প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দহন | মানুষকে মানুষের মূল্য দিন

বাতায়ন/দহন / কবিতা / ৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ ,   ১৪৩২ দহন   | সম্পাদকীয় "এর মধ্যেই আছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সে-কোন সন্ত্রাসবাদীই হ...

Thursday, September 26, 2024

শারদ | মনিহারি ও বিশ্বকর্মা | ইন্দ্রজিৎ রায়

বাতায়ন/ত্রৈসাপ্তাহিক/ছোটগল্প/২য় বর্ষ/১৫তম সংখ্যা/শারদ/১১ই আশ্বিন, ১৪৩১

শারদ | ছোটগল্প

ইন্দ্রজিৎ রায়

মনিহারি ও বিশ্বকর্মা


"পাড়ার কিছু মানুষের সঙ্গে মা আর ছেলেও এসেছেনমায়ের গায়ে উজ্জ্বল কাপড় ছেলেটিও ছোপ ছোপ একটি হাফ শার্ট প্যান্ট পরে মার পাশে বসে আছে। আর ওপাশেএকি মনিহারি দাদাওউজ্জ্বল জামা গায়ে! এক মুহূর্তের জন্যমনে হ'ল আমার নীচে নামাটা সার্থক, নীচে না নামলে এরকম একটা দৃশ্যএতটা এতটা আনন্দের ভিয়েন হয়তো দেখা হোতো না।"


এই কমপ্লেক্সে অনেকে ভাড়াতেও থাকেন। কারও হাত-পা থাকে, আছে হিসেবমতো । আবার কারো কারো, থাকেও না। একটি ছোট্ট পরিবার এই কমপ্লেক্সের কোথাও ভাড়াতে এসেছে দেখি, মা আর ছেলে দুজনেই বিক্ষিপ্ত, অশান্ত, এসবই আমার রিডিং। ভুল হতেই পারে, তবে কি ছেলেটির ডান হাতটা কব্জি থেকে নেই অর্থাৎ ওর ডান হাতে কোন আঙুল 
নেই। কিন্তু পূর্বাশ্রমের অভ্যাসে বাজারের থলেটা সেই আঙুলবিহীন হাতেই ঝুলিয়ে একটি বিক্ষিপ্ত পাজামা শার্ট অথবা টি-শার্ট পরে, হনহন করে হেঁটে বাজারে যায় ছেলেটি। মাঝে মাঝে দেখি। বয়সে আট-দশ বছর ছোটই হবে আমার থেকে। কোনদিনও কথা বলিনি তবু আমরা। একদিন ওকে দেখলাম ওর মা'র সঙ্গে দুজনের, চেহারাতেই নেই এর ছাপ স্পষ্ট তবে কী যে নেই সেটা আবার আমার জানা নেই। রোজের কোলাহল মিশ্রিত সান্ধ্য কফির ভেতরে, নিশ্চয়ই বিম্ব খুঁজতে যায় না কেউ। আর যারা যায়, তাদের ব্যবসা অন্য। আজকাল একটা ব্যাপার হয়েছে দীর্ঘদিন না লেখার পর যখন লেখার সময় আসে তখন আর লিখতে হাত সরে না। অথচ এই লেখাটার জন্য হয়তো বসেছিলাম ৫ দিন সাংখ্য নাকি শঙ্খ বললে? ভোর হোলো। না, একটা পুরনো ডায়েরিতে দেখলাম আহির ভৈরব কথাটা লেখা আহির ভৈরব ঠিক কেন, কোন অনুষঙ্গে লেখা সেটা আর মনে নেই, মনে করার চেষ্টাও তেমন করিনি, এরই মধ্যে স্বাধীনতা দিবস চলে আসে ওই উন্মনা ছেলেটি ও তার মাকে মাঝেমধ্যে দেখি মুদির দোকানে, কখনো ফুল, ছোট ছোট পতাকা কিনতে। ওই মা ও ছেলের জীবনধারণ সম্পর্কে তেমন কোন ধারনাই জন্মায়নি আমার। অফিসিয়ালি আমরা একই কমপ্লেক্সে থাকি, একই রাস্তাঘাট, ফোন রিচার্জের দোকান,  কিন্তু কথা হয়নি। কেন হয়নি, হতেই তো পারত, ছেলেটিকে আবহাওয়া অথবা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কোন তরজা নিয়ে কথা তো বলাই যেত।

আমিই বা কেন বয়ঃসন্ধির কোনো প্রেমিকার মতো বলে আর উঠতে পারলাম না, ন্ধেবেলা ধুপের গন্ধ টুংটাং হালকা মন্দিরার শব্দ ওদের পর্দা ভেদ করে বাইরে এসেছিল, পেয়েছিলাম একবার।
 
সেদিনই, প্রথম জানতে পারি ওদের ফ্ল্যাটটা  গ্রাউন্ড ফ্লোর, পেছনের দিকে কিন্তু এসব কমপ্লেক্সে, এর তো ভাড়া অনেক, এই মা আর ছেলে... জাগতিক কুতুহলে জড়িয়ে ফেলেন আমাকে। কুচুটে মানুষের মতো আমি ভাবতে শুরু করি ছেলেটির উপার্জনের উৎস কী?  কোনো প্রয়োজনই নেই  যদিও আমার এটা জেনে তবু, এতগুলো ভাড়া দিয়ে কেন এই মা ছেলে এখানে এসে থাকে এই কৌতূহল আমাকে আটকে ফেলে। ফালতু। অনেক পুরনো কিছু ফেরিওয়ালা কেন জানি-না আমাদের এই কমপ্লেক্সে আজকাল ঘুরে বেড়ায়, ভালই লাগে। আসলে আমাদের কমপ্লেক্সের বাইরে যে হাইরোড সেটা তো সোজা চলে গেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার দিকে, দেশালি মানুষ ট্রেনে করে বাসে করে নানান প্রকারে নিয়ে আসেন এক মনিহারি এখানের দাদা আসেন বছর পাঁচেক হোলো। তার সারা শরীর জুড়ে, একটা মনিহারি দোকান চুলের ফিতে কাঁটা, সেফটিপিন, বাচ্চাদের ঝুনঝুনি,  চাবির রিং, চুলকানির মলম, ওহো দাঁতকাঠি, পিঠ চুলকানোর প্লাস্টিকের লম্বা হাত, চিরুনি, দুনম্বরী তিন নম্বরী কাজল পেন্সিল, আর কত কত টিপের পাতা। এই মনিহারি দাদার সঙ্গে আমাদের কমপ্লেক্সের অনেক মানুষের আত্মীয়তা আছে এখন, আসলে এই মানুষদের সঙ্গে কথা বলার কেউ নেই তেমন। মনিহারি দাদা টিপের পাতা, কাঁটা দেবার ফাঁকে দুটো চারটে কথা বলেন, সুখ দুঃখের সেপটিপিন পাতা, কখনো জল বাতাসাও খান। আবার হাঁটতে হাঁটতে চলে যান, সিকিউরিটি উত্তম জানা সেও অনেক দিনের, তাকে পেরিয়ে। আমার সাইকেলটা এই পাড়ার সবাই চিনে গেছে, কতদিন দোকানের সামনে আশ্রমের সামনে ফেলে চলে এসেছি, কেউ নেয়নি যদিও নিতেই পারত, আমি এমনই দাদা শ্রীধর প্যাটনের  চায়ের দোকান, অজিত-দা ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ছেলের সঙ্গে কথা নাই বলতে পারতাম কিন্তু বলি যেমন ওই রহস্যাবৃত ডান হাতের আঙুলবিহীন ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতেই পারতাম কিন্তু বলিনি। সেই ফাঁকে বাড়ি ফিরে আসি, ইউটিউবে সিংহকে ব্ল্যাক মাম্বার ছোবলে পড়তে দেখেছি, ব্ল্যাক মাম্বার ছোবলে অসহায়  শিশুর মতো ছটফট করছে সিংহটি, এদের সাথে বারবার দেখি ডেঞ্জারের কথা ভাবি তরঙ্গ নিয়ে। এই মহাবিশ্বের ভেতর দিয়ে, ভেতর দিয়ে যে তরঙ্গ যে অন্ধকার শব্দের স্রোত নীরবতার মতো ঢেকে দিচ্ছে চারপাশ, গাছগুলো শুয়ে পড়ছে সবুজ গালিচার মতো, ডালগুলো দাঁড়িয়ে আছে যেন নির্মীয়মান তরুণ সব, যেন খুলে যাবে আগেরটা খুলে গেলে দিয়ে যেতে হবে পিছু পিছু সবারই সঞ্জু মাতাল দুর্মুখ, কিন্তু হাতের নিশানা পাক্কা, ওজন করতো দারু। যত ফুটিফাটা পুরোনো, পূর্ণ ভাঙাচোরা তার ব্যবসা ছিল সঞ্জুর। সম্ভবত বিহারী ছিল, জানি-না  তবে বাংলাটা আমার থেকে ভালই বলত সঞ্জু। কোথাও একটা চলে যায় কোন ট্রেস পাওয়া যায়নি আর। ছোটবেলায় পড়েছিলাম, শহরে প্রত্যেক দিন কিছু মানুষ হারিয়ে যান, এমনি জাস্ট হারিয়ে যান তাদের দীর্ঘ দীর্ঘ দিন  দেখতে পাওয়া যায় না কোন নেটওয়ার্কে থাকেন না। তারা হারিয়ে যান, অনেক বছর পরে হয়তো কোনো মফস্‌সল স্টেশনে বেঞ্চে এক কোণায় বসে, টুরিস্টের মতো টুপি পড়ে ঝাল মুড়ি খেতে দেখা যায় এসব মানুষকে। কোথায় বাড়ি এসব প্রশ্নের সাথে উত্তর পাওয়ার আশা করাটাই কবিতা, কিছু মানুষ সেই কবিতা রচনা করেন আমি হাইরোড থেকে একটা গলি দিয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম দেখতে চাই রোজ তোকে চাই সন্দেহ আলোচনা কথাগুলো ডিম সিদ্ধ ঘুঘনি মুড়ি, ন্ধেবেলার টিফিন পোড়া তেলে ভাজা আলুর চপ, তোকে চাই। আরে তোকে যেতে গিয়ে অনেক মুখ সঙ্গে করে কমপ্লেক্সে ফিরে আসি কোনদিন ওই মা অথবা ছেলে ওদের সঙ্গে দেখা হয় কথা বলা হয় না হয়তো ভালই হয় এমন ও ভাবে বাতাস পাল্টে যায় নিমপাতাগুলো হলুদ হয়ে যায়, আমার প্রিয় উৎসব বিশ্বকর্মা পুজো এগিয়ে আসে আমার কাছে বিশ্বকর্মা দুর্গাপূজার থেকেও বড় অনেক বড়।

কারণ যে মানুষগুলো এই উৎসবটা করেন তারা হালাল কি রোটি খায়, এই পুজোটা অন্তত হারামের টাকায় হয় না  থীম পুজোর মতো। তস্করদের থীম পুজো যেমন, অনেক স্মৃতি ঘুড়ির মতো শেষ বিকেলের আকাশে, বিশ্বকর্মার আকাশে কালো নীল ফোটা ফোটা মাঝখানে মাঝখানে,  সাদা চোখের জলের মতো। সারা বছর ধরে যারা যাকে বলে গায়ে-গতরে খাটে সেই মানুষগুলো একটা দিন জলটল খেয়ে যে উদ্দাম  নৃত্য ও অঙ্গভঙ্গিতে ফেলে সরিয়ে দিতে চায় সমস্ত অন্ধকার এই উৎসবে সৃষ্টির উল্লাস আছে। আমার কাছে আমাদের উল্লসিত শারদ উৎসবের থেকে ও এই বিশ্বকর্মার বিস্ফোরণ। অনেক প্রিয় আমার আশ্রমের রিক্সার স্ট্যান্ডের পেছনে কদম গাছটা, এখনো থেকে গেছে বড় বড় হলুদ পাতা, আমার মা'র প্রিয় হলুদ ট্যাক্সির মতো,  সময় অসময়ে রাস্তাটায় ছড়িয়ে রাখে হলুদ থেকেই ইয়েলো কার, সেখান থেকে গাঢ় বাদামি হয়ে, পাতাগুলো রাস্তার সঙ্গে মিশে যায়। পিচ ও পচনশীল পাতার কোনো রসায়ন আছে কিনা, এ বিষয়ে থেমে ভাবার অবকাশ হয়নি। আছে হয়তো। কত রসায়নই আছে। যেগুলো আমাদের আঙুলের বাইরে থেকে যায়। সারা জীবন। আঙুল কিলবিল করে অন্ধকারে,  পৃথুল মাকড়সার মতো, কিন্তু যেটা ফুটবার, সেটা আর ফোটে না। ক্রমশ বিশ্বকর্মা, হালাল কী রোটি চলে আসে, ভাঙড়া বিটস্-এর সঙ্গে হাড়ঝাঁকানো নাচ এবং আকাশের নীচে, বড় বড় ঘুড়ি ভাসতে শুরু করে। নামিয়ে নেয় ঘুড়ি, বৃষ্টির আভাস এলে, দুটো গাল দেয় নিকষ কালো মেঘকে  উদ্দেশ্য করে। তার ঘন্টাখানেক পরে আবার, লাটাই নিয়ে ছুটতে শুরু করে। এই ঘুড়ি লাটাই মাঞ্জা, কালোজিরা আলুর তরকারিতো অনেক গল্প, গল্পের সুতো তিব্বতি মন্ত্রের মতো, মাঠের উপর হালকা ভেসে থাকে। ছেলেটির সঙ্গে ঘুরে ফিরে দেখা হয়, ওর মার সঙ্গেও আস্তে আস্তে এপাড়ার ঘুগনি ফুচকার দোকান ওরা চিনে ফেলেন, রুটি আনাজ, পার্টি সব চিনে ফেলতে শুরু করেন। মনিহারি দাদার জামা একটু উজ্জ্বল হয়, ফুচকাগুলো হয় আরো কুমুরে, হাতি ঢুকে পড়তে থাকে কুমোর পাড়ার গলিতে গলিতে, হাতি দেখলে বাঁটুল দি গ্রেট মনে পড়ে সেই যে, বাঁটুল এক হাতির বাচ্চাকে উদ্ধার করে হাতে তুলে, একহাতে নিয়ে যায় আর বলে চল হাতু তবে তোর মার কাছে দিয়ে আসি। এই হাতু এখন গলিতে গলিতে, বিশ্বকর্মার সঙ্গে।
 
পুজোর রাতে আমার ফ্ল্যাট থেকে নীচে নেমে আসি, নীচে তখন সাংঘাতিক গানবাজনা, অনুরাগ চলছে। বিশ্বকর্মা পূজোর আরতি সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। থাকতেই পারত, যেমন বলেছি অনেক কিছুর মতোই। দেখলাম সারি সারি চেয়ারে পাড়ার কিছু মানুষের সঙ্গে মা আর ছেলেও এসেছেন, মায়ের গায়ে উজ্জ্বল কাপড় ছেলেটিও ছোপ ছোপ একটি হাফ শার্ট প্যান্ট পরে মার পাশে বসে আছে। আর ওপাশে, একি মনিহারি দাদাও, উজ্জ্বল জামা গায়ে! এক মুহূর্তের জন্য, মনে হ'ল আমার নীচে নামাটা সার্থক, নীচে না নামলে এরকম একটা দৃশ্য, এতটা এতটা আনন্দের ভিয়েন হয়তো দেখা হোতো না।  আমাদের স্ট্যান্ডের কিছু ছেলে, যারা রিক্সা চালায়, আরো টুকটাক কাজও করে সারা বছর তারাও লোশন মেখেছে চুলে। ছেলেটির মা'র চোখে আজ উন্মাদনা কম, রোজকার বিবর্ণ নাইটির পরিবর্তে আজ তিনি তাঁতের শাড়ি পরেছেন, মুখমন্ডল প্রশান্ত। বললেন আমাকে, দাদা, প্রসাদ খেয়েছেন? যেন কত চেনা, মাথা নেড়ে  হ্যাঁ বললাম। তাই তো, এই হিংস্র দুনিয়াতে, মা আর ছেলে একা থাকে, ছেলের ডান হাতটা দুর্ঘটনাতে ক্ষতিগ্রস্ত আর আমি ভাবছি এত বড় কমপ্লেক্সে থাকার ভাড়া কোথায় পায়? নিজের কুচুটেপনায় খুব লজ্জিত হলাম, বিশ্বকর্মার হাতে কি গদা থাকে? মনে হোলো একটা গদার বাড়ি দিলেন আমার মাথায়। যেন বললেন, এই কী শালা তোর কাজ? 
 
খুব লজ্জিত, কুঁকড়ে গেলাম গদার বাড়ি খেয়ে, তারপর  আবারও বিশ্বকর্মা পুজোর আনন্দের ভিয়েনের পাশে দাঁড়িয়ে, গোলাপি রঙের ললিপপ মোড়ক খুলে মুখে দিয়ে বুঝলাম আরেকবার সেপ্টেম্বর মাস এসে গেছে। এইসব করে, তাদের ভাল ভাল জামা কাপড় দেখতে এত ভাল লাগল। মনটা ঘুড়ির মতো'ল। সত্যিই, নীচে না নামলে এই কিছুই আমার দেখা হতো না। মা আর ছেলেকে, আরেকবার দেখে, আজ দুজনকেই খুব শান্ত দেখাচ্ছে, রাস্তার দিকে এলাম। মাইক বাজছে, হাতি ঘুরছে আমাদের রাস্তাগুলোতে। বিশ্বকর্মা বাবার হাতি। সত্যিই, নীচে না নামলে, এত কিছু দেখাই হ'ত না আমার।
 

সমাপ্ত

2 comments:

জাল— মাছ কাটতে না জানলেও কিছু মানুষ জানে


Popular Top 10 (Last 7 days)