প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

রং | প্রতিজ্ঞা

  বাতায়ন/ রং /সম্পাদকীয়/২য় বর্ষ/ ৩ ২তম সংখ্যা/ ২৯শে ফাল্গুন ,   ১৪৩১ রং | সম্পাদকীয়   প্রতিজ্ঞা "নির্ভীক একটি ফুলের মতো মেয়েকে চরম লাল...

Friday, March 14, 2025

মনখারাপের বৃষ্টিনীল মলাটের উপর একটা রঙিন প্রজাপতি | দীপক বেরা

বাতায়ন/রং/গদ্য/২য় বর্ষ/৩২তম সংখ্যা/২৯শে ফাল্গুন, ১৪৩১
রং | গদ্য
দীপক বেরা
 
মনখারাপের বৃষ্টিনীল মলাটের উপর একটা রঙিন প্রজাপতি


"শাড়িতে শাড়িতে আকাশ চমকায়। মনখারাপের এই দেশে মেঘে মেঘে ভাসে চুপড়ি-সিঁদুর। আমার ঘরে শনিমরচে ধরা লোহা আর মৃদু বজ্রপাত! গোপনীয়তার যাবতীয় রং আমার আত্মগোপনের পাতায় সঙ্গম-শূন্য বৃষ্টিনীল মলাটে ঢাকা।"
 
রং-টা কিছুতেই যখন মেলাতে পারছি না, তখন তাকে দিয়েছিলাম পলাশের অশ্রু ও ঐশ্বর্য। অথচ রং-মিলান্তির খেলায়— রং তো কোথাও না কোথাও মিলেই যায়। প্রশ্ন করি, কোন অভিসারে তোমার রং-মিলান্তি হল? আসলে, ওটা যে এক কিশোরের থেকে চুরি করা। হায়, বর্ণিল নারী! তুমি বেশ সফল এবং নিরাপদ দূরত্বে থাকো।
 
এমনই একটা মনখারাপ নিয়ে সেদিন এক কিশোরের মেঘলা আকাশ-চোখে বৃষ্টি নেমেছিল। তড়িঘড়ি বেরিয়ে এসেছিল অজস্র ছাতা। তাই দেখে কুমারী শাড়িরা সামান্য পাড় ভিজিয়ে জল আরও ঘোলা করে দিয়ে চলে গেল। জানি, এ শহরে জলের কোনো দাম নেই, কদর নেই। অথচ ওরা জানে না, জলস্ফীতিরও কোনো দয়া নেই, দায় নেই। সে-ও ভাসাতে জানে প্রেমে ও বন্যায়। কিন্তু তাতে কী? সমুদ্রের পর সমুদ্র পেরিয়ে সূর্যের কাছে গিয়ে এইসব প্রার্থনা নিয়ে বৃথাই দাঁড়ানো শুধু। পৃথিবীর পথে-প্রান্তরে কত যে ব্যর্থতার খনিজ পড়ে আছে অনাদরে, কে তার খবর রাখে? ওরা সব বাতাসের মতো অদৃশ্য, বিলীন হয়ে আছে যে যার মতো করে
 
পড়ার ঘরে ভাঙা ফুলদানি, স্তূপাকার ছেঁড়া চিঠি। আকাশে ওড়ে তার জামরঙা ছায়া। ওই ছায়া যে আমার রূপছায়া, সে যে সুলেখাদির বোনের খিল-খোলা অবিন্যস্ত একঢাল ঘন কালো চুলের স্বপ্নীল বিন্যাস। অনন্তের সে কী অপরূপ শোভা — অথচ নীল বেদনার ঘন ডার্করুম। শোনা যায়, কোনো এক রং এসে নিয়ে গেছে তাকে, যে রং তরুণ এবং স্বাবলম্বী
 
শাড়িতে শাড়িতে আকাশ চমকায়। মনখারাপের এই দেশে মেঘে মেঘে ভাসে চুপড়ি-সিঁদুর। আমার ঘরে শনি, মরচে ধরা লোহা আর মৃদু বজ্রপাত! গোপনীয়তার যাবতীয় রং আমার আত্মগোপনের পাতায় সঙ্গম-শূন্য বৃষ্টিনীল মলাটে ঢাকা।
 
হাইস্কুল গেট থেকে যতদূর দৃষ্টি যায়— একটা আটপৌরে লালপাড় শাড়ি, অঝোর বৃষ্টিতে আদ্যোপান্ত ভিজে ভিজে আবছায়ায় অস্পষ্ট হতে হতে ক্রমশ অদৃশ্য, বিলীন হয়ে যায়...! আবর্ণশোভিত সেই রং কখন যেন ফিকে হতে হতে স্বচ্ছ জলের মতোই সহজ এক নিরালম্ব সত্তায় প্রকাশিত। 
 
প্রথম প্রেমের বিন্দুসাধনের কোনো এক ক্ষণে কৌণিক আলোর পর্যবেক্ষণ থেকে একটা স্ফুলিঙ্গ ছিটকে এসে পড়েছিল। তখন আমি ছিলাম তার বর্ণিল রূপের অবাক দর্শক। এমনই আলোছায়ার জটিল পথে আমার প্রেম এসেছিল, সাথে করে নিয়ে এসেছিল স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। এই শহরের রাস্তার দু'ধারের হাইরাইজ টাওয়ারগুলো হঠাৎ ভীষণ নড়ে ওঠে, দুলে যায় টলোমলো। মনে হয় বিজ্ঞাপনের সলিড টিএমটি বার আসলে ভেতরে ভেতরে ভীষণ নড়বড়ে। ফেসবুকের নোটিফিকেশনে ননস্টপ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, ঘটে যাচ্ছে আইডি ছাড়াই যত মেলবন্ধন। শহরের শত শত বুকের খাঁজ পেরিয়ে আজ প্রেমের নাভিশ্বাস। হৃদয়ের উপত্যকার গভীরে প্রাগৈতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ। উঁচু-নিচু দেওয়াল, পোস্টার... এভাবেই— বাঁজা সন্মোহনের হাতছানি। 
 
তবু চরাচর জুড়ে শুয়ে থাকে সৃষ্টির মাটি-জল-সার... 
 
সমস্ত অস্থিরতার ভেতরে মনের মধ্যে চলে এক গভীর ষড়যন্ত্র। আবার নতুনের মহড়া, নিঃশব্দে চলে অরূপের খোঁজ। রোয়ানো শেকড় থেকে ডাক আসে। এভাবেই প্রতিটি বসন্তে আমাদের কলোনির পলাশ গাছটাতে আবার আশ্চর্য পলাশ ফোটে তার উদ্ধত ঐশ্বর্যের মহিমা নিয়ে। এমন দিনে আলো-অন্ধকারের অনুভূতিমালায় আমার গোধূলি-উঠোনে একটা রঙিন প্রজাপতি ওড়ে। মনে হয়, হয়তো ওটাই বর্ণালীর শেষ রংয়ের হাতছানি— হারানো যাবে না কিছুতেই। প্রথম মুহূর্তটি তো এভাবেই রচিত হয়েছিল। মুহূর্ত থেকে মুহূর্ততরের সংকেতে কোনো কোনো দৃশ্যভাষা এমনভাবে উদ্ভাসিত, যেন আমার মতো হলুদ পাতার একাকিত্বের কাছে আবার নতুনভাবে পাঠ নিতে আসে। সেই পাঠ যত দীর্ঘ, যত নিবিড়, এক একরকমের অদৃশ্যতা তত দৃশ্যমান হয়ে ধরা দিতে থাকে। দেখতে দেখতে মনে হয় ভাসমান অনেকগুলো মুখের আদল—
 
শুধু আমাদের মুহ্যমান কলোনির লজ্জাবতী লতাগুলো প্রথম হাতছানির হলকায় মুখ তুলে তাকাতে পারেনি বলে, পাড়ার যত লতা, বকুলরা বৌদি কিংবা কাকিমা হয়ে উঠতে পারল না।
 
আমার ভেতরও ছিল অদৃশ্যের দৃশ্যতা খুঁজতে গিয়ে একটু নির্মাণের অভাব। নৈঃশব্দ্যের ভেতর জেগে ওঠা, ভেতরের আলোড়ন যে অনুভব করতে পারে, তার কাছে এটাই বড় উদ্ধার। যা হারিয়ে গেছে, তার জন্য বিলাপ নয়। সভ্যতা যখন মৃত খোলসের ভারে ক্লিশে হয়ে ওঠে, তখন পুরনো খোলস ছাড়াতে হয়। এভাবেই খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে এক একটা বিবর্তন আমাদের আসে প্রতিটি কালোত্তীর্ণ পরিসরকে ব্যাপ্ত করার জন্য। সব হারিয়ে বিবর্ণতার ভেতর এই উদ্ধারটুকু ছাড়া জীবনকে নতুন কিছু দিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। যত দূরত্ব, যত আড়াল তত রহস্যময়, ততই তার রূপের মায়া। বসন্তের এই মাতাল বাতাসে এই নিসর্গের বহুমাত্রিক ফাঁকফোকর দিয়ে মৌরিফুলে যে রোদ আসে তার মুগ্ধতা থেকে রঙিন প্রজাপতিটা খুঁটে নেয় মিশ্রকলাবৃত্ত। গোধূলির ডানা-ঝাপটানো রোদে নতুন করে অভ্যাস গড়েপিটে নিয়ে, নিরন্তর অভ্যাস ও নতুনের প্রত্যাশায় অপরূপ প্রেমের সেই মহামিলনের সংঘটিত মুহূর্ত দিয়ে তার কাছে পৌঁছোবো, যেখানে অধিষ্ঠিত রমণীয় অদৃশ্যের দৃশ্যতা, আর পরম অব্যক্তের ব্যক্ততা। তখন কবেকার অবিন্যস্ত একঢাল ঘনকালো চুল সিঁথি হয়ে রাস্তা দেখায় সেই পরম উদ্ধারের

জীবন জিজ্ঞাসা থেকেই আসে সেই অনিবার্য আর্তি, যেখানে গভীরে গিয়ে সম্পূর্ণ অন্য অনুভূতিতে জারিত হয় এক ভিন্ন রসায়ন। সৃজিত হয় এক আশ্চর্য পারিজাত কল্পতরু — যতই ঝাঁকি দিই এক  অনন্ত প্রেমের স্মৃতি ঝরে পড়ে তার তলায়, ভেসে যাই এক অদ্ভুত চেতনাপ্রবাহে জীবনের আশ্চর্য ভ্রমণে...
 
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)