প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দেবীর বিসর্জন | বিশ্ব প্রসাদ ঘোষ

বাতায়ন/মাসিক/কবিতা/২য় বর্ষ/১৮তম সংখ্যা/২৩শে কার্ত্তিক , ১৪৩১ চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা | কবিতা বিশ্ব প্রসাদ ঘোষ দেবীর বিসর্জন তুমি ...

Friday, November 8, 2024

মৃণাল ও একটি অনবহিত সিনে সংবাদ [৪র্থ পর্ব] | শাশ্বত বোস

বাতায়ন/মাসিক/ধারাবাহিক/২য় বর্ষ/১তম সংখ্যা/২৩শে কার্ত্তিক, ১৪৩১

চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা | ধারাবাহিক গল্প

শাশ্বত বোস

মৃণাল ও একটি অনবহিত সিনে সংবাদ

[৪র্থ পর্ব]

"সেদিনও পালান’ মরেছিল কলকাতা শহরের বুকে কোন এক হাঁড়কাঁপানো শীতের রাতে ভেন্টিলেটর বিহীন মৃত্যুকূপেএকটু উষ্ণতার আশায় পালান আজ এই হলের মধ্যে আবার মরেপালানদের জন্মই বুঝি হয় শুধু মরবার জন্য।"


অঙ্কন- শাশ্বত বোস

পূর্বানুবৃত্তি পৌষের কোন হিম ধরা রাতে কুয়াশার সর সরিয়ে, মৃত্যু এসে ওর মাকে নিয়ে চলে গেছিল, কোন পা-টা আগে ফেলেছিল, এখন আর মনে পড়ে না নিধিরজগৎ সিনেমায় বেশ কিছুদিন হলো শো বন্ধ যাচ্ছে হল মালিকের সাথে স্টাফেদের আকচাআকচি চলছে কিছু নিয়েমা মারা যাবার পর নিধি ছোট ভাই বোনদের নিয়ে কল্যাণী সীমান্তের মামাবাড়ি গিয়ে উঠেছিল মামা ওদের খুব একটা দেখতে পারতেন না অথচ নিঃসন্তান রাঙা মাইমা বুক দিয়ে আগলাতেন। তারপর…
 
চোখের পাতা ক্রমশ ভারী হয়ে আসে নিধির পাতলা মধুর মতো টলটলে বিকেলগুলোয় কানা ভাঙা অ্যালুমিনিয়ামের চায়ের কাপের উপর দিয়ে পিঁপড়েটা এদিক হয়ে ওদিকে চলে যেত পাশের কারশেড থেকে একটা মালগাড়ি চলে যেত, অনেক্ষ ধরে দীর্ঘ একঘেঁয়ে একটা বিচ্ছিরি শব্দ করে ঐ শব্দটার পর রোদের তাত পড়ে গেলে ফিরে আসত অনিবার্য রোববারের বিকেলগুলো, মস্ত একটা সোনার ডিমের ভেতর দিয়ে টিভির পর্দা জুড়ে তখন কেবল ধোঁয়া উনুনের ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া, উঠতি ছেলের মুখের সিগারেটের ধোঁয়া, শ্মশানের চিতার ধোঁয়া সেই দুকূল ছাপানো ধোঁয়ার মাঝে পুরোনো লেপ কম্বলের উপর সাবানগুঁড়োর মতো ধামসে পরে থাকে নিধির অন্ধকার কৈশোর কুয়াশা খিমচে হঠাৎ সেই ধোঁয়ার ভেতর থেকে উঁকি দেয় ওদের কলোনির গদাই-দা, অল্প বয়সে যে নকশাল হয়ে গেছিল ওকে খুঁজতে একদিন পুলিশ এলো, কলোনিটা ঘিরে ফেলল চতুর্দিক দিয়ে প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ, জংধরা একটা শ্লোগান, আবার শব্দ ব্যস, প্যালিওলিথিক যুগ থেকে একটা সংবেদনশীল আলো গড়িয়ে পরে নিধির চোখদুটো সাদা হয়ে গেল
 
সেদিন সন্ধ্যায় বাজারের ভিতর কালীমন্দিরটায় ফলাহারিণী উৎসব সন্ধে থেকেই শ্যামাসংগীত বাজছে এবেলা তাই হোটেলও বন্ধ হারান ব্যাটা কোথায় বসে গাঁজা টানছে নিধি মন্দিরে একটা প্রণাম ঠুকে জগৎ সিনেমার দিকে হাঁটতে শুরু করল দোকানপাট একটু একটু করে বন্ধ হতে শুরু করেছে সবে সিনেমাহলের টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে নিধি সোজা জিজ্ঞেস করল, “ইভনিং শো-এর একটা টিকেট হবে?”
আরে টিকিট লাগবে না, এটা সরকারি শোমৃণাল সেন রেট্রোস্পেক্টিভ’।”
কথাটার মাথামুন্ডু কিছু বুঝল না নিধি ফ্রিতে সিনেমা! এও আবার হয়! চুপচাপ ঢুকে অন্ধকার হলে বসে পড়ল একটা চেয়ার দখল করে হলে সর্বসাকুল্যে পাঁচটা লোকও নেই অনেকদিন হলটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে, সিটগুলো ধুলো পরে গিয়েছে ফাঁকা হলের সুবিধে নিতে ছেলেমেয়ে সব হলে ঢুকে কোণের সিটগুলো দখল করে নিয়েছে এরই মধ্যে পর্দায় সিনেমা চলছে, “খারিজ”। সিনেমাটা নিধি দেখেছিল বহু বছর আগে নিধির তখন কাঁচা বয়স শেষ বিকেলের অতি বেগুনি রশ্মি তখন স্পর্শ করেনি ওদের ক্যাম্পের ভেতর চৌকির তলায় উপুড় করে রাখা কাঁসার বাসনগুলোকে ছবিটাকে তখন খুব সহজ লাগেনি নিধির দূরদর্শনের পর্দায় সেদিনও পালানমরেছিল কলকাতা শহরের বুকে কোন এক হাঁড়কাঁপানো শীতের রাতে ভেন্টিলেটর বিহীন মৃত্যুকূপে, একটু উষ্ণতার আশায় পালান আজ এই হলের মধ্যে আবার মরে, পালানদের জন্মই বুঝি হয় শুধু মরবার জন্য মৃত্যুর আগের যে ব্যাথা ও বিষন্নতা, সেটা ওরা টের পায় না ঠিক করে বড় অসাবধানী মৃত্যু ৩০ ফুটের পর্দা জুড়ে পালান পুড়ছে, ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে গোটা হলটা সেই নামগোত্রহীন ধোঁয়াটা কুন্ডলী পাকিয়ে এই দমবন্ধ কালো ঘরটায় কাঁদতে থাকে, পালানের বাপের মুখ হয়ে মৃত্যুর কম্পাঙ্ক ক্রমে স্থির হয়ে এলেও মৃত্যুবোধটা আত্মগোপন করতে পারে না কোন ভাবে বেঙ্গল লজের প্রথম দিকের দিনগুলোর কথা মনে পরে যায় নিধির, কিংবা আরো আগের কথা, যখন ও বাজারের ভিতর দোতলা ভাঙা বাড়িটার এক কোণে পরে থেকে রাত কাটাত কালাচ সাপের মতো ঘুমহীন শীতের কোন রাতে বিহারি মুটে দুটো, মৃত্যুমুখী অন্ধকারটাকে গায়ে পেঁচিয়ে এগিয়ে এসেছিল ওর দিকে এক ধাক্কায় ওদের ছিটকে ফেলে দিয়ে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসেছিল ও মুহূর্তে শহরটার সব জাদুগরী উধাও হয়ে গিয়ে, নিধি ফিরে গেছিল রানাঘাট ক্যাম্পের ভিটেমাটি ফেলে আসা পোড়া লেগে যাওয়া জীবনে গলাটেপা মধ্যরাতে বাজারের অলিগলি ঘুরে, হার ভাঙা শীতটাকে সঙ্গে করে মুখোশহীন পৃথিবীর ছবি এঁকেছিল খোলা আকাশের নীচে নীল রং ধার করে
রাত নটায় শো শেষ হল পুরো হল জুড়ে তখন শুধু নিধি আর তার ঠিক বিপরীত গোলার্ধের শত বসন্ত পার করা একটি মানুষ ও তাঁর সৃষ্টি করা সার্বভৌম জীবন চেতনা গত দেড় ঘন্টা ধরে যিনি চির বিচ্ছেদের দাঁড়ে নিধিকে টেনে নিয়ে গিয়ে, ওর জীবনের আকাঙ্খাকে আরো তীব্রতর করে তুলেছেন নিধি এখন আরো তীব্র ভাবে বাঁচতে চায়, ওর বর্তমান আর ভবিষ্যতের আবর্তে ঠিক এমনি ভাবে বাঁচতে নিধি শেষ কবে চেয়েছিল?
হল থেকে বেরিয়ে নিধি হোটেলে ফেরে না আজ রাতটা এমনিতেও ঘুম হবে না একটু পর বাজারের ভেতর মন্দিরের কীর্তন বন্ধ হয়ে হিন্দি গান চালিয়ে মদ খেয়ে উদ্দাম নাচ শুরু হবে কখন থামবে কে জানে! অনেক রাতে ফিরে আসবে নিধি ওর চেনা জগতে বাজার থেকে ধেড়ে ইঁদুরগুলো দৌড় দেবে, খেলার মাঠের গোলহীন স্টপারের মতো। হোটেলের হেঁশেল জুড়ে এঁটো নিয়ে লোফালুফির প্র্যাক্টিস শুরু করে দেবে নির্বাক দর্শক হয়ে সেই খেলা দেখবে নিধি মনের ভেতর তপতপে একটা সেন্টিমেন্টাল মনস্তাপে, আরো ভাল দর্শক হয়ে ওঠার প্রস্তুতি নেবে
কাল সারারাত ধরে নিধি ভেবেছে গুপ্তদাকে বলে জগৎ সিনেমায় যদি সবকটা বই ও দেখতে পেত! পয়সা তো লাগছে না কিন্তু কী ভীষণ একটা উত্তেজনা! যেন খামখেয়ালি মধু তামস, সংস্কারহীন যজ্ঞ চালাচ্ছে পুরো জায়গাটা জুড়ে সেই যজ্ঞের আগুনে ওর পুড়তে ইচ্ছে করে ভীষণ ওর গলার কাছটা শুকিয়ে আসে অস্বাভাবিক খিদেতে পেটটা মোচড় দিয়ে ওঠে মনে হয় গায়ে চাপানো ধার করা চামড়াটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে, লালচে মাংসটাকে প্রত্যক্ষ করে আবার একটা শব্দ হোক, হাজার মানুষের সমবেত কোরাস হয়ে সেটা রক্তারক্তি একটা কাণ্ড ঘটাকইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘একদিন প্রতিদিন’, সব কটা সিনেমা নিধি দেখতে চায় ওর নিশ্চল জীবনে গলগল করে প্রাণ ফিরে আসে যেন ন্ধের পরে ওর তো আর তেমন কাজ থাকে না হোটেলে, গুপ্তদা কেন ওকে ছুটি দেবেন না কদিন হাফবেলা করে! ইনসমনিয়ার রূপ ধরে এই কথাটা বার বার নৈতিকতা আর হকের সমকালীন সংঘাত হয়ে বাজারের চার দেওয়ালের মাঝে ধাক্কা খেয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিধি ওর কণ্ঠ সময়ের কোন অদৃশ্য কোণ থেকে ওর মুখে মলত্যাগ করতে করতে উড়ে গেছে সংক্রান্তির দিকে
 

ক্রমশ…

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)