বাতায়ন/মাসিক/ধারাবাহিক
গল্প/২য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১
মোহন
রায়হান সংখ্যা | ধারাবাহিক
গল্প
অপূর্ব দাশগুপ্ত
বহ্নিশিখা
[১ম পর্ব]
"যে মেয়েকে সাধ্যসাধনা করে কেউ গাওয়াতে পারে না, সে নিজে থেকে গাইছে। তিমির বসে। গান যখন শেষ হয়, তিমির মুখ তুলে দেখে, মুনিয়ার চোখে প্লাবন নেমেছে। বড় মুশকিলে পড়ে তিমির। কী বলবে এখন, তিমির ভেবে পায় না। মুনিয়াটা এমনিই মেয়ে।"
এক এক দিন হাওয়া ওঠে পাগলের
মতো। শুকনো যত পাতা, অশ্বত্থ, বাঁশ, পেয়ারা আর যত সব হাবিজাবি, ছেঁড়া কাগজের টুকরো,
ন্যাকড়া, এইসব নিয়ে মশকরা করে এলোমেলো হাওয়ার স্রোত। একবার গাছতলা থেকে এদের উড়িয়ে
নিয়ে বেড়ার গায়ে চেপে ধরে, আবার ক্ষণিক পরেই তাদের পাক খাওয়ায় শূন্যে। পর্যাপ্ত
ধুলো ওড়ে। বাতাসের এইসব পাগলামিকে প্রশ্রয় দিতেই যেন দিনপতি, তার প্রভা সেদিন কমিয়ে
আনে। চারদিকের এই ঘোলাটে আবহাওয়া দেখলে মুনিয়ার মেজাজ খুব বিগড়ে যায়। মন তার বারোমাস
খারাপ। যেদিন সে পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়, যেদিন তার জন্মদিন, যেদিন নতুন লাভলেটার পায়,
কোনদিনই মুনিয়ার মনে খুশি নেই। আজকের এই পাগল হাওয়াও তাকে বোধহয় কাঁদাবে।
কাঠের দোতলা বাড়িটির বারান্দায়
একা একটি বেতের বড় চেয়ারে বসে আছে সে। একটা গানের লাইন মনে পড়তে চায় না কিছুতে।
বড় অশান্তি।
এ এক গঞ্জ এলাকা। যথেষ্ট দূরত্ব
রেখে গৃহস্থদের বাড়িগুলি শান্ত দাঁড়িয়ে থাকে। কাঠের দেওয়াল আর টিনের ছাউনি, মাটি
থেকে একটু উঁচুতে খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে। খুব হাতির ভয় ছিল নাকি একসময়, এখনও কিছু
অবশিষ্ট আছে তাদের ভয়। জানলা দিয়ে হাতির শূর প্রবেশ করছে এ দৃশ্য ভাল লাগে না! তাই
এই উচ্চতা। সামনে বাগান আছে প্রায় সবকটি বাড়িতেই। আম কাঁঠাল, লিচু, ডেউয়া, নাগকেশর,
বড় বড় এইসব গাছ যেমন আছে, তেমনই আছে গোলাপ, জুঁই, কলাবতির ঝোপ। দূরে জলরঙে আঁকা পাহাড়
পূর্বে দেখ যায়। পাদদেশে অরণ্য যেন পাহাড়ের ফেন্সিং।
মুনিয়াদের বাড়িটির শ্রী একটু
আলাদা, অন্য বাড়িগুলির চেয়ে বেশি সুন্দর। তাদের বাড়ির চালের রং ঝকঝকে রুপালি আর
কাঠের দেওয়ালের রং বটল গ্রীন। মালিদের যত্নে তাদের বাগান সেজে থাকে প্রতি ঋতুর সঙ্গে
মানিয়ে। মুণিয়ার বাবার বড় কাঠের ব্যবসা। কিন্তু এ কারণে তার সময় বড্ড কম। মুণিয়ার
মা-ও দিনের পর দিন শুয়ে থাকেন, কোন শারীরিক অসুবিধে নেই, তবু। তিনিও অকারণে দুঃখী।
সংসার চালায় মাইনে করা লোকেরা।
তিমির যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে
হেঁটে, তার সাইকেল বিগড়েছে। অনিলদার দোকানে তার চিকিৎসা চলছে। মুনিয়াদের বাড়ি পার
হলে পড়ার লাইব্রেরি। দুপুরের রসদ জোগাতে এই হাওয়ার মধ্যে সে বেরিয়েছে। বিলে 'আবার
যখের ধন' বইটি কাল ফেরত দিয়েছে। বইটি তুলতে হবে আগে গিয়ে। দশটা বেজে গেছে। লাইব্রেরি
খুলল এবার।
মুনিয়া রাস্তায় তিমিরকে দেখতে পেয়েই
ডাকে,
-তিমির, উপরে উঠে আয়, বাগানের
গেট খোলা।
-লাইব্রেরি থেকে বই তুলতে যাচ্ছি, ফেরার
পথে আসি?
-না, এক্ষুনি আয়।
তিমির কী আর করে, 'দ' আকারের
কাঠের সিঁড়ি ভেঙে সে দোতলার বারান্দায় পৌঁছায়। গোল বেতের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
বিপরীত দিকে চেয়ারে মুনিয়া বসে আছে। মলিন মুখশ্রী, তবু মুখখানিতে কী মধু মাখা। চোখদুটি
গভীর দীঘির মতো, গৌরবর্ণের মুখে কালো চোখদুটি কী যেন মায়া ছড়ায়। কোন ভূমিকা ছাড়াই
মুনিয়া বলে,
-ওই গানটা তোর মনে আছে
-কোন গান বলবি তো!
-তুই গতবার রবীন্দ্রজয়ন্তীতে
গাইলি 'মেঘ বলেছে যাব যাব'। গাইলি না দেবব্রত বিশ্বাসকে নকল করে? তারপর আমি কোন গানটা
গাইলাম, বল না শিগগির।
-নাথ হে, প্রেম পথে বাধা, এটাই
তো গেয়েছিলি।
তিমির মুনিয়াকে খুশি হতে দেখে।
খুশি গলায় মুনিয়া বলে,
-বোস না তিমির। গানটা মনে করিয়ে
দিলি। এইকথা বলে সে তিমিরের উপস্থিতি ভুলেই যেন গাইতে থাকে, নাথ হে প্রেম পথে বাধা…
যে মেয়েকে সাধ্যসাধনা করে
কেউ গাওয়াতে পারে না, সে নিজে থেকে গাইছে। তিমির বসে। গান যখন শেষ হয়, তিমির মুখ
তুলে দেখে, মুনিয়ার চোখে প্লাবন নেমেছে। বড় মুশকিলে পড়ে তিমির। কী বলবে এখন, তিমির
ভেবে পায় না। মুনিয়াটা এমনিই মেয়ে।
মুনিয়াই তাকে উদ্ধার করে, হাতের উলটো পিঠে
চোখ মুছে বলে,
-তুই এবার যা তিমির।
ক্রমশ…
ভালো লাগলো। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteপরাণ মাঝি