বাতায়ন/ত্রৈসাপ্তাহিক/ছোটগল্প/২য়
বর্ষ/১৫তম সংখ্যা/শারদ/১১ই আশ্বিন, ১৪৩১
শারদ | ছোটগল্প
সুচরিতা চক্রবর্তী
পাখির ডিম
"শাশুড়ির অসুস্থতা বেশ বাড়াবাড়ি অবস্থা। রোজ নার্সিংহোম আর ঘর করতে হচ্ছে। হঠাৎ মিলিদির নজরে এলো পাখি দুটো মুখে করে করে খাবার নিয়ে উড়ে গিয়ে বসছে লেবুগাছে। মিলিদির মনটা খুশিতে ভরে গেলো। দৌড়ে পেছনের দিকে গিয়ে শুনতে পেলো চিঁচিঁ ডাক। তিনটে ডিম ফুটেই পাখি হয়েছে।"
মিলিদি কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছে রান্নাঘরের জানলার পাশে
কাগুজিলেবু গাছটায় একজোড়া টুনটুনি ওড়াউড়ি করছে। মিলিদি উঁকি দিয়ে দেখে পুরুষ
টুনটুনিটা কী সুন্দর নীলচে কালো রঙের ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ছে এ ডাল-ও ডাল আর ধূসর মেয়ে পাখিটা একটু
শান্ত ধরনের। মিলিদি ভাবল মোবাইলে ছবি তুলে রাখবে কিন্তু
সেটা সেই শোবার ঘরে চার্জে বসানো, আনতে গেলে যদি উড়ে পালায়
তাই মিলিদি চুপচাপ দেখছিল। প্রায়ই এখন পাখি দুটো কাগুজিলেবু গাছে আসে খেলা করে
আবার পালায়। যতবার ভাবে ছবি তুলবে পাখি দুটোর ততবারই কিছু না কিছু কারণে ছবি তোলা
হচ্ছে না।
মিলিদি গাছ পাগল মানুষ। কত ধরনের গাছ যে মিলিদিদের
বাড়িতে আছে তা গুনে শেষ করা যায় না। জায়গা যে অনেক তা নয় কিন্তু টব ফাটা বালতি
ভাঙা মগ থেকে শুরু করে জল মাটি ধরে এমন যে কোনো পাত্রেই গাছ লাগিয়ে দেয়। কিছু গাছ
অবশ্য মাটিতেও আছে সেগুলো একটু বড় প্রজাতির গাছ। এই তো এবছর পুজোর সময় তিন বছরের
সজনে গাছটা অসংখ্য শুঁয়োপোকা লাগায় কেটে দিলো মিলিদির হাসব্যান্ড। কী বা করবে! এ তো পিঁপড়ে বা ফড়িং নয়, শুঁয়োপোকা। একবার ছুঁয়ে দিলেই বল মা তারা দাঁড়াই কোথা!
সারাদিনের কাজ সেরে স্নান খাওয়া করে মিলিদি খবরের কাগজ নিয়ে
ঘরের পেছন দিকের সিঁড়িতে বসে। ফ্যানের হাওয়া সব সময় ভাল লাগে না মিলিদির। এই
দিকটায় বেশ গাছপালা একটা সুন্দর পরিবেশ। আজও তাই। হঠাৎ দেখে কাগুজিলেবু গাছে
টুনটুনির বাসা। মিলিদির মন খুশিতে ভরে গেলো। নিশ্চয়ই ডিম পেরেছে। খবরের কাগজ রেখে
উঁকি দিয়ে দেখতে গেলো পাখির বাসার দিকে। ওমনি ভেতর থেকে একটা পাখি উড়ে গিয়ে একটু
ওপরের ডালে গিয়ে বসল। হ্যাঁ
যা ভেবেছে ঠিক তাই, বাসার ভেতর তিনটে ডিম। মিলিদিকে দেখে
আরেকটা টুনটুনি উড়ে এলো। এবার দুজনে মিলে ওড়াউড়ি করে দেখছে যাতে ডিম নষ্ট না হয়।
মিলিদি এসে আবার সিঁড়িতে বসে ভাবতে লাগল এই ডিম ফুটতে কতদিন লাগবে ততদিনে যদি
বেড়াল বা খাটাস এসে খেয়ে যায় তাহলে তো পাখি দুটোর খুব কষ্ট হবে। রাতের দিকে একটু
নজর রাখতে হবে। নাহয় পেছনের আলোটা সারারাত জ্বালিয়ে রাখবে যাতে রাতে কেউ এসে
ডিমগুলো খেয়ে যেতে না পারে। মিলিদি কাজ সেরে পরের দিন এসেও দেখে গেল ডিমগুলো ঠিকই
আছে। মিলিদিও অপেক্ষা করছে কবে চিঁচিঁ করে শব্দ আসবে পাখির বাসা থেকে।
মিলিদি একটা ছোট নারকেল মালায় করে অল্প চাউমিন সেদ্ধ কুচোনো
ফল সবজি রেখে আসে কাগুজিলেবু গাছের কাছাকাছি। যদি মা-বাবা টুনটুনি এসে খায়। মা টুনটুনি তা দিয়ে
বসে থাকে আর বাবা পাখি ওড়াউড়ি করে খাবার জোগাড় করে।
মিলিদি রসিকতা করে নিজের হাসব্যান্ডকে বলে দেখো দেখো দেখেছ! পাখি হলে কী হবে বাবা হবে বলে কত দায়িত্ব পালন করছে। এদিক-ওদিক
থেকে খাবার মুখে করে নিয়ে আসছে গিন্নির জন্য। রমেশবাবু মানে
মিলিদির হাসব্যান্ডও রসিকতা করে বলে হ্যাঁ আমিও ভাবছি ওদের বাসার পাশে আমিও একটা বাসা বানাব। তুমি বসে থাকবে আমি
কেঁচো কেন্নো এনে এনে তোমার মুখে তুলে দেবো। তারপর দুজনেই হাসাহাসি করে। মিলিদির শাশুড়ি বলে
পাখির ছানা তো নয় মনে হচ্ছে মিলির নাতিনাতনি হচ্ছে। মিলিদির এগারো বছরের ছেলে বলে
মা ডিম ফুটে কবে বাচ্চা হবে? বাচ্চাগুলো কী খাবে? কতদিন পর উড়তে পারবে এমন হাজার প্রশ্ন।
আজ সারাদিনই ভ্যাপসা গরম। এখনো বৈশাখ মাস আসতে দিন ষোলো বাকি এখনি কত গরম পড়েছে। মিলিদির শাশুড়ির
শরীর বেশ কিছুদিন খারাপ যাচ্ছে। বয়সজনিত কারণে নানান সমস্যা
লেগেই আছে। বিকেলের দিকে মিলিদির শাশুড়ি মাথা ঘুরে পড়ে গেলো, সেই নিয়ে ছোটাছুটি করে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার সময় ঝড় উঠল। তখন রাত সাতটা
সাড়ে সাতটা হবে। তখন ওরা গাড়িতে নার্সিংহোমের পথে। বাড়ি থেকে খুব দূরে না হলেও ঝড়ে
বিপত্তির মুখে পড়লো ওদের গাড়ি। ওদিকে গাড়িতে বসে মিলিদির মন
হুহু করে উঠল। পাখির বাসাটা থাকলে হয় যদি নীচে পড়ে যায় তাহলে
ডিমগুলো নির্ঘাত ভেঙে যাবে। ওদিকে শাশুড়ি গুরুতর অসুস্থ। হসপিটালে ভর্তি করে যখন
বাড়ি এলো তখন রাত সাড়ে দশটা। এক চোট ঝড় বৃষ্টি হয়ে চারদিন থৈ থৈ অবস্থা। গাড়ি থেকে
নেমে সোজা বাড়ির পেছনের দিকে লেবুগাছতলায় ছুটোলো মিলিদি। কারেন্ট নেই, মোবাইলের টর্চ জ্বেলে দেখলো পাখির বাসাটা নীচে পড়ে
আছে। পাখি দুটো নেই। একটা ডিম নীচে গড়িয়ে গেছে বাকি দুটো ডিম
বাসার ভেতরে আটকে আছে। একটা ডিমও ভাঙেনি। খুব আলতো হাতে গড়িয়ে যাওয়া ডিম বাসায়
তুলে তিনটে ডিমসুদ্ধু পাখির বাসাটা বারান্দায় একটা লুঙ্গি
ভাঁজ করে তার ওপর রেখে দিলো। খুব ভোরে উঠে মিলিদি পাখির বাসাটা তুলে গাছের ডালে সুতো
দিয়ে ভাল করে বেঁধে দিলো। মা-বাবা পাখি দুটোর কোনো খোঁজ নেই।
ঘর সংসারের কাজের ফাঁকে একবার এসে দেখলো যে পাখি দুটো ফিরে এসেছে। দুজনেই বাসার
সামনে বসে আছে। মিলিদি নিশ্চিন্তে ফিরে গেলো। এদিকে শাশুড়ির অসুস্থতা বেশ বাড়াবাড়ি
অবস্থা। রোজ নার্সিংহোম আর ঘর করতে হচ্ছে। হঠাৎ মিলিদির নজরে এলো পাখি দুটো মুখে
করে করে খাবার নিয়ে উড়ে গিয়ে বসছে লেবুগাছে। মিলিদির মনটা খুশিতে ভরে গেলো। দৌড়ে
পেছনের দিকে গিয়ে শুনতে পেলো চিঁচিঁ ডাক। তিনটে ডিম ফুটেই পাখি হয়েছে।
সেদিন রাতে
বাসাটা যত্ন করে তুলে রেখেছিল ভাগ্যিস। বাপ-মায়ের কত স্বপ্ন
থাকে সন্তানদের ঘিরে। তাদের মঙ্গলের জন্য কত ত্যাগ করতে পারে তারা। এই টুনটুনি
বাবা-মায়ের চোখেও সেই আনন্দ দেখতে পেলো মিলিদি। ছেলে বুবাই
শুনে দৌড়ে দেখতে গেলো পাখির ছানা। মায়ের আঁচল ধরে টান দিয়ে বলল মা ওদের কী নাম রাখবে? মিলিদি বলল, মেঘ,
বৃষ্টি, আলো।
সমাপ্ত
খুব সুন্দর ❤️❤️
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteখুব সুন্দর লেখা❤️❤️
ReplyDeleteএই রকম আরো সুন্দর সুন্দর লেখা পড়তে চাই
জীবন আর অপত্যের নির্বিকল্প কথকতা ! মন ছুঁয়ে গেল।
ReplyDeleteজীবন আর অপত্যের কথকতা। মন ছুঁয়ে গেল।
ReplyDelete