না...
একদম ছোটবেলার দিনগুলো ছিল জ্যাঠা, জেঠিমা, কাকা, পিসি, দিদি, দাদা, পাড়ার বন্ধু, পাশের বাড়ির কাকিমা; যাকে বলে সবাইকে নিয়ে একদম জমজমাট সংসার। তারই মধ্যে আমি ছিলাম আমার বড় জ্যাঠার বিশেষ প্রিয় পাত্রী। শরীরচর্চার জন্য বাবা কাছেই একটি ক্লাবে ভর্তি করে দিয়েছিলেন, কিন্তু ক্লাব থেকে আমায় বেশিরভাগ দিনই আনতে যেতেন জ্যাঠা। আমিও তাঁকে হাজমোলা কিনব, চানাচুর কিনব, হজমি কিনব বলে যথেচ্ছাচারে জ্বালিয়ে খেতাম। অবশ্য জ্যাঠা মনে হয় এসব আবদার মিটিয়ে খুশিই হতেন। মনে আছে একবার একটানা বৃষ্টিতে চারিদিকে জলটল জমে একাকার। আমরা তখন অন্য একটি বাড়িতে চলে এসেছি, ঠাম্মার নির্দেশে জ্যাঠা আমাকে ওঁদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন কাঁধে চাপিয়ে, দুই বাড়ির দূরত্ব খুব একটা কম ছিল না, কিন্তু জ্যাঠা তখন ছিলেন খুবই কর্মঠ মানুষ। প্রতিবছর চড়কের মেলা বসত বিটি রোড সংলগ্ন রাস্তায়। চড়ক বা গাজন হয় সাধারণত চৈত্র মাসে, কিন্তু এই মেলাটি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে এখানে বসতে বসতে প্রায় ২রা, ৩রা বৈশাখ গড়িয়ে যেত। প্রতি বছর জ্যাঠা সেই মেলায় আমায় নিয়ে যাবেনই। রাজ্যের মাটির জিনিস কিনে বাড়ি ফিরতাম; কখনো মাটির কুঁড়েঘর, কখনো কচ্ছপ, হাতি, বাঁদর; তো কখনো মাটির ফল-সবজি। আর প্রতিবারই নানান আকারের মাটির ভাঁড় কিনতাম, বলা ভাল জ্যাঠাই কিনে দিতেন উদ্যোগী হয়ে, সঞ্চয়ের অভ্যাস তিনিই প্রথম গড়ে দিয়েছিলেন আমার মধ্যে। বাড়ি ফেরার সময় আধা-অন্ধকার গলি দিয়ে ফিরতে ফিরতে জ্যাঠা দেশের বাড়ির চড়ক মেলার গল্প শোনাতেন, বলতেন "এ মেলা তো কিছুই নয়, গ্রামে বিরাট চড়কের মেলা হতো গোটা মাঠ জুড়ে। পিঠের চামড়ায় লোহার আংটা ফুটিয়ে একটা বাঁশের দুই দিকে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো দুজনকে আর মাচায় দাঁড়িয়ে খৈ-বাতাসা ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতেন আর একজন। কাঠ-কয়লা দিয়ে বেশ খানিকটা লম্বা করে আগুন বানানো হতো এক জায়গায় আর তার উপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যেত কিছু মানুষ।" বলাই বাহুল্য সেই বয়সে এইসব কাহিনি আমার শিশুমস্তিষ্কে কী প্রকার উত্তেজনার সৃষ্টি করত। ইচ্ছে হতো সেই মেলা চাক্ষুষ করার। জ্যাঠা বলতেন "একবার নিয়ে যাবো তোকে, সামনে থেকে দেখবি, বুট ভাজা খাবি, মেলার গরম জিলিপি চেখে দেখবি, সে স্বাদই আলাদা।" আজ আর বসে না থাকলেও অনেকদিন হাপিত্যেশ করে বসেছিলাম সে মেলায় যাবার জন্য। কিন্তু যাওয়া হয়নি, পরে শুনেছি আমাদের এরকম কোনো বিশেষ দেশের বাড়িই ছিল না, বহু যুগ আগে সেরকম কিছু থাকলেও বাবা-জ্যাঠা কেন আমার দাদুও সেখানে বাস করেননি কোনোদিন! তবে কি জ্যাঠাও কারোর মুখে গল্প শুনে হাপিত্যেশ করে বসে ছিল সে মেলা দেখার জন্য?
সমাপ্ত
Moner vetor onek jonaki jwole uthlo muhurter jonyo!!!
ReplyDeleteTal narkel gachher chhayay ghera amader purono parata chokher samne vese uthhlo. Mon gora ajgubi golper Raja chhilo jyatha. Thamma o koto thatta korto. Bolto " or joto sob ajgubi gal golpo". Amar ekhon mone hoy chirokaler sorol sada sidhe jyatha asole oi golpogulor modhhyei bas korto. "Pukur pare thokai thokai jonak jwola" dekha holo na. Pukur bujiye flat bari uthe gelo. Odvut mayamoy lekha
ReplyDelete