প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

প্রথম ভালবাসা | অমল চ্যাটার্জী

বাতায়ন/ মাসিক / ছোটগল্প /২য় বর্ষ/২ ৮ তম সংখ্যা/ ২রা ফাল্গুন,   ১৪৩১ অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সংখ্যা | ছোটগল্প অমল চ্যাটার্জী   প্রথম ভালবাসা ...

Saturday, February 15, 2025

ম্যানেজার | তুষার সরদার

বাতায়ন/মাসিক/ছোটগল্প/২য় বর্ষ/২তম সংখ্যা/২রা ফাল্গুন, ১৪৩১
অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সংখ্যা | ছোটগল্প
তুষার সরদার
 
ম্যানেজার

"সঙ্গে সঙ্গে পেয়ারাগুলো বেরিয়ে এল। দাম দেওয়া ভদ্রলোকের হাতে কেনা দুটো পেয়ারা ছাড়া অন্য একজনের হাতে দুটো, আরেকজনের হাতে একটা পেয়ারা দেখা দিল। চতুর্থজন বোধহয় তেমন দক্ষ ম্যানেজার নন। তাঁর কুণ্ঠিত হাত একেবারে ফাঁকা। অন্যরা তাঁর দিকে কিছুটা ভৎর্সনার ভাবে তাকালেন।"

শেষবিকেলের কলকাতামুখী আপ ইএমইউ লোক্যাল ট্রেন। মাঝারি চাপের ভিড়। নানাশ্রেণির সাধারণ স্থানীয় যাত্রীদের ভিড়ই বেশি। তাছাড়া মহানগরবাসী কিছু ছোটো বা মাঝারি চাকুরিজীবী নিত্যযাত্রী শহরতলি থেকে যথাসম্ভব দ্রুত অফিস সেরে রোজকার মতো এইসময়ে যে যার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। বড় চাকুরিজীবী যে নেই তা নয় তবে তাঁরা স্বাভাবিক ভাবে সংখ্যায় কম

 
এক কোণের দিকে এই সাতমিশেলি ভিড়ের মধ্যে বিশিষ্ট ওঁরা চারজন মখোমুখি বসে আছেন। শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার স্টেশন থেকে ওঁরা প্রত্যহ এই নির্দিষ্ট ট্রেনে ওঠেন এবং ওই নির্দিষ্ট সিটে বসে ওঁরা ফিরে যান মহানগরীতে। ওঁদের কথাবার্তায় নানাধরণের প্রসঙ্গ থেকে বোঝা যাচ্ছিল ওঁদের চারজনের প্রত্যেকেই শহরতলির কোনো-না-কোনো বড় শাখা অফিসের ম্যানেজার বা ওইরকম উচ্চ পদাধিকারী
 
ঝকঝকে মহার্ঘ আধুনিক পোশাকপরা মার্জিত তৃপ্ত চেহারার চারজন সুশিক্ষিত সম্পন্ন বাঙালি ভদ্রলোক পরস্পরের সঙ্গে অন্তত সিক্সটি পারসেন্ট ইংরেজিতে নানাধরণের ভারী ভারী প্রসঙ্গে কথাবার্তা বলে চলেছেন। শহরতলির রুগ্ন অশিক্ষিত ভিড়ের মধ্যে ওঁরা যেন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম
 
এমন সময়ে একটা ম্যাড়মেড়ে রোগাটে ছেলে, বড় জোর বছরদশেক বয়স হয়তো হবে তার, মাঝারি আকারের একটা পেয়ারার ঝুড়ি মাথায় নিয়ে সেই কামরাতে উঠল। উঠেই সে তার অনভ্যস্ত ক্লান্ত কচিগলায় একঘেয়ে ভাবে হেঁকে ঠল
‘দু’টাকায় দুটো করে! – দু’টাকায় দুটো পেয়ারা!’

তার পরনে একটা রংহারা ঢোলা রুগ্ন হাফপ্যান্ট। গায়ের আধমরা হাওয়াই শার্টটার নীচের বোতামটা নেই। আর দরকারও নেই সেটার। কারণ পাশের বোতামঘরটাই ছিঁড়ে গেছে। পরের বোতামটা সাদা, সেটার একদিকে একটু কানাভাঙা। তার উপরের বোতামটা খাকি রংয়ের, একেবারে গলার কাছেরটা কালো।
 
কালোটা বোতামঘর থেকে আলগা হয়ে খুলে গেছে। হাফপ্যান্টের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসা সরু সরু ময়লাটে দুটো পায়ে দুরকমের বিবর্ণ ফিতে লাগানো ক্ষয়াটে হাওয়াই চটি। মাথার এলোমেলো রুখু চুলগুলো ফ্যাকাশে
বাদামি রঙের। অপুষ্টিজনিত শুকনো কচি মুখখানার এখানে-ওখানে ছোপ ছোপ ময়লার দাগ
 
ওঁরা চারজনই বোধহয় সামান্য ক্ষুধার্ত ছিলেন। সেই দুটোর সময় অত্যন্ত সমৃদ্ধ লাঞ্চের পর আর তেমন কিছু খাওয়া হয়ে ওঠেনি। এদিকে তিন ঘণ্টা অন্তর আহার্য গ্রহণ সুস্বাস্থ্য রক্ষায় খুব জরুরি। তাকে দেখে একজন সোল্লাসে বলে উঠলেন -
‘লুক! দেয়ার আর ফ্রেশ্ গুয়াভাজ্! ফুল অব প্রোটিন অ্যান্ড ভিট্‌মিন সি! আই থিংক ইউ অল আর ইন ওয়ান্ট অফ হ্যাভিং দোজ গুয়াভাজ্‌ নাউ। অ্যাই ছোঁড়া! আয়, দেখি এদিকে আয়।’

আধঝুড়ি প্রোটিন আর ভিটামিন ‘সি’ নিয়ে সে এগিয়ে এল ওঁদের কাছে। মাথা থেকে ঝুড়ি নামিয়ে বেশ কষ্টে সে তার প্যাংলা দুটো হাত দিয়ে ঝুড়িটা ধরে থাকল। কারণ একেবারে নীচে মেঝেতে নামিয়ে রাখলে ওঁদের সমৃদ্ধ ভুঁড়ির জন্য নিচু হয়ে পেয়ারা বাছতে বিশেষ অসুবিধা হবে। ওঁরা চারজনে মিলে যথাসম্ভব ঝুঁকে পড়ে ঝুড়িটা থেকে সাগ্রহে পেয়ারা বাছাই করতে লাগলেন। সেই সঙ্গে চলল অত্যন্ত নায্য দর কষাকষি -
‘দু’টাকায় মাত্র দুটো?
‘হ্যাঁ, আজ দুপুরে পাড়া টাটকা পেয়ারা।’
‘তোদের বাড়ির গাছের পেয়ারা বুঝি? তবে এত দাম চাইছিস?
‘আমাদের বাড়ির গাছ! আমাদের কোনো বাড়িই নেই তো গাছ কোথায় পাব? আমরা তো লাইনের ধারে ঝুপড়িতে থাকি। এসবই বাজার থেকে কিনে আনা।’
‘কিন্তু টাকায় দুটো মানেই তো একেবারে গলাকাটা দাম হাঁকাচ্ছিস রে!’
‘কী করব বাবু, অনেক চড়া দামে কিনতে হয়েছে।’
‘তোদের বাড়িতে – ইয়ে ঝুপড়িতে কে কে থাকিস?
‘মা, বাবা, একটা ছোট বোন আর আমি।’
‘তোর বাবা কী করে?
‘আমার বাবা ফেরিওলা।’
‘দু’টাকায় তিনটে করে দে-না।’
‘না বাবু, পারব না। বাজার বড্ড বেশি চড়া যাচ্ছে।’
‘আচ্ছা, তাহলে তিন টাকায় চারটে পেয়ারা দে।’
‘পারব না বাবু।’
‘পারবি না? তবে দুটো পেয়ারাই নিলাম।’
‘চারজনে তো খাবেন, চারটে পেয়ারা নিন।’
‘না! যা গলাকাটা দাম বলছিস! দুটো পেয়ারাই চারজনে ভাগাভাগি করে খাব।’

সমবেত বাছাবাছির পরে শেষপর্যন্ত দুটো পেয়ারা তুলে নিয়ে চারজনের মধ্যে একজন ভদ্রমানুষ যিনি ছেলেটার সঙ্গে এতক্ষণ কথা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি মরক্কো লেদারের ওয়ালেট বের করে তা থেকে দু’টাকার একটা কয়েন বের করে ছেলেটার হাতে দিয়ে দিলেন। তারপর যথেষ্ট জোরে জোরে যথেষ্ট আপশোশ ও সহানুভূতিপূর্ণ গলায় বলে উঠলেন -
‘হাও স্যাড! লুক দ্যাট বয়! কোথায় এই বাচ্চা ছেলেটা এখন স্কুলে যাবে, খেলবে, দৌড়োবে – কিন্তু তার কোনো উপায় নেই। হোয়্যাট আ ক্রুয়েল সোসিও-ইকনমিক্যাল ক্যন্ডিশ্যন ইজ রানিং ইন দিস আনফরচ্যুনেট্‌ কান্ট্রি!’
 
ঠিকমতো চেষ্টা করলে ছেলেটা হয়তো এই মহামূল্যবান, শিক্ষা-চপচপে, হৃদয়বান, করুণাময় কথাগুলোর খানিকটা অর্থ অন্তত বুঝতে পারত। কিন্তু সেরকম কোনো চেষ্টা করার বদলে নেহাৎই এক গেঁয়ো অশিক্ষিতের মতো শুধু তার পেয়ারা বিক্রির চেষ্টায় সে মলিন মুখে পেয়ারার ঝুড়িটা আবার তার মাথায় তুলে নিয়ে কামরার অন্যদিকে চলে গেল।
 
সঙ্গে সঙ্গে পেয়ারাগুলো বেরিয়ে এল। দাম দেওয়া ভদ্রলোকের হাতে কেনা দুটো পেয়ারা ছাড়া অন্য একজনের হাতে দুটো, আরেকজনের হাতে একটা পেয়ারা দেখা দিল। চতুর্থজন বোধহয় তেমন দক্ষ ম্যানেজার নন। তাঁর কুণ্ঠিত হাত একেবারে ফাঁকা। অন্যরা তাঁর দিকে কিছুটা ভৎর্সনার ভাবে তাকালেন। যিনি দামটা দিয়েছিলেন তিনি অত্যন্ত ভদ্র এবং চাপাগলায় বললেন -
ইশ্‌! ওকে হাবিজাবি নানা ফালতু কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখলাম, তবু অন্তত একটা পেয়ারা ম্যানেজ করতে পারলেন না?
 

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)