বাতায়ন/ত্রৈসাপ্তাহিক/ধারাবাহিক/২য়
বর্ষ/১৫তম সংখ্যা/শারদ/১১ই আশ্বিন, ১৪৩১
শারদ | ধারাবাহিক উপন্যাস
পারমিতা
চ্যাটার্জি
শেষ থেকে শুরু
[১ম
পর্ব]
"হ্যাঁ তোমার সাথে আমি গান গাই, ভাল ভদ্র ছেলে বলে মানি তাবলে কোনভাবেই তোমাকে আমার প্রেমিক বা জীবনের ভালবাসা বলে ভাবতেই পারি না। তুমি তো আমার যোগ্য নও তাহলে এ প্রস্তাব নিয়ে কেন এলে? বউয়াদা মুখটা কালো করে বলল সত্যি রে বড় ভুল হয়ে গেছে, আর কোনদিন তোর সামনে আসব না, আমায় ক্ষমা করে দিস।"
জীবনের
রং মাঝে মাঝে বদলে যায়। যে সুখের স্বপ্ন নিয়ে একদিন ঘর বেঁধেছিল মনকলি, সে ঘর তার
ভেঙে গেছে। নিজেকে বড় দামী মনে করত মনকলি। বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে,
পড়াশোনায় খুবই মেধাবী সেই সাথে অসাধারণ গানের গলা। পাড়ার ফাংশনে তার গান, সংলাপ
থাকবেই। তার সাথে গান গাইত একটি মাড়োয়ারি ছেলে, কিন্তু অসম্ভব রবীন্দ্রনাথের
ভক্ত, বারবার কী যেন এক অমোঘ টানে ছুটে যেত শান্তিনিকেতন, ছেলেটির নাম ছিল
রাজকুমার, সবাই তাকে ডাকত বউয়া বলে। মনকলিও তাকে বউয়াদা বলেই সম্বোধন করত। আর
মনকলিকে সবাই তার বাড়ির নাম অর্থাৎ মিতুল বলে ডাকত। মিতুলের চেহারা খুবই ফুটফুটে,
টকটকে ফর্সা রং, এক ঢাল
চুল, দুটি বড় বড় কাজল কালো চোখ, অনেকেই তাকে ভীষণ পছন্দ করত কিন্তু বউয়াদা যে তাকে
নিজের মনে এক গভীর ভালবাসায় আবদ্ধ করেছিল তা সে জানতেই পারেনি।
কথায়
আছে সত্যিকারের ভালোবাসা কখনও অবহেলা করতে নেই। গুণ এবং রূপের এক প্রচ্ছন্ন অহংকার
মনকলির মনকে কখন যেন ঘিরে ধরেছিল। বাড়িতেও সবার খুব আদরের ছিল, মাসি-পিসিরা বলত এই
মেয়ের জন্য আইপিএস, বা উচ্চপর্যায়ের কোনো পরিবারের সুপুরুষ ছেলের সাথে বিয়ে দিতে
হবে। শুধু বাবা বলতেন এখন ওসব আলোচনায় কান না দিয়ে নিজের পড়াশোনাটাই মন দিয়ে করে
পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করে গড়ে তোল। রূপ দুদিনের, তারপর সব একঘেয়ে হয়ে যায় কিন্তু
তোমার বিদ্যা, তোমার গান, তোমার জীবনের মূলমন্ত্র। আর একটা কথা যদি কখনও কাউকে ভালবাস তবে
তার রূপ বা অর্থ দেখো না, শুধু দেখো মানুষটা যেন প্রকৃত রূপে একজন মানুষ
হয়। বাবার কথা সে অনেকটা মেনেছিল কিন্তু সবটা মানতে পারেনি তাই হয়তো জীবনের এক পরম
দুর্যোগের সামনে পড়তে হলো।
ইতিহাসে
ফার্স্ট ক্লাস
নিয়ে মাস্টার্স করে নেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল, পিএইচডি করতে করতেই সরকারি কলেজের লেকচারার
হয়ে গেলো, তার সাথে চলল পুরোদমে গানের চর্চা। একসময় সে যখন এমএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে
যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে, তখন বউয়াদা মাস্টার্স শেষ করে নেট দেবে কিনা ভাবছে, তার
ইচ্ছে ছিল বাকি পড়াশোনা শান্তিনিকেতনে গিয়ে করার কিন্তু মনকলিকে ছেড়ে হয়তো যেতে
পারছিল না। বউয়াদার রেজাল্ট সাধারণ মানের সেকেন্ড ক্লাস ছিল, দেখতেও সাধারণ ছিল,
গায়ের রং শ্যামলা, লম্বা দোহারা চেহারা, চোখ দুটি বড় সুন্দর আর গভীর ছিল, কিন্তু
কোনভাবেই তাকে সুপুরুষ বলা যায় না।
এই
বউয়াদা যখন তাকে ভালবাসার কথা জানালো সে অত্যন্ত অহংকারী মনোভাব নিয়ে বলল, হ্যাঁ
তোমার সাথে আমি গান গাই, ভাল ভদ্র ছেলে বলে মানি তাবলে কোনভাবেই তোমাকে আমার
প্রেমিক বা জীবনের ভালবাসা বলে ভাবতেই পারি না। তুমি তো আমার যোগ্য নও তাহলে এ
প্রস্তাব নিয়ে কেন এলে?
বউয়াদা মুখটা কালো করে বলল সত্যি রে বড় ভুল হয়ে গেছে, আর কোনদিন তোর সামনে আসব না, আমায় ক্ষমা করে দিস।
বউয়াদা মুখটা কালো করে বলল সত্যি রে বড় ভুল হয়ে গেছে, আর কোনদিন তোর সামনে আসব না, আমায় ক্ষমা করে দিস।
সত্যি
এরপর থেকে কেউ তাকে আর পাড়ায় দেখতে পায়নি। পাড়ার ছেলেদের কাছে এবং অনেক মেয়েদের
কাছেও সে খুব প্রিয় ছিল, তার সাদাসিধে সুন্দর মিষ্টি ব্যবহারের জন্য।
ওর
বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো বউয়াদা শান্তিনিকেতনে চলে গেছে, ওখানে ওর
কর্মজীবন শুরু করবে বলে।
আজ মনকলি জীবনযুদ্ধে বিধ্বস্ত, আজ মনে হচ্ছে বউয়াদাকে তার বড় প্রয়োজন, কিন্তু কোথায় পাবে তাকে! বাবার এই একটা কথাই সে অমান্য করেছিল, সাময়িক রূপ আর চাকচিক্যে ভুলে গিয়ে প্রবীরের হাত ধরেছিল পরম নির্ভয়ে, প্রবীর ছিল বাইরে থেকে ডক্টরেট হয়ে আসা ছেলে, নটিংহ্যামে লেকচারার ছিল, সে সব ভুলে প্রবীরের হাত ধরল, এখানে প্রবীর কী করে বা ভবিষ্যতে ইউকেতে ফিরে যাবে কিনা সে বিষয়ে জানতেই চাইল না।
আজ মনকলি জীবনযুদ্ধে বিধ্বস্ত, আজ মনে হচ্ছে বউয়াদাকে তার বড় প্রয়োজন, কিন্তু কোথায় পাবে তাকে! বাবার এই একটা কথাই সে অমান্য করেছিল, সাময়িক রূপ আর চাকচিক্যে ভুলে গিয়ে প্রবীরের হাত ধরেছিল পরম নির্ভয়ে, প্রবীর ছিল বাইরে থেকে ডক্টরেট হয়ে আসা ছেলে, নটিংহ্যামে লেকচারার ছিল, সে সব ভুলে প্রবীরের হাত ধরল, এখানে প্রবীর কী করে বা ভবিষ্যতে ইউকেতে ফিরে যাবে কিনা সে বিষয়ে জানতেই চাইল না।
এখানেই
হল তার চরম পরাজয়। প্রবীর যে তার প্রতি কর্তব্য করত না তা কিন্তু নয়। অনেক ভালবাসা
এক এক সময় দেখাত। মাঝে মাঝেই দামী উপহার নিয়ে আসত। নিজের জন্মদিন আর বিয়ের তারিখ
খুব ঘটা করে পালন করত। যখন মহিলা বান্ধবীদের মধ্যে থাকত তখনই সে স্ত্রীকে
তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত, বান্ধবীদের সামনে স্ত্রীকে অপমান করে যেন এক পৈশাচিক আনন্দ
পেত। আস্তে আস্তে মনকলি বুঝতে পারে সে ভুল করেছে, তাকে বেরিয়ে যেতে হবে। আর ঠিক
তখনই রোগের উপশমগুলো দেখা দিতে থাকে। একবার অপারেশন করতে হয় তখনই ধরা পরে রোগটা।
এরপর সে ঠিক করে আর এখানে থাকবেনা সে বদলি নিয়ে চলে যাবে।
কলকাতায়
নানা লোকের প্রশ্ন ও কৌতুহল এড়াতে সে বদলি নিয়ে চলে এলো পুরুলিয়ায়। প্রবীর বারমুখী
হলেও অসুখের সময় সাধ্যমতো চিকিৎসা করিয়েছিল। সেও তখন ভাবতে পারেনি যে মনকলি তাকে
মুক্তি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। যখন মনকলি জানালো তখন সে বলল এইসময় এই অবস্থায়
তোমাকে কী করে একটা অজানা শহরে ছেড়ে দিই আর ওখানে চিকিৎসা পাবে কী করে?
ঠান্ডা গলায় মনকলি বলেছিল, আমার জন্য আর নাই বা ভাবলে আমি মিউচুয়াল ডিভোর্স নেব
তোমার কাছে কোনো কিছু দাবি করব না শুধু ডিভোর্সটা দিয়ে দিও। উত্তরে প্রবীর বলেছিল,
আমাকে তুমি যতটা অমানুষ ভাবো আমি কিন্তু তা নই। তোমার চিকিৎসার জন্য আমি অনেক
জায়গায় কথা বলেছি দরকার হলে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। প্লিজ এতবড় একটা
অসুখ নিয়ে পুরুলিয়ায় চলে যেও-না। কিন্তু মনকলি চলে এসেছিল। যে ব্যবহার সে
এতদিন পেয়ে এসেছে তার সাথে মেলাতে পারছিল না, তার কাছে সবটাই অভিনয় বলে মনে হয়েছে।
পুরুলিয়ার
নিস্তব্ধ বেলাভূমিতে চলে এল, বলরামপুর কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপিকা হয়ে। বলরামপুরের
একদিকে অযোধ্যা পাহাড় আর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বাঘমুণ্ডি শহর। বাঘমুণ্ডি ছৌ
নাচের জন্য বিখ্যাত। শৈশব থেকেই সে ছৌ নাচের খুব ভক্ত ছিল, ইচ্ছে আছে অধ্যাপনার
সাথে সাথে ছৌ নাচের ওপর কিছু কাজ করার। রাঙামাটির কোলে লাল পলাশের বনে এসে এক
অদ্ভুত আনন্দের শিহরণ লাগল তার মনে। অনেকটা যেন তাকে শান্তিনিকেতনের কথা মনে করিয়ে
দিচ্ছিল।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment