বাতায়ন/ত্রৈসাপ্তাহিক/ছোটগল্প/২য়
বর্ষ/১৫তম সংখ্যা/শারদ/১১ই আশ্বিন, ১৪৩১
শারদ | ছোটগল্প
দেবব্রত রায়
ভাবীকাল
"চিত্রাঙ্গদা বলল, আমি জেন্ডার চেঞ্জ করাচ্ছি না! ওর কথা শুনে থতমত-গলায় ময়ূরাক্ষী বলল, কিন্তু কেন! ...সবকিছুর লিগাল-রেজিষ্ট্রেশন হয়ে গেছে! চিত্রাঙ্গদা ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, ল আগে না, লভ আগে! তারপর নিজের বাকি কথাগুলো শেষ করেই সে ময়ূরাক্ষীর গালে একটা চুমু এঁকে দিল।"
দিনটা ২২৪০-এর রবিবার। আজ
জেন্ডার চেঞ্জ করে চিত্রাঙ্গদা ছেলে হবে। এটাই এখন সামাজিক নিয়ম হয়ে উঠেছে। কারণ
২০৬০-এর ১২ই জানুয়ারি,
রাত্রি ৯ টার সময় পুরুষেরা তাঁদের ওয়াই-ক্রোমোজমটি সম্পূর্ণভাবে
হারিয়েছিলেন। এবং পৃথিবীর শেষ পুরুষটিও মারা গেছেন আজ থেকে ৭০বছর তেত্রিশ দিন আগে।
অনেক আশা নিয়ে সিমেন প্রিজার্ভেশন করা হলেও, মেডিকেল-সায়েন্স
তার থেকে আশানুরূপ ফল পায়নি। মিসক্যারেজের পরিমাণ বেড়ে গেছিল এবং
বেশিরভাগ
ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে সক্ষম শিশুর জন্ম হচ্ছিল! ক্লোনিংয়ের ফলে তৈরি হয়েছিল অন্য
আরেক সমস্যা! পুরানো সময়ের রোগগুলো আবার পোস্ট-ডিজিটাল দুনিয়ায় ফিরে আসতে শুরু
করেছিল! সে-কারণে অন্যান্য অপশনগুলোর মধ্যে এই পদ্ধতিটাই এখন মানুষের একমাত্র
গ্রহণযোগ্য এবং সেফ বলে মনে হয়েছে। জেন্ডার চেঞ্জের আগের দিন সব ফ্যামিলিতেই একটা
ছোটখাট অনুষ্ঠান হয়। উত্তর-পুরুষ হিসেবে নির্বাচিত সদস্যটির নতুন নামকরণ হয় এবং
সেটা সরকারি নথিতে রেজিস্ট্রি করা হয়। গতকাল চিত্রাঙ্গদাদের বাড়িতেও এসব হয়েছে।
কাল সারাদিন এতটাই ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে যে চিত্রাঙ্গদা, ময়ূরাক্ষী
আর ওদের ফ্যামিলির লোকজনদের পালা করে বিশ্রাম নিতে হচ্ছিল! নিমন্ত্রিত হিসেবে
অনেকেই এসেছিলেন। খাওয়াদাওয়ার পর চিত্রাঙ্গদা আর ময়ূরাক্ষীর একটু বিশ্রাম নেওয়ার
ইচ্ছে ছিল কিন্তু, খাওয়া শেষ হতে-না-হতেই,
একে-একে অতিথিদের অনলাইনে বুক করা গিফটগুলো আসতে শুরু করেছিল।
ছেলেদের পারফিউম সেট, হেয়ার-ক্রিম, ইলেকট্রনিক রেজার, গাদাগাদা প্যান্ট-শার্ট, আন্ডারওয়্যার, নানান ধরনের রিস্টওয়াচ এবং অন্যান্য
গিফটে একটা রুম প্রায় ভরে উঠেছিল।
চিত্রাঙ্গদার ইচ্ছে ছিল
রাতের খাবার খেয়ে ময়ূরাক্ষী আজ ওর সঙ্গেই থেকে যাক। আসলে নিজের মনের ভিতরে যে-সব
অদ্ভুত কৌতূহলগুলো
জন্ম নিচ্ছিল চিত্রাঙ্গদা সেগুলো ওর সঙ্গে শেয়ার করতে চাইছিল। কিন্তু ময়ূরাক্ষীর
আজ রাতে দুটো মেজর অপারেশন আছে। তাই এখান থেকেই রাতের খাবার খেয়ে সে রাঢ়-বাংলা
মেডিকেল কলেজে চলে যাবে। এবং একেবারে আর্লি মর্নিং-এ আবার,
হসপিটাল থেকে ও চিত্রাঙ্গদাদের বাড়িতে চলে আসবে।
অবশ্য এই মুহূর্তে
ময়ূরাক্ষীর মনের ভিতরেও কম টানাপোড়েন চলছিল না। চিত্রাঙ্গদা এমনিতেই একটু
রিজার্ভড। যদিও ভারতীয় ইন্টিলিজেন্স-ডিপার্টমেন্টের একজন অফিসার হিসেবে, এই ধরনের অ্যাটিটিউড মেইনটেন
ওদের ডিপার্টমেন্টেরই একটা অন্যতম শর্ত।
জেন্ডার চেঞ্জের পরে ওর
সঙ্গে জেডি মানে পুরানো চিত্রাঙ্গদার বিয়ে হবে। রাত্রি সাড়ে-আটটা নাগাদ ফ্যামিলির
সবাই ডিনার সেরে লনে বেড়াতে যেতেই, ময়ূরাক্ষী চিত্রাঙ্গদাকে শোবার ঘরে নিয়ে
গিয়ে ওর বুকের উপর নিজের শরীরটা আস্তে করে ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর চিত্রাঙ্গদার ঠোঁটে
একটা গভীর চুমু খেয়ে বলেছিল, ছেলে হয়ে যাবার পর তুই আমাকে
এরকমই ভালবাসবি তো। চিত্রাঙ্গদাও ময়ূরাক্ষীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, এনি ডাউটস!
ময়ূরাক্ষী বলল, না, মানে
তখন শরীর এবং মনে কিছু-কিছু হরমোনাল-চেঞ্জ তো আসবেই!
রবিবার ভোর হওয়ার অনেক
আগেই অবশ্য ময়ূরাক্ষী চিত্রাঙ্গদাদের বাড়িতে চলে এসেছিল। ওদের বাড়িটা বেশ বড়সড়।
চিত্রাঙ্গদার দাদু-ঠাকুমা জ্যেঠু কাকু তাঁদের বউয়েরা সবাই একসঙ্গে এই বাড়িটাতেই
থাকেন। ছেলেমেয়েরা,
যারা বাইরে থাকে তারাও এ দেশে এলে এখানেই ওঠে।
এখন বেশিরভাগ ফ্যামিলিই
একান্নবর্তীভাবে থাকতে শুরু করেছে। কারণ নিউক্লিয়ার সোসাইটিতে বিলং করার সময়
ডিপ্রেশন থেকে মানুষের আত্মহত্যার রেট ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছিল। এবং সে-সময় থেকেই
মনোবিজ্ঞানীদের পরামর্শ মতো মানুষ আবারও একান্নবর্তী হয়ে থাকতে শুরু করেছিলেন।
ময়ূরাক্ষী ওয়াচম্যানকে
ডেকে মেন গেট খুলিয়ে সোজা উঠে এলো সেকেন্ড ফ্লোরে। তারপর ১২ নম্বর সুইটের দরজায় এসে ও নক করল। আর প্রায়
সঙ্গে-সঙ্গেই রাতের পোশাকে দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়াল
চিত্রাঙ্গদা। সামান্য ফোলা-ফোলা চোখমুখ! ভোরের আলোয় কী সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে!
ময়ুরাক্ষী বেশ-কিছুক্ষণ হাঁ-করে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। এই চেহারার প্রেমেই পড়েছিল
সে। তারপর যত দিন গড়িয়েছে ময়ূরাক্ষী বুঝতে পেরেছে চিত্রাঙ্গদার মনটা, ওর চেহারার চেয়েও হাজারগুণ ভাল। কিন্তু আজকের পরেই চিত্রাঙ্গদা
সম্পূর্ণভাবে একজন পুরুষ হয়ে যাবে! একটা চোরা-দীর্ঘশ্বাস যেন বেরিয়ে এল ময়ূরাক্ষীর
বুকের গভীর থেকে!
চিত্রাঙ্গদা এসে
ময়ূরাক্ষীর হাত ধরেই একটু চমকে উঠল। বলল, কী-রে!
ময়ূরাক্ষী কিছু না-বলে
চিত্রাঙ্গদাকে জড়িয়ে ধরে ওর রুমের ভিতরে ঢুকে গেল।
সকাল ৮-০৩ এ ওরা হসপিটালের
উদ্দেশে রওনা দিল। সঙ্গে চিত্রাঙ্গদার কাকু-কাকিমা আর ওর এক বোন আছে। চিত্রাঙ্গদার
মা-বাবা, জ্যেঠু-জ্যেঠিমা
এঁরা সবা বিকেলে যাবেন। ৮-১৩ তে হসপিটালে পৌঁছে গেল ওরা। কাগজপত্র সবকিছু আগের
থেকেই রেডি করা ছিল। শুধুমাত্র কয়েকটা পেপারে চিত্রাঙ্গদার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া
বাকি ছিল। সেসব শেষ হওয়ার পর আধঘন্টার মধ্যেই একজন নার্স এসে চিত্রাঙ্গদাকে ওটির
জন্য তৈরি করে দিলেন। সকাল ৯ টায় চিত্রাঙ্গদা হাসিমুখে সবাইকে বাই জানিয়ে ধীর-পায়ে
ওটি-র ভিতরে গিয়ে ঢুকল। ময়ূরাক্ষীর চোখদুটো যেন একটু ভিজে উঠল। সে চিত্রাঙ্গদার
কাকা-কাকিমা আর ওর বোনের থেকে খানিকটা দূরে সরে এসে রুমাল বের করে নিজের চোখের
কোণদুটো মুছে নিয়ে মাথা তুলতেই দেখল, ওটি-র দরজা খুলে চিত্রাঙ্গদা
আবারও হাসিমুখে বেরিয়ে আসছে! চিত্রাঙ্গদাকে ওটি-র থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে ওর
কাকা-কাকিমা, বোন, সবাই অবাক-চোখে ওর
দিকে তাকিয়ে রইল। ময়ূরাক্ষী ছুটে গিয়ে চিত্রাঙ্গদাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর নিজের সমস্ত
আবেগকে কন্ট্রোল করে সে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
চিত্রাঙ্গদা বলল, আমি জেন্ডার চেঞ্জ করাচ্ছি
না!
ওর কথা শুনে থতমত-গলায়
ময়ূরাক্ষী বলল,
কিন্তু কেন! ...সবকিছুর লিগাল-রেজিষ্ট্রেশন হয়ে গেছে!
চিত্রাঙ্গদা ওর কানের কাছে
মুখ নিয়ে গিয়ে বলল,
ল আগে না, লভ আগে! তারপর নিজের বাকি কথাগুলো
শেষ করেই সে ময়ূরাক্ষীর গালে একটা চুমু এঁকে দিল।
সমাপ্ত
ভবিষ্যতের মানব-সভ্যতা। গভীর চিন্তার মধ্যে ভালোও লাগছে । খুউবই ভালো গল্প
ReplyDeleteঅজস্র ধন্যবাদ আপনাকে, ভবিষ্যত দেখানোর জন্য
দারুন
ReplyDeleteপ্রিয় পাঠক, অজস্র ধন্যবাদ জানবেন। ভালো থাকুন সবাই
ReplyDelete