বাতায়ন/ঝড়/ধারাবাহিক উপন্যাস/৩য় বর্ষ/১ম সংখ্যা/১লা বৈশাখ, ১৪৩২
ঝড়
| ধারাবাহিক উপন্যাস
পারমিতা
চ্যাটার্জি
শেষ
থেকে শুরু
[পর্ব— ২২]
"আমার তো বাবা-মাও নেই নিজের কোন ভাইবোনও নেই, আছ শুধু তুমি, আমার নিজের চেয়েও তোমাকে ভালোবাসি গো, কেন তুমি ভুল ভাববে? এই ভুল ভাবাটা তোমার ছেলেমানুষি। রাহুল প্রাণপণে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে গভীর চুম্বন এঁকে দিল সুচরিতার ঠোঁটে।"
পূর্বানুবৃত্তি মনকলি সুচরিতাকে
বিয়ের আসরে নিয়ে এলো, তার সৌন্দর্যে সকলেই প্রশংসা করল। সজল নিজেকে আর সামলাতে পারল
না, সে আসর ছেড়ে বেরিয়ে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে চলে গেল। সজলের
অনুপস্থিতি রাহুলের নজর এড়ায়নি। তারপর…
প্রমোদবাবু আস্তে আস্তে নিজের কোয়ার্টারের দিকে এগোতে
লাগলেন, মানুষটি
ভারি ভালো, আবেগ
প্রবণ, পরোপকারী, চট করে আপন করে
নিতে পারেন। যেদিন থেকে রাহুল এই কলেজে জয়েন করেছেন সেদিন থেকে তিনি এই পুত্রসম
সহকর্মীকে ভালোবেসে
ফেলেছিলেন। ওর নির্মল সুন্দর মুখের নিষ্কলঙ্ক পবিত্রতা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। শুধু
তাই নয় ছেলেটির পড়াশোনা এবং অসাধারণ স্মৃতিশক্তি মুগ্ধতার আর একটি কারণ। বহু
সন্ধ্যা কেটে যেত রাহুলের সাথে রিসার্চ সমৃদ্ধ আলোচনায়।
তাঁর নিজের
একটিমাত্র পুত্র।
সুদূর আমেরিকায়
পড়ে
আছে ওদেশের মেয়ে বিয়ে করে। দুটি নাতি নাতনিও হয়েছে। তাতে তার দুঃখ নেই দুঃখ হচ্ছে
বছরে একবার ছাড়া ছেলের কাছ থেকে একটা ফোন পর্যন্ত পান না। পয়লা জানুয়ারি সকালবেলা হই হই করে চারজনে ফোন করে, তাঁর স্ত্রী উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন ছেলের ফোন এলে, তিনি নিজে শুধু কোনরকমে
হ্যাপি নিউ ইয়ার বলে ছেড়ে দেন। ছেলে হয়তো
বুঝতে পেরেছিল যে বাবা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। এক একসময় মনে হয়
তিনি শিক্ষক হিসেবে বৃথা,
এত ছেলে পড়িয়েছেন অথচ নিজের একমাত্র ছেলেকে না দায়িত্ববোধ না কোন মূল্যবোধ
শেখাতে পেরেছেন।
এদিকে
রাহুলকে সজল বলল,
-এলামই যখন
তোদের দেশে তখন একটু দর্শনীয় কিছু দেখে যাই।
সুচরিতা বলল,
-হ্যাঁ চল, আমিও নতুন
এখানে খুব মজা হবে, মনকলির শরীর কেমন রে?
মনকলি বলল,
-মোটামুটি
আছে চল যেতে পারব ঠিকই।
সুচরিতা হঠাৎ লক্ষ্য করল
রাহুল চুপচাপ নিস্পৃহভাবে বসে কোন হ্যাঁ বা না কিছুই নেই, কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-কী হয়েছে তোমার?
রাহুল হাত-পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-কী হবে? কিছুই হয়নি, সবসময় কি
তোমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে নাকি? বিয়ে করেছি বলে তুমি ছাড়া আর কারও
সাথে কথাও বলতে পারব না তা তো হতে পারে না।
-না তা কেন হবে? তুমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলে তাই বলছিলাম, তুমি এভাবে
কথা বলছ কেন আমার সাথে?
-আমাকে একটু একলা ছেড়ে দাও, তুমি ওদের সাথে আড্ডা দাও, আমাকে নিয়ে
সবসময় ভেব না, সবসময়
আমাকে নিয়ে ভাবলে আমার দমবন্ধ
হয়ে যায়।
-সবে একদিন কাটিয়ে দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তবে সারাজীবন আমরা কাটাব কী করে?
-ভয় পেয়ে গেলে?
সুচরিতা দুচোখ ভর্তি
জল নিয়ে বিছানায়
লুটিয়ে পড়ল। রাহুল গিয়ে সজলদের সাথে গল্প করতে বসল, সজল বলল,
-থাকছি যখন আমরা
পুরুলিয়ার কিছু দ্রষ্টব্য জায়গা দেখে যাই, কী বলিস রাহুল?
রাহুল উদাস
গলায় বলল,
-তা যেতেই
পারে, চল
দেখি কোথায় কোথায় তোদের দেখাতে নিয়ে যাই, একটু চা না
হলে ঠিক জমবে না, দাঁড়া
চা আর গরম পকোড়া বলে আসি একটু।
এদিকে
সুচরিতা কেঁদে
কেঁদে চোখ
ফুলিয়ে ফেলেছে, বিছানায়
উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, চা, ডিমের পকোড়া বলে দিয়ে রাহুল ঘরের দিকে এগিয়ে গেল, গিয়ে দেখে
সুচরিতা বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ভালোবাসায় রাহুলের
বুকের ভেতরটা
টনটন করে
উঠল, কেন
যে শুধু শুধু মেয়েটাকে
কাঁদাল কষ্ট দিল
এখন নিজেই ভেবে পাচ্ছে
না।
তবে কি মনকলির
প্রতি এখনও কোন আবেগ কাজ করছে! না সজলের কথায় সুচরিতা
বেড়াতে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল তার
জন্য কোনটা? মনে হয় দুটোর সংমিশ্রণ
ফল।
যাই হোক এখন
তো তার সুচরিতার মান ভাঙাতে হবে। ওর পাশে শুয়ে দেখল, সুচরিতা
কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা সুচরিতাকে নিজের কোলের
ওপর উঠিয়ে নিল, ঘুম
ভেঙে সুচরিতা দেখল, রাহুল
তাকে তুলে কোলে বসিয়ে নিয়েছে, সুচরিতা রাহুলের বুকের ওপর কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল,
-কী করেছিলাম
আমি! কেন
আমাকে অত বকলে?
রাহুল ওকে বুকে চেপে
ধরে আদরে ভরিয়ে দিতে দিতে বলল,
-খুব ভুল হয়ে
গেছে সোনা আর কোনদিন তোকে বকব না, বিশ্বাস কর, তুই যে আমার সর্বস্ব রে
তোকে ছাড়া আমি একটা দিনও কাটাতে পারব না।
-আর
আমি বুঝি পারব? আমার
বুঝি কষ্ট হয় না?
-জানি সোনা হঠাৎ কী যে
হয়ে গেল, কেন
যে এরকম করে বসলাম
নিজেই তা বুঝতে পারছি না। চল এবার যাই ওরা আমাদের জন্য চা আর ডিমের
পকোড়া নিয়ে বসে আছে।
সুচরিতা উঠে
দাঁড়াতেই রাহুল
পকেট থেকে ভাঁজ করা ইস্তিরি করা রুমাল দিয়ে ওর মুখটা তুলে ধরে ভালো করে
মুছিয়ে দিয়ে বলল,
-একেই বলে
বিয়ে করার সুখ, রুমালটা
পর্যন্ত ভাঁজ করা ইস্তিরি করা। লক্ষ্মী বউ আমার। সুচি আমি এমনই অগোছালো রে, মায়ের
ভালোবাসা পেয়েছি প্রাণভরে,
মা একটু দাদাদের দিকে বেশি মনযোগী হলে আমি না খেয়ে বসে থাকতাম, মা বুঝতেই
পারতেন না কেন আমার রাগ হয়েছে, তারপর মা মারা যাবার পর বাড়ির সবাই আমায় কাছে টেনে নিতে
আপ্রাণ চেষ্টা করত, কিন্তু
কেন যেন মায়ের অভাবটা কিছুতেই মেটাতে পারতাম না। বুঝতে পারতাম বাবার ওপর একটা অভিমান
ছিল, মাকে
ভালোবেসে বিয়ে করেও তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে পারেননি তাই বাবাও বহু চেষ্টা করেও
আমায় কাছে টানতে পারেননি। বাবার মৃত্যুর সময় তাই হয়তো আমি দূর
দেশে ছিলাম।
পরে নিজেকেই
অনেক প্রশ্ন করেছি বাবাকে এতটা কষ্ট দেওয়া কি আমার উচিৎ ছিল! অনেকবার
চিঠি লিখেছিলেন জানিস,
"একবার দেখা করে যাও, আমার শরীর খুব খারাপ" এই কথাটা
শুনে যখন যাবার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম, বাবাকে চিঠিও লিখলাম, "বাবা আমি
আসছি" ঠিক
তার পরেই দাদার ফোন পেলাম,
বাবা আর নেই। আমি এমনই নিষ্ঠুর একটা ছেলে। আমার মায়ের পরে তোর মধ্যে আমি সেই
ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছি,
অল্পতেই অভিমান হয়ে যায় পরে নিজেই ভাবি কী করলাম! তোর সাথে
ওরকম করে নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করছিলাম, কী করে মেয়েটাকে এত আঘাত করলাম সবে কাল
যাকে নিজের করে পেয়েছি আর আজই তাকে এরকম করলম? উত্তর হয়তো একটা পেয়েছি কিন্তু তা তোকে বলা যাবে না, তুই হিংসুটে
ভাববি আমাকে!
সুচরিতা
রাহুলের বুকে মাথা রেখে বলল,
-তোমার সব
রাগ অভিমান আমি মেনে নেব কিন্তু কারণটা বল আমাকে কী কারণে রাগ
হচ্ছে? তোমার
জন্য আমি সেই ছোট্টবেলা থেকে অপেক্ষা করে আসছি, এতদিনে তা পেয়েছি, এখন আমার
একমাত্র ব্রত তোমাকে ভালোবেসে তোমাকে সুখী করা, শুধু বেহিসাবি
রাগ করে আমার এতদিনের অপেক্ষার সফলতাকে ভেঙে দিও না। আমার তো বাবা-মাও নেই নিজের কোন ভাইবোনও নেই, আছ শুধু তুমি, আমার নিজের
চেয়েও তোমাকে ভালোবাসি গো,
কেন তুমি ভুল ভাববে?
এই ভুল ভাবাটা তোমার ছেলেমানুষি।
রাহুল
প্রাণপণে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-হ্যাঁ রে
তাই, তুই
তোর অগোছালো বরটাকে তোর মতন করে গুছিয়ে নিস।
-আমার এই অগোছালো বরটাকেই যে আমি ভালোবাসি।
-তাই?
রাহুল গভীর
চুম্বন এঁকে দিল সুচরিতার ঠোঁটে।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment