বাতায়ন/রং/ছোটগল্প/২য় বর্ষ/৩২তম সংখ্যা/২৯শে
ফাল্গুন, ১৪৩১
রং
| ছোটগল্প
অর্পিতা
চক্রবর্তী
অন্তহীন
অপেক্ষা
"হ্যাঁ উনি বেঁচে আছেন কিন্তু আজ এই রং-দোলে মৃত্যু হয়েছে আমাদের সম্পর্কের, আমার বিশ্বাসের। শাঁখা, সিঁদুর এসব তো মেয়েরা স্বামীর মঙ্গলকামনা করে পরে কিন্তু আমি আর কখনও ওর মঙ্গলকামনা করব না। কারণ ও ভাল থাকলে যে বর্ষা পুনমের মতো মেয়েরা ভাল থাকতে পারবে না।"
ঘরের এক
কোনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট মেয়েটা তখনও ভয়ে কাঁপছে। একটু আগেই ওর
পিসেমশাই ওকে খুব বিশ্রীভাবে রং দিয়ে গেছে। উনি ওর শরীরের এমন এমন জায়গায় রং
দিয়েছেন যা আগে কেউ দেয়নি। মেয়েটা বাধা দেওয়ার সাধ্যমতো
চেষ্টা করেছে কিন্তু ওই মানুষটার গায়ে যেন অসুরের শক্তি।
বর্ষার বয়স এখন মাত্র দশ, শৈশবের শেষ পর্বে পা রেখেছে। দেখতেও ভারি মিষ্টি। শহরতলিতে বাস ওদের। দোলের ছুটিতে এসেছে পিসির বাড়িতে। পিসেমশাই মানুষটিকে একদম
ভাল লাগছে না বর্ষার। যদিও এরা কেউ ওর নিজের আত্মীয় নয়। বাবার বিশেষ পরিচিত। ছোট
মেয়েটা ওর সব কথা নিজের মাকে বলে, আজ যা হলো তা তো মাকে
বলতেই হবে কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে কোথায় বেচারি। যতবার বলতে যাচ্ছে কেউ না কেউ এসে
পড়ছে। তারমধ্যে আজ এ বাড়িতে আবার মহাভোজ। অনেক রান্না হচ্ছে। মা কখনও রং খেলা
নিয়ে ব্যস্ত তো কখনও রান্না নিয়ে।
বর্ষা মনে
মনে একটু অসন্তুষ্ট ওর মায়ের উপর। আচ্ছা ওর যে কিছু ভাল লাগছে না, ওর যে কিছু
বলার আছে সেটা মা কেন বুঝতে পারছে না। বর্ষার মা এত
আনন্দের মাঝেও মেয়ের মলিন মুখখানি দেখেছে কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। এখানে
আসার জন্য মেয়েটা খুব আগ্ৰহী ছিল। কত সাজার জিনিস এনেছে কিন্তু একটুও সাজছে না, হাসছে না।
শুধু মুখটা কাচুমাচু করে ঘরের এক কোণে বসে আছে আর বাড়ি
চলে যেতে চাইছে। কিছু তো একটা হয়েছে মেয়েটার কিন্তু কী
হয়েছে জানতেই হবে বর্ষার মাকে।
দুপুরে সবাই
হইহই করে মাংস ভাত খেল। শুধু বর্ষা ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।
ওর চোখের কোণটা কেমন ভেজা ভেজা। মাঝে মাঝে নাক টানছে
মেয়েটা। আর সুধীরদা কেমন করে যেন দেখছে ছোট্ট বর্ষাকে। আচ্ছা আজ এই রং-দোলে কিছু কি এমন হয়েছে যা হওয়া উচিত ছিল না। আজকের এই পুরো ঘটনাটা আরও
একজনকে খুব বিঁধেছে আর সে হল পুনম। সুধীরদার দাদার বৌমা। ওর দৃষ্টিটাও কেমন যেন
লাগছে। খাওয়াদাওয়া শেষে বর্ষা ওর বাবা-মায়ের সাথে ফিরে
যাবে বলে ব্যাগটা গোছাচ্ছিল। হঠাৎ পিসেমশাই ঘরে ঢুকল আর বলল,
‘তাহলে তোমরা চলে যাবে সোনা আর থাকবে না, কেন এই
পিসোনকে বুঝি ভাল লাগেনি? পিসোন তোমায় কত আদর করে রং মাখালো,
তোমার বুঝি ভাল লাগেনি? আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোমাকে আরও সুন্দর করে রং মাখাব। এই দেখো আমি তোমার জন্য লাল আবির নিয়ে এসেছি।’ বর্ষা চিৎকার করতে গেলে সুধীরদা ওর মুখ চেপে ধরল। আর পকেট থেকে লাল
আবিরের প্যাকেটটা বের করল। ঠিক সেই মুহূর্তেই ওই ঘরের বাথরুম থেকে বেরোল বর্ষার মা আর পুনম। ছোট মেয়েটা ততক্ষণে ভয়ে কাঁপছে আর চিৎকার করে কাঁদছে। ওর চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই তখন ওই ঘরে উপস্থিত। বর্ষার মা ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে আর পুনম চিৎকার করে বলছে, ‘এই লোকটা আজ সকাল থেকে ওই
ছোট্ট মেয়েটাকে রং দেওয়ার নাম করে অসভ্যতা করে যাচ্ছে। আমি
সবটুকু নিজে চোখে দেখেছি। এরপর জামাকাপড় ছাড়তে আমি যখন এই ঘরে আসি উনি তখন দরজার
ফাঁকা দিয়ে উঁকি দিচ্ছিলেন। আমি নিজে চোখে সব দেখেছি।’
বর্ষার বাবা
তো সব শুনে রেগে অগ্নিমূর্তি। সুধীরদাকে এই মারে কী সেই মারে। এমতাবস্থায় পুনম সুধীরদাকে বলল, ‘আপনি
সম্পর্কে আমার আত্মীয় হন কিন্তু আপনাকে ওই সম্বোধন করতে আমার
ঘেন্না করছে। আপনাকে আমি সকালেই ধরে ফেলেছিলাম। শুধু ওই সময়
আপনার একটা ফোন এসে যায় আর আপনি এই ছোট মেয়েটাকে ছেড়ে পালিয়ে যান। আমি সেই থেকে
আপনাকে ফলো করছি। বর্ষার মাকে আমি সবটুকু জানিয়েছিলাম। আমি জানতাম আপনি এত সহজে
এই ছোট্ট মেয়েটাকে ছাড়বেন না। তাই আমরা পরিকল্পনামাফিক এই ঘর সংলগ্ন বাথরুমে
ছিলাম যাতে আপনাকে হাতেনাতে ধরতে পারি। আর আজ আপনি পুরোপুরি ধরা পড়ে গেছেন। বলুন কী বলবেন,
কী বলার আছে আপনার?’
সুধীরদা
ন্যাকামো কান্না সবে শুরু করতে যাচ্ছিল হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াল ওনার স্ত্রী
সুধাময়ীদেবী। উনি বললেন,
‘ছি ছি, আজ
তোমাকে স্বামী পরিচয় দিতে ঘেন্না করছে আমার। তোমার তিন সন্তানের মা আমি। আজ তোমার
ছেলেমেয়েরা বাড়িতে কেউ নেই। থাকলে কী হতো বলো তো। এই
ছোট্ট মেয়েটা তো তোমার নাতনির বয়সি। তোমার ওর গায়ে হাত দিতে একটু বাধল না। আমি
তোমার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। এমনকি বাড়ির কাজের মেয়েরা অবধি তোমার সম্পর্কে
নালিশ করেছে আমায়। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি মানতে পারিনি। আমি তোমাকে অন্ধের মতো
বিশ্বাস করেছি। আর আজ তুমি আমার বিশ্বাসের এই দাম দিলে? সত্যি আমি
ভাবতে পারছি না। তবে আজ আমার হাত থেকে তোমার মুক্তি নেই। আমি তোমাকে শাস্তি দেব।
নিজে হাতে শাস্তি দেব। ইচ্ছা তো করছে তোমাকে মারতে মারতে বাড়ি থেকে বের করে দিই কিন্তু তোমার মতো পিশাচের গায়ে হাত দিতে আমার ঘেন্না করছে।’ বর্ষার মা বলল, ‘এই শুভকাজটা না হয় আমি করি দিদি। উনি আমার মেয়ের সর্বনাশ
করতে গিয়েছিল। আমি তো ওনাকে ছাড়ব না। সুধীরদা আপনাকে আমি দাদা সম্বোধন করেছিলাম
কিন্তু আপনি কোন সম্পর্কের মান রাখার যোগ্য নন।
সুতরাং আপনাকে যেখানে মানায় আপনি এবার সেখানে যাবেন।’ পুনম ইতিমধ্যে পুলিশকে খবর দিয়ে দিয়েছিল। পুলিশ এসে সুধীরদাকে নিয়ে
যাচ্ছে আর ওদিকে সুধাদি কান্নায় ভেঙে পড়েছে। দিদি বারবার
ক্ষমা চাইছেন সকলের কাছে ওনার স্বামীর হয়ে। ছেলেমেয়েরাও ইতিমধ্যে
খবর পেয়ে গেছে
বাবার গুণকীর্তনের কথা।
বর্ষা ওর মা-বাবার সাথে বাড়ি চলে যাচ্ছে। পুনমও বাড়ি চলে যাবে কিন্তু হঠাৎ সুধাদি
গেল কোথায়? ওনাকে
তো কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটু পরেই ওই ছোট ঘরের দরজা খুলে
বেরিয়ে আসল সুধাময়ীদেবী। পরনে সাদা কাপড়, হাতের শাঁখা-পলা সব খোলা, সিঁদুর মুছে ফেলেছে। পুনম হঠাৎ বলে উঠল, ‘কাকিমা
তোমার কী হয়েছে। তুমি এমন কেন করলে! তোমার স্বামী তো এখনও বেঁচে আছে।’
সুধাদি বলল, ‘হ্যাঁ উনি
বেঁচে আছেন কিন্তু আজ এই রং-দোলে মৃত্যু হয়েছে আমাদের সম্পর্কের, আমার
বিশ্বাসের। শাঁখা, সিঁদুর
এসব তো মেয়েরা স্বামীর মঙ্গলকামনা করে পরে কিন্তু আমি আর কখনও ওর মঙ্গলকামনা করব
না। কারণ ও ভাল থাকলে যে বর্ষা পুনমের মতো মেয়েরা ভাল থাকতে পারবে
না। তাই আমি চাই ও মরুক, যদি পুনর্জন্ম বলে কিছু থাকে তবে যেন
ঈশ্বর ওকে মানুষের মতো মানুষ করে। আমি না হয় অপেক্ষা করব।’
এই ঘটনার পর
সুধাদি ওই বাড়ি ছেড়ে ওনার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। ওনার ছেলেমেয়ে
পরিবার কেউ আর খোঁজ করেনি সুধীরদার। তবে সুধাদি অপেক্ষা করে, আজও অপেক্ষা
করে কোন এক নতুন প্রভাতের,
কোন এক নতুন রং-দোলের।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment