বাতায়ন/মাসিক/প্রবন্ধ/২য় বর্ষ/২৮তম সংখ্যা/২রা
ফাল্গুন, ১৪৩১
অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সংখ্যা | প্রবন্ধ
শিশির আজম
কবি
কখনও ভালমানুষ হয় না
শিশির আজম
"পুঁজিবাদী অর্থনীতি চায় মেহনতি মানুষের ঘাম আর রক্তের বিনিময়ে যে বিপুল সম্পদ প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টি হচ্ছে তা মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতির ঘরে তুলে দিতে। তবে সবটা না। এই সম্পদের ন্যূনতম একটা অংশ এই শ্রমিকদের জন্য ব্যয় করতে হয়। কেন-না এই শ্রমিকদের বাঁচিয়ে রাখবার দরকার আছে। এরা না থাকলে ক্ষেতে-খামারে-কারখানায় কাজ করবে কে?"
সবাই জানে আমি ভালমানুষ। কিন্তু আমি তো আদৌ ভালমানুষ না। তাহলে এমনটা সবাই ভাবে কেন? কারণ মুখোশ। আমি একটা মুখোশ পরে থাকি। এই কৌশল আমি নিয়েছি সুফিয়া কামালের কাছ থেকে। কলকাতায় বোরখা পরে সুফিয়া যখন 'ধুমকেতু'র অফিসে ঢুকতেন কাজী নজরুল ইসলাম মুচকি মুচকি হাসতেন। সুফিয়া ঈষৎ হেসে বলতেন কাজী দা'র
সঙ্গে
দেখা করতে এছাড়া তার উপায় নেই। সুফিয়া কাজীকে অনেকবার বলেছেন, উনি এখন
বোরখা পরছেন যেন ওর কন্যাদের কখনও এই অপ্রয়োজনীয় পোশাক পরতে না হয়। ব্যাপারটা এই।
যে রাষ্ট্রে যে সমাজে আমি বাস করি সেখানে এই মুখোশ আমার রক্ষাকবজ। না হলে এতদিন
আমি বেঁচে থাকতে পারতাম না। এরা আমাকে মেরে ফেলত। আমি চেয়েছি নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল
করতে আর নিজের কাজটা চালিয়ে যেতে। আমার কাজ কী? কবিতা লেখা। হ্যা, কবিতা লেখাই
আমার কাজ। কবিতা লেখা কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। না। নিশ্চয়ই এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ জগতে অনেক আছে। কিন্তু এই কাজটাই আমি পারি। এর
চেয়ে গুরুত্ববহ কোন কাজে আমার যোগ্যতা থাকলে সেটাই করতাম। কবিতার জন্য আলাদা কোন
মায়া আমার নেই। কবিতা না লিখলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে এমনটাও আমি ভাবিনে।
তাহলে কেন
করি এই কাজ? ওই যে
বললাম, অন্য
কোন কাজ আমি পারিনে। এটা প্রথম কথা। এখানে দার্শনিকতা দেখিয়ে লাভ নেই। ঋত্বিক যেমন
বলেছিলেন, মানুষের
কাছে পৌঁছবার জন্য সিনেমার চেয়ে বেটার কোন মাধ্যম তার কাছে থাকলে
সিনেমাকে কবেই লাত্থি মেরে চলে যেতেন! ঋত্বিকের এই মনোভাব আমারও। যদিও পার্টির
সদস্য হইনি, কিন্তু
ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতি তো করেছি। কেন? এরপর সক্রিয় রাজনীতি না করেও রাজনীতি
থেকে কেন এক মুহূর্তের জন্যও নিজেকে বিচ্যূত করতে পারিনি?
আসলে মানুষ
রাজনীতপ্রবণ জীব, সজ্ঞানে
বা অবচেতনে। সামন্তবাদে রাজনীতির চেয়ে অর্থনীতিই মুখ্য ছিল। এরপর পৃথিবীতে
সামন্তবাদের জায়গা নিয়েছে সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদ। এই দুটো দর্শনই বিকশিত হয়েছে
অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। হ্যাঁ, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি হয়ে উঠতে চায় মেহনতি মানুষের
মুক্তির আধার। আর পুঁজিবাদী অর্থনীতি চায় মেহনতি মানুষের ঘাম আর রক্তের বিনিময়ে যে
বিপুল সম্পদ প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টি হচ্ছে তা মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতির ঘরে তুলে
দিতে। তবে সবটা না। এই সম্পদের ন্যূনতম একটা অংশ এই শ্রমিকদের জন্য ব্যয় করতে হয়।
কেন-না এই শ্রমিকদের বাঁচিয়ে রাখবার দরকার আছে। এরা না থাকলে
ক্ষেতে-খামারে-কারখানায় কাজ করবে কে? আর কাজ না করলে পঁজি থেকে মুনাফা
আসবে কীভাবে? ফলে
এদের জন্য স্কুল দরকার হয়,
হাসপাতাল দরকার হয়। পুঁজিবাদের ভাষা বুঝবার জন্য আর পর্যাপ্ত মুনাফা অর্জনের
জন্য শ্রমিকের শরীর থেকে ঘাম-রক্ত শুষে নেবার পর তাকে আবার শোষনের সুবিধার্থে এই
সুবিধা রাষ্ট্র তাকে দেয়। রাষ্ট্র হলো শোষণের আইনসঙ্গত উৎকৃষ্ট যন্ত্র। আর এই
যন্ত্রের মালিক হলো পুঁজিবাদ।
মজার
ব্যাপার হলো যে সাধারণ মানুষ এই নিষ্পেষণ যন্ত্রের নীচে চাপা পড়ে
আছে, ছিল
যুগের পর যুগ, এরা
সব সময় এই ভয়ংকর অমানবিক যন্ত্রটাকে দেখতেই পায়নি। এখানে কবি এক ধরণের প্যাঁচে পড়ে
যান! তাকে শাসকের শত্রু হতে হয়, আবার সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবার তাড়না
থাকে। এই সূচক মাথায় নিয়েই আমি কবিতা লিখি। ফলে শাসক আমার কলম কেড়ে নিতে চায়, অথবা চায়
গারদে ভরতে। তবে যে কাজটা রাষ্ট্রের জন্য যুৎসই আর দীর্ঘস্থায়ী ফলদায়ক তা হলো
জনগণকে একটা নির্দিষ্ট ছাঁচের ভেতর নিয়ে আসা। এই কাজে সে
ধর্ম-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-ক্যান্টনমেন্টসহ বহু প্রতিষ্ঠানকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে
লাগাতে পারে। এর ফলে রাষ্ট্রকে আর সরাসরি কবির বিরুদ্ধে না দাঁড়ালেও চলে। ওই কাজটা জনগণই করে। কারণ 'জনগণ'কে রাষ্ট্র তার প্রয়োজনীয় ছাঁচে
ইতোমধ্যেই তৈরি করে নিতে পেরেছে। অথচ এই নিষ্পেষিত জনগণের প্রতি তীব্র মমত্ববোধ
থেকেই তো কবি কবিতা লিখছেন। কী মর্মান্তিক ব্যাপার! রাষ্ট্র তো
প্রতিপক্ষই। কিন্তু যে সাধারণ মানুষের জন্য আমি কবিতা লিখি তাদের হাত থেকে বাঁচতেই
আমাকে মুখোশ পরে নিতে হয়!
যা হোক আমি
যে ভালমানুষ না আমার কবিতাগুলোই তার সাক্ষী। ভালমানুষ হলে দেখতে সুস্থসবল
চাকচিক্যময় সমাজ-রাষ্ট্রের
ভেতর যে পুঁতি-দুর্গন্ধ তা কেন আমি দেখাতে যাব? আর কেন আমি ওদের তাড়া খাব? হুমায়ূন
আজাদ বা শামসুর রাহমানকে কেন আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করব? হ্যাঁ, জনগণ-এর প্রতি মমত্ববোধ বা দায়বদ্ধতা থেকেই নিষ্পেষণমূলক রাষ্ট্রব্যাবস্থার
বিপক্ষে আমাকে দাঁড়াতে হয়। আমি লিখি 'লোরকা' নামক কবিতা।
লোরকা
লোরকার বুক
সোজাসুজি প্রথমবার যখন বন্দুক তাক করা হলো
উনি হাসলেন
তারপর ওরা বন্দুক তাক করলো ওর মাথা বরাবর
উনি হাসলেন
আসলে
ওরা দ্বিধান্বিত ছিল যে গুলিটা ঠিক কোথায় করা উচিৎ
বুকে না মাথায়
মাথায় না বুকে
লোরকা ঈষৎ বিরক্ত হলেন
না
এত এত ঘামের বিনিময়ে যে বন্দুক কেনা হয়
এত এত ট্রেনিং
আজও
কেন এরা পারছে না নিজেদের নিশানা ঠিক করতে
এই কবিতা
লেখার পর রাষ্ট্র আমার প্রতি সন্দেহমূলক অথবা বিদ্বেষমূলক ধারণা পোষণ করবে এটাই
স্বাভাবিক। সে আমাকে প্রতিপক্ষ মনে করবে। সে বুঝে যায়, জনগণকে যে
নিরাপদ ছাঁচে সে তৈরি করে নিয়েছে সেই ছাঁচে আমি আঘাত করতে চাইছি, জনগণেরই
পক্ষ হয়ে। আমার উদ্দেশ্য ভয়ানক! এটা রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
এভাবেই কাতালান আর সারা পৃথিবীর মেহনতি মানুষের কন্ঠস্বর ফেদেরিকো গার্সিয়া
লোরকাকে রাষ্ট্রযন্ত্রের হিংস্র দানব মাটিতে পিষে দিয়েছিল। কিন্তু লোরকাকে তো মেরে
ফেলা যায় না।
উনি হাসলেন
তারপর ওরা বন্দুক তাক করলো ওর মাথা বরাবর
উনি হাসলেন
আসলে
ওরা দ্বিধান্বিত ছিল যে গুলিটা ঠিক কোথায় করা উচিৎ
বুকে না মাথায়
মাথায় না বুকে
লোরকা ঈষৎ বিরক্ত হলেন
না
এত এত ঘামের বিনিময়ে যে বন্দুক কেনা হয়
এত এত ট্রেনিং
আজও
কেন এরা পারছে না নিজেদের নিশানা ঠিক করতে
সমাপ্ত
লোরকা
ReplyDelete