বাতায়ন/রং/ছোটগল্প/২য় বর্ষ/৩২তম সংখ্যা/২৯শে
ফাল্গুন, ১৪৩১
রং
| ছোটগল্প
সঙ্ঘমিত্রা
দাস
ভালবাসার
ফাগুন
"এবার দোলের ছুটি দুদিন। পরের দিন আবার রবিবার। আরো দুদিনের ছুটি অ্যাপ্লাই করে সাথী কার্শিয়ং যাবার জন্য টিকিট কাটল। এই প্রথম সুবীর ওর কাছে নেই। কোলকাতা যেন গিলতে আসছে ওকে। ট্রেনের টিকিট, হোটেল বুকিং সব সেরে মাকে জানাল।"
সুবীরের উপর
রাগ করে তিন মাস মায়ের কাছে এসে আছে সাথী। প্রথম দিকে মনে হতো সুবীর নিশ্চয়ই
থাকতে না পেরে নিতে আসবে। আগে কয়েকবার হয়েছে এমন। সাথী রাগ করেছে আর ও রাগ
ভাঙাতে কত কিছুই না করেছে। কিন্তু এবার ব্যাপার অন্যরকম। আট বছরের প্রেমের পর
বিয়ের ডিসিশন যেদিন নিয়েছিল সুবীর ওকে আগলে রাখার অঙ্গীকার করেছিল হাতে হাত
রেখে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে সম্পর্কে এসেছে নানা টানাপোড়েন। একসাথে ঘর করা আর
প্রেম করা যে এক নয় সেটা ওরা প্রতি মুহূর্তে টের পেয়েছে। সুবীর বাড়িতে ভীষণ
গোছানো এবং সংযত ব্যবহারে থাকে, অথচ সাথী হইচই করে মাতিয়ে রাখতেই অভ্যস্ত। শাশুড়ি মাও চাকরি করা, বাইরে বের হওয়া বিশেষ পছন্দ করেন না। একপ্রকার ছেলের
পছন্দের কাছে বাধ্য হয়েই মাথা নুইয়েছেন। তাছাড়া ছোট বোনের বিয়ের আগে দাদা
বিয়ে করে ঘরে বউ আনুক এমনটা ওর শাশুড়ি মা বা ননদ কেউ চায়নি।
হাবেভাবে সেটা তারা বুঝিয়েও দিত বারবার। ননদের চিন্তা ছিল দাদা হয়তো সাথীর কথায়
ওর বিয়েতে ঠিকঠাক খরচাপাতিও করবে না। এসব ভাবনাগুলো সাথীকে কষ্ট দিত।
সাথী মা-বাবার একমাত্র সন্তান। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনায় খুব মেধাবী।
ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে মাত্র বাইশ বছর বয়স থেকে চাকরি করছে ও। কোনদিন বকাও খেতে
হয়নি বাবা-মায়ের কাছে। বড় আদুরে ছিল সে। সুবীরের সাথে একই
কলেজে পড়ত। প্রথমবর্ষ থেকেই ওদের প্রেম। ওকে একেবারে মাথায় করে রাখত সুবীর।
আনন্দে আবদারে ভরিয়ে রেখেছিল কলেজ জীবনটা। ফলে কোন জটিলতা
ওকে কোনদিন স্পর্শ করেনি। তাই বিয়ের পর প্রথমদিকে বুঝতেও পারত
না অনেক কটুক্তি, অনেক
ইশারা। যখন বুঝত খুব কষ্ট পেত আর সব রাগ গিয়ে পড়ত সুবীরের ওপর। তার থেকে শুরু
দুজনের মধ্যে অশান্তি,
বিবাদ।
এর মধ্যে
ওদের ছেলে হয়েছে। সাথী মায়ের কথা শুনে অনেকটা অ্যাডজাস্ট করতে শিখেছে। ছেলে
ধ্রুবর মুখ চেয়ে চুপ থেকেছে কিছু সময় কিন্তু প্রতিদিন অফিসফেরত বাড়ি ফিরে মনটা
হালকা হবার বদলে খারাপ হয়ে থাকাটা বড় যন্ত্রণা দিচ্ছিল ওকে। অফিসের চাপও বাড়ছে
যত দিন যাচ্ছে। সুবীরও এখন অফিস থেকে দেরি করে ফেরে। ওরও তো চাপ কম না, তাছাড়া
বাড়ির সমস্যাটা এড়াতেও চায়। কিন্তু ছুটির দিনগুলোতে একসাথে একটু আনন্দ, ভাল থাকার
চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে ওরা। সমস্যা বেড়েছে দিনের পর দিন। সেদিন ঝগড়াঝাঁটির মাঝে সুবীর যখন রাগের মাথায় হাতটা উঁচু করেছিল, ভয়ে
বাচ্চাটা সাথীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল, সাথী আর ফিরে তাকায়নি। এক বস্ত্রে
ছেলেকে কোলে নিয়ে অফিস ব্যাগটা কাঁধে বাড়ি ছেড়েছিল। তারপর তিনটে মাস, ওর ভরসা ছিল
সুবীর ঠিক ওকে বুঝবে কিন্তু এর মধ্যে ও একবারও আসেনি। ফোনে কয়েকবার কথা হয়েছে
বটে তবে তার মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়েছে বেশি। সাথী অভিমান করে থেকে গেছে বাবা-মায়ের কাছে। আর সুবীর জেদ ধরে নিজের বাড়িতে।
কদিন পরেই
দোল। এই এতগুলো বছরে একবারও এমন হয়নি সুবীর ওই দিনটা মিস করেছে। লাল, গোলাপি, কমলা কত
রঙের আবির নিয়ে ঠিক হাজির হতো ওর সামনে। এ বছরটা কেমন সব আলাদা। ওরা স্বপ্নেও
কোনদিন চিন্তা করেনি ওদের একসাথে এক ছাদের তলায় থাকাটা এত দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
রাতে শুয়ে কত কথা মনে পড়ে বালিশ ভিজে যায় চোখের জলে। সকালে উঠে নিজেকে আবার
শক্ত করে অফিস রওনা দেয়। ছেলেটাও আজকাল খুব বাবা বাবা করে। সুবীরের খুব ন্যাওটা
ছিল ধ্রুব। বাবার কাছে যাবার বায়না করলে ওর দিদা গল্প বলে, ওর সাথে
খেলে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে কিন্তু রাতে মায়ের কাছে শুয়ে আবার বাবার সাথে
ফোনে কথা বলার বায়না ধরে। কতদিন রাতে সাথী নিজেও ফোন করতে চেয়েছে। কিন্তু ফোনটা
নিয়েও আবার রেখে দিয়েছে। আজকাল কথা বলতে গেলেই কেমন যেন ঝগড়া বেধে যায়। যতই
ভাবে ঝামেলায় যাবে না তবুও তিক্ততা নিয়েই ফোন রাখতে হয়। তাই আর ফোন করে ওঠা হয়
না। কখনো ফোন করলেও দু-এক কথায় দুজনই ফোন রেখে দেয়। অথচ কলেজ লাইফে সবাই বলত ওরা নাকি আইডিয়াল কাপল। মনে
পড়ে না সেসময় ওদের মধ্যে কোনদিন কোন ঝগড়া হয়েছে।
এবার দোলের
ছুটি দুদিন। পরের দিন আবার রবিবার। আরো দুদিনের ছুটি
অ্যাপ্লাই করে সাথী কার্শিয়ং যাবার জন্য টিকিট কাটল। এই প্রথম সুবীর ওর কাছে নেই।
কোলকাতা যেন গিলতে আসছে ওকে। ট্রেনের টিকিট, হোটেল বুকিং সব সেরে মাকে জানাল। ওর
মাও মেয়ের কথায় সায় দিলেন। বুঝতে পারছেন কষ্ট পাচ্ছে মেয়ে, ভাঙবে তবু
মচকাবে না। ওদিকে যে ছেলে কোনদিন জেদ করে না, এবার সেও গোঁ ধরে বসে আছে।
রাতে
ধ্রুবকে খাওয়াতে বসে সাথী ছেলেকে বলে,
-চল এবার দোলে আমরা পাহাড়ে দোল খেলব। কত রকমের ফুল, আকাশে
রামধনু দেখব। যাবি?
ছেলে তো
খুশিতে এক লাফে চেয়ার থেকে নেমে যায় কিন্তু পর মুহূর্তেই
প্রশ্ন,
-বাবা যাবে না? বাবাকে একবার ফোন করো-না মা, বাবা ঠিক
যাবে।
সাথী ঠাস
করে একটা চড় বসিয়ে দেয় ছেলের গালে। ধ্রুব কাঁদতে কাঁদতে দিদার কাছে চলে যায়।
ওকে অনেক বুঝিয়ে খাইয়েদাইয়ে ঘরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যান সাথীর মা। রাতে
ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হয় ওর। আজকাল ঘুমও আসতে চায় না।
কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েও লাভ হচ্ছে না। সুবীরের কোলে মাথা রেখে
খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। ভাবে সুবীর কী করে ওকে ছেড়ে আছে? কী মনে করে
ফোনটা হাতে নেয়। বার দুই-তিন রিং করতে গিয়েও হাতটা আটকে যায়।
বাচ্চাটা আজ এত কাঁদছিল বাবার জন্য। নানা ভাবনায় আবার একবার ডায়ালে হাত। "ডায়াল করা
নম্বরটি বর্তমানে ব্যস্ত আছে"
-এত রাতে কার সাথে কথা বলছে?
ফোনটা রিং
হয়ে হয়ে কেটে যায়। আবার একবার চেষ্টা করে কিন্তু এখনও ব্যস্ত বলছে।
ফোনটা রেখে
দেয় সাথী। টের পায় গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছে নাইটিতে। না আর ফোন
করবে না। মিসকল দেখে যদি রিং-ব্যাক করে তাহলে জানাবে নাহলে থাক
ও নিজের ব্যস্ততা নিয়ে। সারারাত বিছানায় ছটপট করে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে ও।
সকালে একবার চেক করে ফোনটা, না সুবীর আর রিং-ব্যাক করেনি।
বৃহষ্পতিবার
রাতের দার্জিলিং মেইলে মা-ছেলে চলল কার্শিয়াং। কয়েকবার বাবার কথা
বললেও ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে ধ্রুবর সে কী আনন্দ। দিদার
বানানো লুচি,
আলুরদম, সন্দেশ
খেয়ে রাতের অন্ধকারে জানলার কাচে নাক ঠেকিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টায় মশগুল।
বাইরে আলোগুলো কী তাড়াতাড়ি দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে খুশিতে মায়ের কোলের ওপর লুটিয়ে পড়ছে। সাথীও একটু খেয়ে
নিয়ে মোবাইলে গান চালিয়ে কানে এয়ারফোনটা গুঁজে দিল। ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই ট্রেনের
বাইরে আবছা পাহাড়ের হাতছানি। মনটা একমুহূর্তের জন্য আলোড়িত
হয়ে উঠল ওর। সুবীর পাহাড় খুব ভালবাসে। ওর কাছে ট্রেকিংয়ের
গল্প শুনতে শুনতেই তো সাথীও একসময় পাহাড়কে ভালবেসে ফেলেছিল। চটেরহাট স্টেশন ক্রস
করতেই পরিষ্কার আকাশে দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দিল। সাথী ধ্রুবকে ঘুম থেকে তুলে
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখাল। সাদা বরফের ওপর সোনালি আলোর ছটায় অপূর্ব
সে দৃশ্য দেখল দুজনে। সবকিছু ছাড়িয়ে ট্রেন এগিয়ে চলল। আড়াল হলো কাঞ্চনজঙ্ঘা।
ট্রেন নিউ
জলপাইগুড়ি স্টেশনে ঢুকল প্রায় সাড়ে দশটায়। গাড়ি আগেই বুক করা ছিল। স্টেশন
থেকে বেরিয়ে ওরা রওনা দিল। সুন্দর পাহাড়, নানা রঙের ফুল পথের দুপাশে। গাড়ি
ধীরে ধীরে মেঘ সরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। হালকা হাওয়ায় ঠান্ডা আমেজ। দুচোখ ভরে
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছিল সাথী। মনে হল পাহাড়ে আসার সিদ্ধান্ত একদম
সঠিক নিয়েছে ও। ধ্রুব গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হোটেলের গেটে গাড়ি পৌঁছতেই সাথী
ওকে ডেকে দিল। হোটেলের একটি ছেলে এগিয়ে এসে হাসিমুখে সুটকেস নিয়ে ভিতরে চলে গেল।
পাহাড়ের একদম ঢালে সকালের সূর্য ওঠা দেখা যাবে এমন একটা ঘর বুক করেই এসেছে।
গাড়ির টাকা মিটিয়ে নামল ওরা। দু পা এগোতেই থমকে দাঁড়ায় সাথী। ধ্রুব খুশিতে
মায়ের হাত ছাড়িয়ে, ‘বাবা, বাবা’ ডাকে ছুটতে থাকে সামনের দিকে হাঁটুর কাছটা জড়িয়ে ধরে বলে,
-আমি জানতাম
তুমি আসবে। দিদা বলেছিল এখানে এলেই তোমার সাথে দেখা হবে।
সাথী থমকে
দাঁড়িয়ে থাকে। সুবীরের হাতে একটা রেকাবিতে গোলাপি আবির। ও এগিয়ে আসে সাথীর দিকে। হাতে আবির
নিয়ে ওর গালে লাগিয়ে দেয়,
-হ্যাপি হোলি, পাগলি। আমাকে
ছেড়ে পাহাড় দেখতে চলে এলে?
সাথীর বরফের
মতো জমে থাকা অভিমান গলে জল হয়ে যেতে থাকে। ওর কাছে এখন
সবটা পরিষ্কার। রাতে ফোনে ওর মায়ের সাথে কথা হতো সুবীরের। ওখান থেকেই সব খবর
পেয়েছে। ফোনটা তাই এনগেজ পেয়েছিল সেদিন। এসবই ওদের প্ল্যান। সাথীর
দুচোখে তখন জলের ধারা।
রেকাবি থেকে রং নিয়ে সুবীরের সারা মুখ রঙে ভরিয়ে দেয়।
জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে ও।
-আমি আবার
নতুন করে তোমার প্রেমে পড়লাম সুবীর। ভালবাসার পরীক্ষায় প্রতিবার আমায় তুমি
হারিয়ে দাও।
সুবীর
ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। আর অন্য হাতে সাথীকে জড়িয়ে ধরে।
এবারেও
সুবীর সাথী একসাথে দোল খেলল। প্রাণভরে রং মাখল ওরা। আর
কাঞ্চনজঙ্ঘা সাক্ষী থাকল ওদের অমর প্রেমের।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment