বাতায়ন/মাসিক/ছোটগল্প/২য় বর্ষ/২৮তম সংখ্যা/২রা
ফাল্গুন, ১৪৩১
অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সংখ্যা | ছোটগল্প
সঙ্ঘমিত্রা দাস
মায়ার
আঁচল
সঙ্ঘমিত্রা দাস
"মীরা আর সুলেখাদেবী বিস্ময়ে হতবাক। না, মিথ্যার কোন জায়গা নেই। তাছাড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে ঘরের মধ্যে, বাচ্চার কাজে ভিন্নধর্মের লোক, কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।"
সেলিনা নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। ছ’মাসের আসমানকে কোলে তুলে একবার তাকাল পিছন ফিরে। সংসারটা আর করা হল না। ফিরতে হচ্ছে মায়ের কাছেই। একদিন মায়ের হাজার নিষেধ সত্ত্বেও আফজালকে বিয়ে করেছিল ভালবেসে। ভেবেছিল ওর ভালবাসায় সব খারাপ ধুয়ে মুছে যাবে। কিন্তু ওই লটারির এক বিষাক্ত নেশায় আজ সর্বশান্ত আফজাল।
টাকার প্রয়োজনে ঘরের জিনিসপত্র পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে। তবু ছেলের মুখের দিকে
তাকিয়ে মাটি কামড়ে পড়েছিল সেলিনা। যেদিন ঘরের একটা মাত্র ট্রাঙ্কও রদ্দির
দোকানে বেচে লটারি কাটল আর সহ্য হয়নি। এবার নিজের ব্যবস্হা নিজে করতে হবে। নইলে
বাচ্চাটাকে নিয়ে না খেতে পেয়ে মরবে যে। এ অবস্হায় মা ছাড়া আর কোথায় আশ্রয়
খুঁজবে। যদিও মায়েরই দিন চলে চেয়েচিন্তে কোনমতে, ওদের কীভাবে দেখবে। যাইহোক কোন একটা কাজ খুঁজে নেবে
সে। মায়ের আঁচলে আশ্রয় নিয়ে ঠিক তিনজনের জন্য কোন একটা ব্যবস্হা সে করে নেবে।
নিজে বাঁচবে, আর
ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ তৈরি করবে।
সেলিনাকে
দেখে মায়ের মন ভারী হলেও সে নাতিকে পেয়ে দারুণ খুশি। নুন-ভাত যা জোটে হাসিমুখে দিন চালিয়ে নেয় ওরা। সেলিনা একটা সেন্টারে নাম
লিখিয়েছে, আয়েসা
ওদের পাশেই থাকে সে-ই নিয়ে গেছে ওখানে। আয়েসা কোলকাতায় এক
বড়লোক বাবুর বাড়ি মোটা মাইনের চাকরি করে। এমন একটা কাজ পেলে সেলিনা খুব ভালভাবে
ছেলেকে মানুষ করতে পারত। কিন্তু বড্ড ছোট বাচ্চা যে, এখনও বুকের
দুধ খায়। কোলে নিলে কেমন বুকের কাছে আঁচলটা শক্ত করে ধরে থাকে। সাত-পাঁচ ভাবতে থাকে সেলিনা। ওর মা সব সামলে দেবার কথা বললেও আসমানের কথা ভেবে
চোখে জল এসে যায়।
সল্টলেকের
সিবি ব্লকে মীরা রক্ষিতের বাড়ি কাজ পায় সেলিনা। দিদিমণি বড় চাকরি করে, দাদাবাবু
বাইরে থাকেন। ওর কাজ দিদিমণির দুবছরের ছেলে রাজার দেখভাল করা। দিদিমণির মা
সুলেখাদেবীও থাকেন ওদের সাথেই। তিনি আর রাজা এই দুজনকে একটু দেখেশুনে
রাখাই সেলিনার দায়িত্ব। বারো হাজার টাকা মাইনে। কিন্তু গোল হলো সেলিনার পরিচয়
এখানে সবিতা। সেন্টারের দাদা সব ঠিক রেখে নামটা শুধু বদলে দিয়েছে। অন্য ধর্মে
ঘরের কাজ পাওয়া যে বড় মুশকিল। সেন্টার থেকে বারবার বলে দিয়েছে "ভুলেও নিজের পরিচয় দিও না। তোমার নাম সবিতা, বারাসাতে
থাকো, সব
কাগজপত্র সেভাবেই তৈরি করে দিয়েছি। তোমার খুব দরকার কাজের তাই এই ব্যবস্হা।
আমাদের নাম যেন খারাপ না হয়, কিছু হলে সব দোষ নিজের ঘাড়ে নেবে।" সেলিনা রাজি হয়ে যায়। কী এসে যায় ধর্মে।
একই দেশ, একই
রকম জীবন, একই
সময় সূর্য ওঠে, অস্ত
যায়। এক মন্ত্রী, এক
শোষণ, একই
গাড়িতে ধাক্কাধাক্কি করে যাতায়াত তবু কেন এত বিভেদ? সবিতা এখন
মন দিয়ে কাজ করে। রাজাকে নিজের ছেলের মতোই আগলে রাখে, সে ওর হাতে
ছাড়া খায় না, ও
না গল্প বললে ঘুমায় না। মাসিমার হাতে হাতে সাহায্য করে। মাঝে মাঝে আবার নিজের
ছেলের গল্প করে, আসমানের
নাম বদলে হয়েছে
আকাশ। এত
আদরে, যত্নে
হাসিমুখে সব কাজ করে মালিক বেশ খুশি তাই। সারাদিন রাজাকে নিয়ে আর সন্ধ্যার পর
আসমানকে বুকে জড়িয়ে কেটে যায় সেলিনার। ও ওর মায়ার আঁচলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে ওর দুই ছেলেকে। রাজাকে নিজের ছেলের মতোই ভালবাসে।
সেদিন ছিল
রবিবার। মীরা পুরোনো খবরের কাগজের বান্ডিল বিক্রি করছে দোকানির কাছে। রাজা ছুটে বেড়াচ্ছে সারা বারান্দাময়। ওকে নিতে বারান্দায় আসতেই
সবিতা মুখোমুখি কাগজ ক্রেতার সাথে। আব্বাস, ওর চাচাতো ভাই। কথায় কথায় সব সত্যি
বেরিয়ে পড়ল। ও যে সবিতা নয় সেলিনা।
মীরা আর
সুলেখাদেবী বিস্ময়ে হতবাক। না, মিথ্যার কোন
জায়গা নেই। তাছাড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে ঘরের মধ্যে, বাচ্চার
কাজে ভিন্নধর্মের লোক,
কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। "কতদিন ঠাকুরের ফুল এনে দিয়েছে, ঘরের সব
শুদ্ধ করতে হবে" সুলেখাদেবী চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। মীরা তড়িঘড়ি ওর সব
পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে ওকে বিদায় জানায়। কোন কান্নাকাটিতে কাজ
হয় না। রাজাও খুব কাঁদছে। এতকিছু দেখে ভয় পেয়েছে সে। সেলিনা বারবার বলতে থাকে
"আর কোনদিন মিথ্যা বলব না দিদি, রাজাকে ছাড়া কীভাবে থাকব?
একটি বার ক্ষমা করে দাও।" মীরা রাজাকে কোলে নিয়ে
ঘরে চলে যায়। সুলেখাদেবী সদর দরজা বন্ধ করে দেন।
কয়েক বছর
হয়ে গেছে, সেলিনা
এখন ঠিকে কাজ করে পাশের পাড়ায়। ওদিকে আর যায় না, রাজাকে সামনে দেখেও একটু ধরতে পারবে
না, আদর
করতে পারবে না, এটা
মানতে পারে না। একদিন হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে। চেনা নম্বর। হ্যাঁ মীরা
দিদিমণির ফোন। ধরবে না ভেবেও সবুজ বোতামে হাত চলে যায়। "হ্যালো!" দিদিমণি কাঁদছে। ওকে জিজ্ঞাসা করে, "তোমার বি
নেগেটিভ রক্ত তো, ওটা
কি সত্যি? কার্ডে
তো তেমনই লেখা ছিল। তোমার রাজা সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে অনেক রক্ত
বেরিয়ে গেছে। ওর বি নেগেটিভ, কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আমার ছেলেকে
বাঁচাও।"
সেলিনা সব
কাজ ফেলে হাসপাতালে ছোটে। রাজাবাবার রক্ত লাগবে, সে সব দিয়ে
দেবে। সুলেখাদেবী ওকে দেখেই হাত জোড় করে কাঁদতে শুরু করে। "আমার নাতিকে
বাঁচাও, বড়
ভুল করেছি, ক্ষমা
করে দে। ভগবান আমাকে শাস্তি দিয়েছেন। তুই ক্ষমা না করলে সব শেষ হয়ে যাবে।"
দু বোতল রক্ত দেয় সেলিনা। সন্ধ্যায় ডাক্তার জানান রাজা ভাল আছে, সময়ে রক্ত
পাওয়ায় এ যাত্রায় বেঁচে গেছে সে। খবরটা শুনে সেলিনা বাইরের পথে পা বাড়ায়
ধীরে। মীরা ওর হাত টেনে ধরে। "রাজার সাথে দেখা করবে না? তুমি তো ওর
আর এক মা। আজ তোমার জন্য ওর নবজন্ম হলো। আশীর্বাদ করবে না?" সেলিনা
কাঁদছে, ওকে
জোর করে কেবিনে নিয়ে গেল মীরা। রাজা ঠিক চিনেছে, হাত দুটো বাড়িয়ে দিচ্ছে ওর দিকে।
সেলিনা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। সুলেখাদেবী কাছে এসে
নিজের আঁচল দিয়ে সেলিনার চোখ মুছিয়ে দেন। "আমার ভুল ধারণায় আমি মা-ছেলেকে আলাদা করেছি, তার শাস্তি আমি পেয়েছি। তোর এই
বুড়ি মেয়েটাকে ক্ষমা কর। তুই আবার তোর বড় ছেলে আর এই বুড়ি মেয়েটার দায়িত্ব
নে। তোর ওই বিরাট আঁচলের ছায়ায় আমাদের আশ্রয় দে।" সেলিনা সুলেখাদেবীকে পরম
আবেগে জড়িয়ে ধরে।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment