প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

ঝড় | টিকে থাকার সাধনা

বাতায়ন /ঝড়/ সম্পাদকীয়/ ৩ য় বর্ষ/ ১ ম সংখ্যা/ ১লা বৈশাখ,   ১৪৩ ২ ঝড় | সম্পাদকীয় টিকে থাকার সাধনা "প্রত্যেক সাহিত্যসেবীর অন্তরে চিরকালীন...

Saturday, December 30, 2023

মানুষ | বিরথ চন্দ্র মন্ডল

বাতায়ন/ছোটগল্প/১ম বর্ষ/২৭তম সংখ্যা/১৩ই পৌষ, ১৪৩০

ছোটগল্প
বিরথ চন্দ্র মন্ডল

মানুষ

ধারণাটা এমন ছিল যেন রমেশ কিছুই পারে না। রমেশের দ্বারা কিছুই সম্ভব নয়। আরো অনেক কিছু রটেছিল ওর নামে। ও নাকি বড্ড আলখাল্লা। ঠিকমতো গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। একরকম পাগল পাগল যেন।

অকারণে ভুলভাল রটে যাওয়া এই রমেশ, আজ দীর্ঘ বছরের পর ভীষণ খুশি। এই খুশির আনন্দে চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। কলা গাছের শরীরে ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করলে যেমন গলগল করে গাছ নিঃসৃত জল গড়িয়ে পড়ে, রমেশের চোখ থেকে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে সেই ভাবে। এ কান্না তার আনন্দের কান্না। তার জয়ের কান্না। আসলে উঠতি বয়সে আর পাঁচ জনের মতো তার অনেক স্বপ্ন ছিল। এক সত্যিকারের মানুষ হবার স্বপ্ন। বড় হয়ে সমাজকে আমূল বদলে দেবার স্বপ্ন। যে দেখবে, সবাই তাকে অনুসরণ করবে। তার চলাফেরা, ওঠাবসা এইসব দেখে সবাই তারিফ করবে। কিন্তু জীবনের হাফ বয়সে এসেও কিছুই করতে পারেনি সে। শেষে কিনা অকর্মণ্য হয়ে ঘরে বসে। এই বয়সে বিয়ে করে সন্তানের জন্ম দিল বটে। সত্যিকারের মানুষ গড়ার ক্ষেত্রে, সেখানেও যেন ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা। আদর্শ স্বামী হবার কথা ভাবলে মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে দেয় সে। সানাই তাকে ভালবাসে, এ কথা ঠিক। কিন্তু সংসারে চরম দারিদ্রতা। নিরন্তর সাংসারিক অভাবে সানাইও যেন জবুথবু। তারও বা কী করার আছে!

আজ বেশ কয়েক বছর রমেশের ছেলেকে কেউ দেখেনি। কোথায় আছে? কী করছে? এসব নিয়ে জিজ্ঞেস করলে রমেশ চুপচাপ থাকে। রা - পর্যন্ত করে না। রমেশের এই অস্বাভাবিক চুপচাপ গ্রামের লোককে ভাবিয়েছে বেশি। এই কারণে গ্ৰামের মানুষ উল্টোপাল্টা যে যেমন পেরেছে, মনগড়া ভাবে রটিয়েছে চারিধারে। কেউ বলছে - রমেশ তার ছেলেকে খুন করে গায়েব করেছে। কেউ বলেছে - ছেলেটা কোন মেয়ে নিয়ে বাবার ভয়ে দেশান্তরী হয়েছে। আবার কেউ বলেছে - বসন্তিয়ায় সরস্বতী ঠাকুরের ভাসানোর সময় মদ খেয়ে রাস্তায় পড়েছিল। সেখানেই হয়তো মারা গেছে।

আজ এক গাঁ লোকের সামনে পরান মণ্ডল চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল কথাটা। বলল— “হ্যাঁ আপনারা যা যা শুনেছেন সব সত্যি। এত দিনের পর আসল সত্যিটাই প্রকাশ পেল। রমেশের ছেলে প্রমথেশ ঘরে ফিরছে। শুধু সুবর্ণ দিঘি গাঁ কেন - সারা তল্লাটের মুখ উজ্জ্বল করেছে প্রমথেশ। যারা বড় বড় কথা বলে মাতব্বরি দেখিয়েছিল, রমেশের নামে যা-না-তাই কুৎসা রটিয়েছিল! শেষে কিছু লাভ করতে পারল কি ওরা? অথচ অকারণে মানুষটা শুধু শুধু অপমানিত হয়েছে। লাঞ্ছনা গঞ্জনা চুপচাপ সয়েছে। সেদিন থেকে দেখেছি, রমেশকে মনমরা হয়ে থাকতে। কী অপরাধ ছিল মানুষটার? রমেশ একদিন বেধড়ক পিছিয়ে ছিল প্রমথেশকে। চ্যাংড়া ছেলেদের সাথে মদ খেয়েছিল সেদিন। রমেশের চোখে পড়ে যায়। প্রথমে ভুলকে ভুল বলে স্বীকার করতে চায়নি ছেলে। অযথা তর্ক করে যাচ্ছিল। বলেছিল – ‘সবাই মদ খায়। আমিও খেয়েছি। তাতে দোষ কীসের? তাছাড়া ওরা খাওয়ালে আমি কি খাব না?’ কথাটা শুনে মাথায় রাগ উঠে গেছিল রমেশের। পাশে বাবলা ছড়ি পড়েছিল। তা দিয়ে দমাদম উত্তমমধ্যম দিয়েছিল। এত বড় ছেলেকে শাসন করতে কোথায় যেন লেগেছিল তার। সেদিন সারারাত ঘুমোতে পারেনি দুর্ভাবনায়। নিজের জীবনের এই পরিণতি। তারপর ছেলের এমন বাজে সঙ্গদোষ! এই ভুল অবস্থা থেকে ত্রাহি পাবার নানা পথ খুঁজে বেরিয়েছিল সেদিন। ভোর রাতে চুপিসাড়ে তার বিশ্বস্ত মাস্টারমশাইয়ের কাছে রেখে এসেছিল ছেলেকে। রেখে এসেও রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারেনি। ছেলে কতটা মানুষ হল! কিংবা আদৌ হল কিনা - এই ভাবনায়। নিজের স্ত্রী ছাড়া আর কাউকে জানতে দেয়নি - আজ পর্যন্ত ছেলে কোথায় আছে! আজ, এই প্রমথেশ সরকারি চাকরি পেয়েছে। নিম্ন আদালতের ব্যারিস্টার। মাস্টারমশাইয়ের কথায় – ‘প্রমথ নাকি দ্বিতীয় রমেশ। সৎ, বিনয়ী এবং…’”

 

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)