বাতায়ন/মাসিক/ধারাবাহিক/২য়
বর্ষ/১৮তম সংখ্যা/২৩শে কার্ত্তিক, ১৪৩১
চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা | ধারাবাহিক গল্প
তন্ময় কবিরাজ
সমরের বাড়ি
[১ম পর্ব]
"ভদ্রলোক নাবারডে চাকরি করেন। হাংরি আন্দোলনের প্রাথমিক খসরা তিনিই তৈরি করেছিলেন। যদিও পরে সাহায্য করেছিল সমীর, শক্তি, দেবী। তার পরে আসে বিনয়, উৎপল, ফাল্গুনী।"
- আসতে অসুবিধা হয়নি তো?
মোহিনীমোহনকে প্রশ্ন করলেন সমর সেন।
- একদম নয় সমরদা। আমি তো আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
হালকা স্বরে বললেন মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়।
মোহিনীমোহনকে প্রশ্ন করলেন সমর সেন।
- একদম নয় সমরদা। আমি তো আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
হালকা স্বরে বললেন মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়।
- আসতে একটু দেরি হয়ে গেল
বুঝলেন।
সমর সেনের কথায় অনুতাপ।
- কোন সমস্যা সমরদা?
জানতে চাইলেন মোহিনীমোহন।
- আমার আর কবিতা লিখতে ভাল লাগছে না। বিষ্ণু দে’কে বলে এলাম সে কথা।
শুনে অবাক হলেন মোহিনীমোহন।
- সেকি সমরবাবু, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত আপনার লেখা পড়ে বলেছেন আপনার লেখা টেকসই হবে। আর আপনি কিনা লেখা ছেড়ে দেবেন?
- ভাল লাগছে না মোহিনীবাবু। তাছাড়া আপনি আছেন, মলয় আছে, বীরেন্দ্র, সারদা তো রয়েছে।
বললেন সমরবাবু।
- আপনি চলে গেলে কে লিখবে— মাঝে মাঝে তোমার চোখে দেখেছি / বাসনার বিষন্ন দুঃস্বপ্ন?
মোহিনীমোহন বোঝাতে লাগলেন সমর সেনকে।
- আমার থেকে আপনি যথেষ্ট ভাল লেখেন। আপনার সেই কথাটা আমাকে আজও শান্তি দেয়— ক্ষুধার গল্প আছে বলেই অন্নের কথা সবাই বলে। আপনার লেখায় চেতনার দম্ভ রয়েছে। মাঝে মাঝে ভাবি, কবিতাই তো আপনার অস্ত্র।
শান্ত সমর সেন।
- সমরবাবু, আমার মনে হয়, কবিতাই পারে অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করতে। তবে ভাল কবিতা লিখতে গেলে ভাল ভাষা ও জীবনের অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। আমি তো সবাইকে বলি আমি আমার ভাষার জন্য প্রাণ দিতেও রাজি। রবীন্দ্রনাথের বঙ্গাব্দ তিরিশ সংখ্যাটা পড়লে জানবেন মাতৃভাষা কী?
বললেন মোহিনীমোহন।
খানিক ভাবলেন সমর সেন। বিরতির পর উদাস স্বরে বললেন,
- পড়েছি মোহিনীবাবু। আসলে
রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে মহাসমস্যার বিষয়। তাঁর সব লেখা হয়তো আমি বুঝতে পারিনি।
তবে তাঁর শেষের কবিতাগুলো অন্যরকম। আমার ভাল লাগে।
- আপনি তো বললেন না সমরবাবু, অসময়ে কবিতা কেন ছাড়লেন? যে মানুষটা লিখতে পারে— তুমি যেখানেই যাও /... হঠাৎ শুনতে পাবে / মৃত্যুর গম্ভীর অবিরাম পদক্ষেপ / আর আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় যাবে? সেই মানুষ কবিতা ছাড়লে কবিতার অসুখ হয়ে যাবে মশাই।
বন্ধুর মতো বললেন মোহিনীমোহন।
- কবিতাকে ছাড়তে চাইনি মোহিনীবাবু। চারদিকের পরিস্থিতি আমাকে বড় কষ্ট দেয়। কবিতা বড্ড ব্যক্তি-কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। সমাজ-মানুষ কবিতায় আর নেই। সেদিন মলয়বাবুর সঙ্গেই এ নিয়ে কথা হলো। তিনিও একই কথা বললেন। আপনি তো জানেন, আমি কোনদিন আপস করতে শিখিনি। স্টেটসম্যান, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডস-এর চাকরি ছেড়েছি। নিজের কথা বলব বলে ফ্রন্টিয়ার বানিয়েছি।
কথার মধ্যে একটা দম্ভ রয়েছে।
- আপনার সব খবর রাখি মোহিনীবাবু। দেশে-বিদেশে আপনার নাম-ডাক বাড়ছে। মলয়বাবুর কাছে শুনলাম, কেতকীর পাশাপাশি নাকি মর্মবীণা, নীহার, মুগবেরিয়ার সম্পাদনার কাজও করছেন?
লজ্জায় পড়ে গেলেন মোহিনীমোহন।
- আপনারা প্রশংসা করলে সাহস পাই। তাছাড়া ওগুলো সব পাক্ষিক।
- সাহস যদি পেতেই হয় তাহলে মলয়বাবুর কাছ থেকে পান।
অভিভাবকের মতো বললেন সমর সেন।
- কেন?
- খবর পাননি? মলয়বাবু তো সাহিত্য অ্যাকাডেমি নিলেন না।
- লোকটার জেদ আছে সমরবাবু।
স্বীকার করলেন মোহিনীমোহন।
- আক্ষেপ কী জানেন, মানুষটাকে কেউ বুঝল না। সুনীল সেদিন পাশে থাকলেও সুনীলের নাকি মলয়ের আন্দোলনের ধরনটা পছন্দ নয়। চেনাজানা মানুষের মধ্যে উৎপলকে দেখেছি মলয়ের পাশে দাঁড়াতে। সবার সামনেই উৎপল বলেছিল, আক্রান্ত হবার পরেও মানুষটা মাথা নত করেনি। লোকে বলে মলয়ের কবিতা সবার সামনে পড়া যায় না। আপনি বলুন তো— নিজের মাথা কেটে পাঠালুম আজকের ভ্যালেন্টাইন দিনে। এই রকম কথা কে বলতে পারে?
সমরবাবুর সঙ্গে একমত মোহিনীমোহনবাবু।
- ১৯৬৪ সালে যখন গ্রেফতার হলেন তখন আমার খুব খারাপ লেগেছিল। পরে জেনেছিলাম, ভদ্রলোক নাবারডে চাকরি করেন। হাংরি আন্দোলনের প্রাথমিক খসরা তিনিই তৈরি করেছিলেন। যদিও পরে সাহায্য করেছিল সমীর, শক্তি, দেবী। তার পরে আসে বিনয়, উৎপল, ফাল্গুনী।
মোহিনীমোহনবাবুর কথার সঙ্গে বাড়তি তথ্য সংযোগ করলেন সমরবাবু।
- কে আর এসব মনে রাখেন বলুন? মাটির গন্ধ না জেনে, মাটির ইতিহাস না জেনেই সবাই এখন কবি। দলের রং দেখে রাজনীতি বন্ধ হোক। রাজনীতি করতে হলে দলের আদর্শকে জানতে হবে। মলয়বাবুর নামগন্ধ উপন্যাস কলকাতার প্রকাশকরা ফিরিয়ে দেন। পথের পাঁচালীর মতো অবস্থা অনেকটা। আমার একটা মজার কথা মনে হয়, মলয়ের শেষটায় বোধহয় নবারুণ শুরু।
- ঠিক কথা সমরবাবু। আমি তো আমার কবিতায় এত আগুন আনতে পারব না।
- আপনার লেখায় মাটির গন্ধ আছে মোহিনীবাবু। আপনার জাতক কবিতার সেই কথাগুলো— প্রসব যন্ত্রণার কে তুমি আকাশ ফাটাও। আপনি পুরুলিয়ার মানুষ হতে পারেন, তবে আপনার লেখায় সাবেক বাংলার গল্প লুকিয়ে আছে।
কথার ফাঁকে থেমে গেলেন। খানিক পরে উত্তেজিত হয়ে সমর সেন বলে উঠলেন,
- আপনি জানতে চাইছিলেন না আমি
কেন লেখা ছাড়লাম? উত্তরটা আপনারা কবিতা থেকে ধার করেই বলি।
গোপাল বাগানের ঝড় কবিতায় আপনি লিখেছিলেন— বয়স অনেক হলো
সত্তর পেরিয়ে গেছি কবে / ভালবাসাহীন একা পড়ে আছি।
- এত খুঁটিয়ে পড়েছেন সামান্য অজ শিয়ালডাঙ্গা গ্রামের কবির কবিতা?
অবাক মোহিনীবাবু।
- এসেছিলাম নতুন কবিতা শোনাব বলে। এত কিছু পাবো ভাবিনি। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার কথা মনে পড়ছে।
- রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আমাকে প্রথম দিকে খুব জ্বালাত। ওদের মতো লেখা হয়ে যেত। পরে অবশ্য নিজেকে আলাদা করেছি।
সমর সেনের কথায় অনুতাপ।
- কোন সমস্যা সমরদা?
জানতে চাইলেন মোহিনীমোহন।
- আমার আর কবিতা লিখতে ভাল লাগছে না। বিষ্ণু দে’কে বলে এলাম সে কথা।
শুনে অবাক হলেন মোহিনীমোহন।
- সেকি সমরবাবু, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত আপনার লেখা পড়ে বলেছেন আপনার লেখা টেকসই হবে। আর আপনি কিনা লেখা ছেড়ে দেবেন?
- ভাল লাগছে না মোহিনীবাবু। তাছাড়া আপনি আছেন, মলয় আছে, বীরেন্দ্র, সারদা তো রয়েছে।
বললেন সমরবাবু।
- আপনি চলে গেলে কে লিখবে— মাঝে মাঝে তোমার চোখে দেখেছি / বাসনার বিষন্ন দুঃস্বপ্ন?
মোহিনীমোহন বোঝাতে লাগলেন সমর সেনকে।
- আমার থেকে আপনি যথেষ্ট ভাল লেখেন। আপনার সেই কথাটা আমাকে আজও শান্তি দেয়— ক্ষুধার গল্প আছে বলেই অন্নের কথা সবাই বলে। আপনার লেখায় চেতনার দম্ভ রয়েছে। মাঝে মাঝে ভাবি, কবিতাই তো আপনার অস্ত্র।
শান্ত সমর সেন।
- সমরবাবু, আমার মনে হয়, কবিতাই পারে অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করতে। তবে ভাল কবিতা লিখতে গেলে ভাল ভাষা ও জীবনের অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। আমি তো সবাইকে বলি আমি আমার ভাষার জন্য প্রাণ দিতেও রাজি। রবীন্দ্রনাথের বঙ্গাব্দ তিরিশ সংখ্যাটা পড়লে জানবেন মাতৃভাষা কী?
বললেন মোহিনীমোহন।
খানিক ভাবলেন সমর সেন। বিরতির পর উদাস স্বরে বললেন,
- আপনি তো বললেন না সমরবাবু, অসময়ে কবিতা কেন ছাড়লেন? যে মানুষটা লিখতে পারে— তুমি যেখানেই যাও /... হঠাৎ শুনতে পাবে / মৃত্যুর গম্ভীর অবিরাম পদক্ষেপ / আর আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় যাবে? সেই মানুষ কবিতা ছাড়লে কবিতার অসুখ হয়ে যাবে মশাই।
বন্ধুর মতো বললেন মোহিনীমোহন।
- কবিতাকে ছাড়তে চাইনি মোহিনীবাবু। চারদিকের পরিস্থিতি আমাকে বড় কষ্ট দেয়। কবিতা বড্ড ব্যক্তি-কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। সমাজ-মানুষ কবিতায় আর নেই। সেদিন মলয়বাবুর সঙ্গেই এ নিয়ে কথা হলো। তিনিও একই কথা বললেন। আপনি তো জানেন, আমি কোনদিন আপস করতে শিখিনি। স্টেটসম্যান, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডস-এর চাকরি ছেড়েছি। নিজের কথা বলব বলে ফ্রন্টিয়ার বানিয়েছি।
কথার মধ্যে একটা দম্ভ রয়েছে।
- আপনার সব খবর রাখি মোহিনীবাবু। দেশে-বিদেশে আপনার নাম-ডাক বাড়ছে। মলয়বাবুর কাছে শুনলাম, কেতকীর পাশাপাশি নাকি মর্মবীণা, নীহার, মুগবেরিয়ার সম্পাদনার কাজও করছেন?
লজ্জায় পড়ে গেলেন মোহিনীমোহন।
- আপনারা প্রশংসা করলে সাহস পাই। তাছাড়া ওগুলো সব পাক্ষিক।
- সাহস যদি পেতেই হয় তাহলে মলয়বাবুর কাছ থেকে পান।
অভিভাবকের মতো বললেন সমর সেন।
- খবর পাননি? মলয়বাবু তো সাহিত্য অ্যাকাডেমি নিলেন না।
- লোকটার জেদ আছে সমরবাবু।
স্বীকার করলেন মোহিনীমোহন।
- আক্ষেপ কী জানেন, মানুষটাকে কেউ বুঝল না। সুনীল সেদিন পাশে থাকলেও সুনীলের নাকি মলয়ের আন্দোলনের ধরনটা পছন্দ নয়। চেনাজানা মানুষের মধ্যে উৎপলকে দেখেছি মলয়ের পাশে দাঁড়াতে। সবার সামনেই উৎপল বলেছিল, আক্রান্ত হবার পরেও মানুষটা মাথা নত করেনি। লোকে বলে মলয়ের কবিতা সবার সামনে পড়া যায় না। আপনি বলুন তো— নিজের মাথা কেটে পাঠালুম আজকের ভ্যালেন্টাইন দিনে। এই রকম কথা কে বলতে পারে?
সমরবাবুর সঙ্গে একমত মোহিনীমোহনবাবু।
- ১৯৬৪ সালে যখন গ্রেফতার হলেন তখন আমার খুব খারাপ লেগেছিল। পরে জেনেছিলাম, ভদ্রলোক নাবারডে চাকরি করেন। হাংরি আন্দোলনের প্রাথমিক খসরা তিনিই তৈরি করেছিলেন। যদিও পরে সাহায্য করেছিল সমীর, শক্তি, দেবী। তার পরে আসে বিনয়, উৎপল, ফাল্গুনী।
মোহিনীমোহনবাবুর কথার সঙ্গে বাড়তি তথ্য সংযোগ করলেন সমরবাবু।
- কে আর এসব মনে রাখেন বলুন? মাটির গন্ধ না জেনে, মাটির ইতিহাস না জেনেই সবাই এখন কবি। দলের রং দেখে রাজনীতি বন্ধ হোক। রাজনীতি করতে হলে দলের আদর্শকে জানতে হবে। মলয়বাবুর নামগন্ধ উপন্যাস কলকাতার প্রকাশকরা ফিরিয়ে দেন। পথের পাঁচালীর মতো অবস্থা অনেকটা। আমার একটা মজার কথা মনে হয়, মলয়ের শেষটায় বোধহয় নবারুণ শুরু।
- ঠিক কথা সমরবাবু। আমি তো আমার কবিতায় এত আগুন আনতে পারব না।
- আপনার লেখায় মাটির গন্ধ আছে মোহিনীবাবু। আপনার জাতক কবিতার সেই কথাগুলো— প্রসব যন্ত্রণার কে তুমি আকাশ ফাটাও। আপনি পুরুলিয়ার মানুষ হতে পারেন, তবে আপনার লেখায় সাবেক বাংলার গল্প লুকিয়ে আছে।
কথার ফাঁকে থেমে গেলেন। খানিক পরে উত্তেজিত হয়ে সমর সেন বলে উঠলেন,
- এত খুঁটিয়ে পড়েছেন সামান্য অজ শিয়ালডাঙ্গা গ্রামের কবির কবিতা?
অবাক মোহিনীবাবু।
- এসেছিলাম নতুন কবিতা শোনাব বলে। এত কিছু পাবো ভাবিনি। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার কথা মনে পড়ছে।
- রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আমাকে প্রথম দিকে খুব জ্বালাত। ওদের মতো লেখা হয়ে যেত। পরে অবশ্য নিজেকে আলাদা করেছি।
ক্রমশ…
অপূর্ব
ReplyDelete