বাতায়ন/ত্রৈসাপ্তাহিক/ছোটগল্প/২য়
বর্ষ/১৫তম সংখ্যা/শারদ/১১ই আশ্বিন, ১৪৩১
শারদ | ছোটগল্প
সঙ্ঘমিত্রা দাস
প্রায়শ্চিত্ত
"অন্তরার মনে হল ও যেমনভাবে সেদিন নিখিলকে রেখে গেছিল ও যেন সেখানেই স্হির হয়ে আছে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে অন্তরার। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। ক্ষমা নয় প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে ওকে। এভাবে সব ভুলে থাকতে পারে না নিখিল। অন্তরাকে মনে করাতেই হবে ওকে। যে কোন মুল্যে।"
অন্তরা আয়নার সামনে
দাড়িয়ে মুখটা মুছে নেয়। চোখ দুটো এখনো ফুলে আছে। কাল সারারাত ঘুমায়নি। নোটিশটা
আসবে জানত, তবু কীসের যেন একটা অপেক্ষা ছিল। হয়তো-বা ভেবেছিল
বাচ্চাটার কথা ভেবে অর্ণব বিয়েটা টিকিয়ে রাখবে। তিন মাস হয়ে গেছে বাড়ি
ছেড়েছে। অর্ণব একবারও আসেনি, বাচ্চাকে দেখতেও না। তিতলি তো
দুধের শিশু, ওর মুখটা দেখলেই মন ভরে যায় তার উপরও কোন টান
নেই, ও যে অর্ণবেরই রক্ত, ওদের ভালবাসার
উপহার।
পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবন
ওদের। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এইচআর অর্ণব ঠাটেবাটে পুরোদস্তুর সাহেব। স্মার্ট, গুড লুকিং, হ্যান্ডসাম প্রথম যেদিন দেখেছিল মনে মনে সেই মুহূর্তেই ভালবেসেছিল। ইংলিশে
এমএ সুন্দরী বাকপটু অন্তরাতে মজেছিল অর্ণবও। এক বিয়েবাড়িতে আলাপ, প্রপোজ অর্ণবই করেছিল। রাজি না হবার কোন কারণ ছিল না অন্তরার। দুই
পরিবারের মতেই মহা ধুমধামে বিয়ে হয়েছিল ওদের। সে বিয়ের জৌলুস আর আয়োজনের গল্প
আজও এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়। অর্ণব চিরকাল একটু দেখনদারি আর বিলাসিতায়
বিশ্বাসী। প্রচুর আয়, বড় গাড়ি, বাড়ি
সবেতেই তার নেশা। অন্তরাও প্রথমে ভেসেছিল এসব দেখে। বন্ধুদের কাছে ফুলিয়ে
ফাঁপিয়ে গল্প করতে ভালই লাগত। তাল কাটল বছর দুয়েক ঘুরতে। গাড়ি, বাড়ির সাথে নারীর নেশাও ধরা পড়ল অন্তরার কাছে। নিত্যনতুন সঙ্গিনীর খোঁজ
পেল সে। অফিসের সেক্রেটারি, অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী, নানারকম পেশার মহিলাদের সাথে তার
ওঠাবসা, শারীরিক সম্পর্ক। শুরু হল অশান্তি। প্রথম দিকে একটু
লুকোছাপা থাকলেও ধীরে ধীরে বেপরোয়া হয়ে উঠল অর্ণব। বেশি কিছু বললেই ঝগড়া,
এমনকি গায়ে হাত তোলা পর্যন্ত গড়াল। অন্তরাকেও নানাভাবে নিজের
বন্ধুদের দিকে এগিয়ে দিত সে। বচ্চা নাপসন্দ, বউকে সাজিয়েগুজিয়ে প্রেজেন্টেবেল দেখানোতেই তার আগ্রহ। এভাবেই চলতে থাকল দিনের পর দিন।
তবুও একটু ভালবাসার আশায় বারবার সমর্পণ করেছে অন্তরা। তারই ফসল তিতলি। ভেবেছিল ওর
আসায় কিছুটা শান্তি ফিরবে, কিন্তু না। গতকাল ডিভোর্স পেপার
পাঠিয়েছে অর্ণব। একটা ফ্ল্যাট আর বেশ কিছু টাকা ফিক্সড করে
দিয়েছে ওদের নামে। ডিভোর্সটা চাই। অন্যথায়, কিছুটা ভয়
প্রদর্শন করে রেখেছে।
সব স্বপ্ন, আশা এভাবে একদিন ভেঙে পড়বে
অন্তরা ভাবেনি। নিখিলের কথা খুব মনে পড়ছে আজ। ওকে যে কষ্টটা দিয়েছিল সেটাই কি
সুদে আসলে ফেরত পাচ্ছে ও। ওর চোখের জলের দাম মেটাচ্ছে? কোথায়
আছে নিখিল? কেমন আছে? কী করছে? ও কী রায়গঞ্জে রয়ে গেছে? বিয়ে
করেছে? কিছুই আর জানার প্রয়োজন মনে করেনি অন্তরা একসময়।
ভুলেই গেছিল ওর কথা। ছাপোষা একটা গ্রাম্য ছেলে। একটু দুদিনের ভাল ব্যবহার, ভালবাসাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল। অন্তরা অবশ্য পছন্দ করত ওকে। প্রথম ঠোঁটে
ঠোঁট তো অন্তরাই ঠেকিয়েছিল। কেমন থরথর করে কাঁপছিল নিখিল, বেশ
মজা পেয়েছিল অন্তরা সেদিন। পুজোর পাঁচ দিনের ভালবাসা দশমীতেই শেষ হয়েছিল। পরের
দিন বাবা-মায়ের সাথে বাড়ি ফিরে এসেছিল। বেরোনোর সময়
দেখেছিল নিখিল ওদের ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে। বুড়ো আঙুলের নখটা দাঁতে কাটছে। কেমন
ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল। ওই শেষ, আর দেখা হয়নি ওদের। তারপর
কেটে গেছে দশ বছর। এত কিছু ঘটে গেছে জীবনে। অর্ণবের সাথে সুখের সাগরে পাড়ি দেওয়া,
তারপর স্বপ্নভঙ্গ, তিতলির জন্ম, বাবার মৃত্যু কত কী। কোথাও আর নিখিল ছিল না। আজ আবার
খুব মনে পড়ছে। ওর সেদিনকার নিখিলের প্রতি ব্যবহার, নিখিলের চেয়ে থাকা সব।
সব কিছু মিটে গেল দুজনের
দুটো সইতে। সামনে পুজো। আকাশে কী সুন্দর রং ধরেছে, সাদা মেঘ, মহালয়ার সুর ভেসে আসছে পথ থেকে। অটোগুলো
নানা দোকানের প্রচারে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। মা আসছেন, সব
সৌন্দর্যের মাঝে অন্তরার জীবনটা এখন ফ্যাকাশে সাদা। মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে
অন্তরা। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে ও, জানেও না ওর জীবন থেকে কী কী হারিয়ে গেছে। সেটা বোঝার মতো বড় ও হয়নি এখনো।
মা এসে পাশে বসে। "চল পুজোর কটা দিন রায়গঞ্জে মামার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি
আমরা তিনজন। কতদিন যাইনি, এখানে বসে মনখারাপ করার চেয়ে চল
একটু অন্যরকম চেষ্টা করি। যাবি?" মায়ের প্রস্তাব মন্দ
নয়। সত্যিই কোলকাতা থেকে ক'দিনের ছুটি দরকার। আর রায়গঞ্জ,
মন্দ কী? যদি নিখিলের সাথে একবার দেখা হয়।
ক্ষমা চাইত। বড় নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছিল ওর সাথে। এখন খুব
অনুশোচনা হয় ওর সেদিনের আচরণের জন্য। একটি বার, শুধু একটি
বার ওর সামনে দাঁড়াতে চায়। মেনে নিতে চায় ওর সব দোষ। অন্তরা রাজি হয় রায়গঞ্জ
যেতে।
এতদিন বাদে আবার এক দুর্গা
ষষ্ঠীর দিন অন্তরা রায়গঞ্জে। মামাবাড়ি ঢোকার মুখে একবার তাকায় নিখিলদের বাড়ির
দিকে। নিখিল দাঁড়িয়ে আছে ছাদে। সেই একরকম ভাবে, দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। যেন
একই ছবি শুধু তার ওপর সময়ের ধুলো জমেছে। পুরোনো সেই দিনের ওপর জমা এক পুরু
আস্তরণ। নিখিলের রং শ্যামলা হয়েছে। পরনের জামা ময়লা,
চুলগুলো উষ্কোখুষ্কো। অন্তরা জানতে পারল ও নাকি আর আগের কথা মনে
করতে পারে না। কোলকাতায় গেছিল এমএ পড়তে। ফেরার পর কী যে
হলো, আস্তে আস্তে ছেলেটা এমন হয়ে গেল। সব ভুলে গেছে। ছাদে
দাঁড়িয়ে থাকে সারাদিন। কী যেন খোঁজে ওর চোখ। কারোকে চিনতে
পারে না। কথাও বলে না। অন্তরার মনে হল ও যেমনভাবে সেদিন নিখিলকে রেখে গেছিল ও যেন
সেখানেই স্হির হয়ে আছে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে অন্তরার। নিজেকে বড়
অপরাধী মনে হচ্ছে। ক্ষমা নয় প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে ওকে। এভাবে সব ভুলে থাকতে
পারে না নিখিল। অন্তরাকে মনে করাতেই হবে ওকে। যে কোন মুল্যে।
হয়তো এটাই ভবিতব্য ছিল তাই এত বছর পর জীবন অন্তরাকে আবার এখানে টেনে এনেছে
প্রায়শ্চিত্তের জন্য। মাঝের এত আয়োজন হয়তো নাটকের অন্য এক অধ্যায়। অন্তরা মন
শক্ত করে। সংকল্প করে নিখিলকে ও সুস্থ করে তুলবেই। ওদের ভালবাসার কথা মনে করতেই
হবে নিখিলকে। এবার আর কোন ছলনা নয় নিখিলকে জড়িয়ে থাকতে চায় ও।
***
খুব সুন্দর। অন্তরা নিশ্চয়ই পারবে।
ReplyDeleteধন্যবাদ 🙏
ReplyDeleteদুরন্ত শব্দ চয়ন, ধারাবাহিকতা, মেদহীন ছিপছিপে গল্পের কাঠামো। "প্রেম একবারই এসেছিল জীবনে"। আমার ভালো লেগেছে।
ReplyDeleteki bhalo likhechis, kothao jeno mone holo eta amader aneker jiboner satti ghatana, aj hoyto sabar samne tule dhari na
ReplyDeleteমন ছুঁয়ে গেল।এভাবেই জীবনের কতো ধুলো পরা এলবাম আমরা বয়ে বেড়াই!!!
ReplyDeleteকখনও হতাশা কখনও বা আনন্দ গ্রাস করে অবচেতন মনে।লিখতে থাকুন, আমরাও পড়তে থাকি আর সেই সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম বন্ধুত্বের খোলা চিঠি ----
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে বন্ধু
ReplyDeleteসকলের এতো ভালো লেগেছে জেনে খুব আনন্দিত হলাম। ধন্যবাদ অফুরান। এভাবেই সকলের ভালোবাসায় এগিয়ে যেতে চাই।
ReplyDelete