স্মার্টফোনের কুপ্রভাব
স্মার্টফোনের কুপ্রভাবে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত? সমস্যাকে চিনুন, প্রতিকার করুন, সঙ্গে রয়েছেন বিশিষ্ট মনোবিদ
তাহলে মুঠোফোন ব্যবহারের রকমারি প্রয়োজনীয়তা এবং চূড়ান্ত ক্ষতি— এই দু’টি দিক মাথায় রেখে সবার আগে প্রশ্ন হচ্ছে—
● যদি দেওয়া যায় সেটা কোন ক্লাস থেকে
বা কত বছর বয়স থেকে?
● দৈনিক কতক্ষণের জন্য অনুমতি দেওয়া
যায়?
●
শ্রেণিকক্ষে বা স্কুলের মধ্যে কী মুঠোফোনের
ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া যায়?
হ্যাঁ, এই প্রশ্নগুলোই এই মুহূর্তে আজকের দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে আমরা যারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দায়ভার কাঁধে নিয়ে হাঁটছি তাদের কাছে মুখ্য। কিন্তু এই প্রশ্ন বা সমস্যাগুলোর সঠিক সমাধানে পৌঁছতে গেলে আমাদের আগে ভালভাবে খতিয়ে দেখতে হবে ছাত্রছাত্রীদের ওপর মুঠোফোন ব্যবহারের নেতিবাচক দিকগুলি কতখানি গভীর, কতখানি পরিব্যপ্ত, কতখানি অপূরণীয়, অসংশোধনীয় ভাবে ক্ষতিকর—
●
মানসিক সীমাবদ্ধতার জন্য — মনসংযোগ কমে যাওয়া।
●
অত্যাবশ্যকীয় খুঁটিনাটি ভুলে যাওয়া।
●
অসচেতনতা ও নিষ্ক্রিয় মন-মানসিকতা, মনোসংযোগ গ্রাস
— যার ফলে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ও ইন্টারভিউতে অসাফল্য।
●
নিয়মিত লেখাপড়ার ক্ষতি — সোস্যাল মিডিয়ায় ক্রমাগত
চ্যাটিং বা গল্পের কারণে ক্লাসের রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাওয়া।
●
সময় নষ্ট — দৈনন্দিন বা প্রাত্যহিক জীবনে একটা
বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ের অংশ গান শুনে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে, মোবাইল গেম খেলে
বা সোশ্যাল মিডিয়া ঘেঁটে নষ্ট করছে। তার ফলে সামগ্রিক উন্নতিতে ও জীবনের লক্ষ্যের
পথে পিছিয়ে পড়ছে।
●
অসামাজিকতা বৃদ্ধি — সামনাসামনি বা মুখোমুখি কথা
বলা, গল্প করা বা আলোচনা করার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে ‘আই কন্টাক্ট’ও।
●
স্ট্রেস বা মানসিক পীড়ন বৃদ্ধি — দ্রুত অত্যধিক
মোবাইল নির্ভরতা ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটাচ্ছে। দুশ্চিন্তা, বিরক্তিবোধ,
হতাশা, অধৈর্য, পরিশ্রম বিমুখতা, অলসতা, রাগ প্রভৃতি জন্মাচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে শিক্ষার্থীর
ভবিষ্যৎ।
একটা সমীক্ষা থেকে পাওয়া গিয়েছে, ৬১ শতাংশ অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে অত্যধিক ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হয়ে পড়ছে তাদের হাতে মোবাইল না দিলে।
●
অলসতা ও গড়িমসি মানসিকতার বৃদ্ধি — আজকের কাজ
শেষ প্রহরে আর কালকের কাজ আরও পরে এইভাবে কাজ শেষ না করে কাজকে ক্রমাগত পিছিয়ে দেওয়ার
মানসিকতা অত্যধিক বেড়ে গিয়েছে মোবাইল নির্ভরতা জন্মানোর পর। মোবাইল একান্তভাবে প্রত্যক্ষ
ভূমিকা নিচ্ছে এই ব্যাপারে। গড়িমসি মানসিকতা বা যে-কোন কাজ শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো
করে করার মানসিকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে কাজগুলোকে গুরুত্ব কম দেওয়ার মূলেই থাকছে হাতে
মোবাইল নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো।
●
হিংসাত্মক ঘটনার পর্যবেক্ষণ ও মানসিক অসুস্থতা
— হিংসাত্মক ঘটনার ধারাবাহিক প্রকাশ চোখের সামনে অবিরত হতে থাকছে বিভিন্ন মুভি, ভিডিও
গেম বা সংবাদের মাধ্যমে যা অবোধ ও সরল ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কোমল মানসিকতাকে নষ্ট করে
তাদের হিংসাত্মক, আক্রমণাক্তক, অত্যাচারী, পাশবিক করে তুলছে।
●
কখনও বা ভীত, সন্ত্রস্ত, তাকে বিহ্বল জড় মানসিকতার
করে তুলছে।
●
শৈশব পেরোতে না পেরোতেই আক্রান্ত হচ্ছে বিপিডি
বা বর্ডার লাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার, এমডিডি বা মেনিক ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার, পিটিএসডি
বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার-এর মানসিক রোগগুলো। যার ফলে তাদের মধ্যে দেখা
দিচ্ছে বিষন্নতা, দুশ্চিন্তা, একাকীত্ব অস্থিরতা, অত্যধিক উত্তেজনা এবং আত্মহত্যা।
●
শারীরিক ক্ষতিও দেখা দিচ্ছে বিপুল পরিমাণে উচ্চ
রক্তচাপ, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, হৃদস্পন্দনজনিত সমস্যা, অ্যারিদমিয়া এবং অকাল মৃত্যু।
জিএএম বা জেনারেল অ্যাগ্রেশন মডেল — এর পর একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে হিংসাত্মক মোবাইল গেম খেলতে খেলতে শিশুদের মধ্যে আক্রমণধর্মিতা বাড়ছে বহু গুণ। অন্যদিকে এসডিটি বা সেলফ ডিটারমিনেশন থিয়োরি এই সমীক্ষাকে সমর্থন করে জানিয়েছে, ভায়োলেন্ট গেমিং শিশু-কিশোরদের আসলে হতাশ করে দিচ্ছে, যা তাদের করে তুলছে হিংস্র, আক্রমণাত্মক।
●
ওসিডি — অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার বা ওসিডি
বারবার নতুন মেসেজ বা ইমেল বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া যার হাত থেকে মুক্তি নেই মানুষের।
বরং রয়েছে ছোটবেলা থেকেই পাকে পাকে জড়িয়ে ধরা এক অব্যক্ত দায়ভার — মেসেজের নোটিফিকেশন
চেক করতে করতে জন্ম হচ্ছে সব থেকে যন্ত্রণাময় মনোব্যাধি — অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারের।
অস্বস্তিকর হলেও অগ্রাহ্যকর নয় কোনও মতেই। তার হাতেই নিরুপায় আত্মসমর্পণ। এর ফলে
আচরণ হয়ে উঠছে সমস্যাপূর্ণ।
●
মোবাইলের অতি ব্যবহারের ফলে চারপাশের পরিবেশকে
অস্বীকার, নিকট জনের প্রতি অনাসক্তি এবং সময় বিশেষে মনেও না রাখা, কর্তব্যে অবহেলা,
ক্রমাগত মোবাইলের ব্যবহার, মোবাইলের অতি ব্যবহারের ফলে রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা, কর্মে
বিলম্ব প্রভৃতি।
●
অন্যান্য মানসিক ব্যাধির জন্ম — নিউরো বায়োলজিক্যাল
সমীক্ষা থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে বিভিন্ন মনো-স্নায়বিক ব্যাধির জন্ম হচ্ছে অতিরিক্ত
মোবাইল ব্যবহারের জন্য। যেমন ইন্টারনেট ইউজ ডিজঅর্ডার (আইডিডি) — যার অন্যতম লক্ষণ
হচ্ছে মায়ের প্রতি অনাসক্তি, ম্যাল-অ্যাডাপটিভ কগনিটিভ ইমোশন রেগুলেশন (সিইআর) — যার
লক্ষণ হচ্ছে — আত্ম-অসন্তুষ্টি ও আত্মদোষারোপ, অন্যের প্রতি সাংঘাতিক মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে
দোষারোপ করা, নিজস্ব চিন্তাভাবনা স্মৃতি ও মননশীলতা এমনকি শারীরিক অনুভূতি বা সংবেদনগুলি
থেকে মনকে বিরত রাখা। এছাড়াও অনিয়মিত খাদ্য গ্রহণ, অতিরিক্ত খাদ্যাশক্তি, অত্যধিক
খাদ্য সংযম প্রভৃতি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। সিইআর-এর আরও লক্ষণগুলি হল আত্মনিয়ন্ত্রণ
আরও কমে যাওয়া, একাকীত্ব, আত্মদ্বন্দ্ব, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও ক্ষোভ, মৌখিক বাক্যালাপ
ও যোগাযোগ ক্ষমতার হ্রাস।
●
অনাক্রম্যতার মাত্রা হ্রাস — মোবাইল হাতে হাতে
ঘোরে। তাই প্রচুর জীবাণু তার স্ক্রিনে বা কীপ্যাডে থাকে। এছাড়া কথা বলার সময় মুখ
ও কানের কাছে থাকার দরুন ব্যাধি সহজেই সংক্রামিত হয়। নানান রকম রেডিয়ো অ্যাকটিভ হয়ে
থাকার ফলে অতি ব্যবহার শরীরের নানা ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি করে এবং অনাক্রম্যতা হ্রাস করে।
●
এফওএমও (ফিয়ার অব মিসিং আউট) — এটা এমন একটা নেশাকারক
মানসিক অবস্থা সে ক্ষেত্রে ব্যক্তি প্রতি মুহূর্তে ভাবছে আমি কিছু ক্ষেত্রে কোনভাবে
বঞ্চিত হচ্ছি, যা অন্যরা পেয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে এমন কিছু মজা আছে, যা প্রতি
মুহূর্তে নতুন কোনও ভাল লাগার জন্ম দিচ্ছে, যা থেকে মুঠোফোন বন্ধ করলেই আমি বঞ্চিত
হচ্ছি। আর এই প্রবঞ্চিত হওয়ার বোধ ছড়িয়ে যাচ্ছে জীবনের সকল ক্ষেত্রে। সব ক্ষেত্রেই
এই দুশ্চিন্তা ও আতঙ্ক ছেলে বা মেয়েটিকে গ্রাস করছে যে সে বঞ্চিত হচ্ছে।
●
পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে যোগাযোগ হ্রাস ও সামাজিক
দূরত্ব বৃদ্ধি — ছেলেমেয়েদের আর একটা সমস্যা তৈরি হয়, যা তাদের বাইরের পৃথিবী থেকে
সরিয়ে নিয়ে আত্মকেন্দ্রিক ও পরিশ্রমবিমুখ করে তোলে। সারাক্ষণ অনলাইন চ্যাটিং বা গল্প, সোশ্যাল মিডিয়ায়
ট্রলিং বা ভিডিও দেখতে দেখতে শ্রবনশক্তি ও মন সব কিছুই এক দিকে কেন্দ্রীভূত করে ফেলে।
ফলে তারা অন্য কিছু বা অন্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। বেড়ে যায় সামাজিক দূরত্ব।
দৈহিক ও মানসিক — উভয় দূরত্বই বৃদ্ধি পায়, তৈরি হয় একটা নিজস্ব বলয় যা অপার্থিব বা
ভার্চুয়াল।
●
ব্যবহারের সমস্যা — অতিরিক্ত মোবাইলের ব্যবহার
ও তার ফলে মোবাইল আসক্তি শিক্ষার্থীদের এতটাই বশীভূত করে ফেলে যে, তাদের হাত থেকে মুহূর্তের
জন্য মোবাইল সরানো যায় না। জোর করে মোবাইল নিয়ে নিলে, অতিরিক্ত বদমেজাজ, হিংস্ৰ আচরণ,
তীব্র আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠা, বিষণ্ণতা-বোধের বৃদ্ধি, ক্ষোভ ও অসন্তোষ, মিথ্যা কথা বলা,
বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া, বড়দের গায়ে হাত তোলা, চুরি করা এমনকি আচমকা ক্রোধের বশে খুন
বা আত্মহত্যাও বর্তমানে বিরল নয়।
●
জীবনের লক্ষ্যহীনতা— লক্ষ্য স্থির করা এবং সেই
লেখ্যপাঠে নিজেকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখা শিক্ষার্থীদের জীবনের সব থেকে বড় লড়াই। সেই লড়াইটাই
ক্রমশ কমে যাচ্ছে আজকের ছেলেমেয়েদের মধ্যে। মোবাইলে অতিরিক্ত সময় যাপন তাদের স্পষ্ট
কোনও লক্ষ্য স্থির করাতে এবং দ্বিধাহীন ভাবে তাতে মন নিবদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়াতে স্পষ্টই
বাধা দিচ্ছে। একটা দ্বন্দ্বমূলক, মানসিক অবস্থা বা ‘কনফিউজড স্টেট অব মাইন্ড’ তাদের
সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকছে।
●
অনিদ্রা বা ঘুমের সমস্যা— দীর্ঘক্ষণ মোবাইলের ব্যবহার,
বিশেষত অনেক রাত পর্যন্ত মোবাইলের ব্যবহার চোখের সঙ্গে সঙ্গে ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।
নিদ্রার জন্য যে হরমোন ক্ষরিত হয় ‘মেলাটোনিন’- রাত ন’টায় তার ক্ষরণ হয়। কিছু মোবাইলের
যে আলো, সেই আলো মেলাটোনিন ক্ষরণকে প্রতিহত করছে। এইভাবে দিনের পর দিন সঠিক সময়ে,
সঠিক পরিমাণে ক্ষরিত হতে না পেরে মস্তিষ্ক ক্রমশ মেলাটোনিনের ক্ষরণ বন্ধ করে দিচ্ছে।
কাটছে নির্ঘুম রাত। ঘুমহীনতার ফলে ছেলেমেয়েরা
আরও হয়ে উঠছে হতাশ, ঘ্যানঘ্যানে, ধৈর্যহীন, অস্থির, অকারণ উত্তেজিত প্রভৃতি।
●
দীর্ঘক্ষণ এই একভাবে একই ভঙ্গিতে মোবাইল ব্যবহার
করার ফলে দেখা যাচ্ছে জয়েন্ট পেন, মাসল্ পেন, ব্যাক পেন প্রভৃতি নানান রকম যন্ত্রণা—
যা একসময় চিরকালের সঙ্গী হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং শরীরের বিকৃতিও ঘটাচ্ছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment