প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দহন | মানুষকে মানুষের মূল্য দিন

বাতায়ন/দহন / কবিতা / ৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ ,   ১৪৩২ দহন   | সম্পাদকীয় "এর মধ্যেই আছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সে-কোন সন্ত্রাসবাদীই হ...

Friday, May 16, 2025

খেজুর সন্ন্যাসী [১ম পর্ব] | শাশ্বত বোস

বাতায়ন/দহন/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
দহন | ধারাবাহিক গল্প
শাশ্বত বোস
 
খেজুর সন্ন্যাসী
[১ম পর্ব]

"গাজীপীর কোন এক জীবনে হিন্দু ছিলেন। হয়তো বা ছিলেন নিম্নবর্গজাত। হয়তো বা ব্রাহ্মণ্যবাদের নিপীড়নে কোনঠাসা হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে বাংলায় বখতিয়ার খলজি অধ্যায়ে ইসলাম ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে ধর্মান্তরিত হন।"


চৈত্র শেষের গুমোট ভাবটা থেকে থেকে যেন ফুলে ফুলে উঠছে, ঠিক উলু ঘাসের ঝোপে ফোটা ভাটফুলের বেগুনি রঙের গোড়াটার মতো। পাড়াগেঁয়ে পার্বণের গন্ধটা ধানজমির ধারের মেঠো ইঁদুরের গর্ত হয়ে, বাওড়ের পাঁকে ডুবে থাকা শাপলার আলগা ভিজে শরীরটা বেয়ে, লৌকিক অলৌকিকের বিশ্বাসের মাঝে সিন্দুরমতি তিলক টেনে ছড়িয়ে পড়ছে, গাজনসন্ন্যাসীর দু-আঁজলা ভিক্ষের মাঝে। বাংলা বছরের শেষ উৎসব গাজনে, চড়কে মেতে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এই নয়ানপোঁতা গ্রাম, ফেরা আর না ফেরার মাঝখানের ধূসর জায়গাটুকুতে দাঁড়িয়ে মাটির সঙ্গে শিকড়ের গভীর সংযোগ আর সরলতার আঘ্রাণে, সর্বক্ষণ যেন পরম আশ্রয়ের নিশ্চিন্তপুর খুঁজে চলেছে। কখনো কোন হিন্দুবাড়ির নিকোনো উঠোন আর তুলসীমঞ্চ জুড়ে আবার কখনো কোন নামাজী মুসলমানের মুখনিঃসৃত কলমার বিড়বিড়ানিতে।

 
কাঁসরের সাথে ঢাকের বাজনাটা ক্ষেতের ভেতর থেকে এগিয়ে আসছে ডোবাটার দিকে। ওতে একটা নির্দিষ্ট ছন্দ আছে। সাথে অহরহ স্ত্রীলোকদের উলুধ্বনি আর তাল-কাটা সানাইয়ের মতো “শিব, শিব, মহাদেব” শব্দের সমবেত গর্জন যেন স্যাঙাতের কাজ করছে। আকাশ বাতাস ফুঁড়ে সেই ধ্বনিতরঙ্গই যেন কোন অজানালোক হতে অনিমিখ ঈশ্বর সাধনার বিরতিহীন ধোয়াঁটে এক বিস্তার বুনেছে দিকচক্রবাল জুড়ে। লালবসন পরিহিত হাড়গিলগিলে চেহারার কিছু পুরুষ আর সাথে লালশাড়ি পরিহিত রুক্ষ চুলের কিছু নারীশরীর, যেন ঈশ্বরী নিমগ্নতায় চুর হয়ে টলমল পায়ে, মাথায় একটা বিশাল কাঠের পাটাকে আপাদমস্তক লাল সিঁদুরে চর্চ্চিত করে এগিয়ে চলেছে এক উগ্র আত্মাহুতির সাক্ষী হতে। এদিকটায় তখন মেয়ে বৌদের ভিড় লেগে গেছে। কৌতূহলী চোখগুলোতে তখন বিস্ময় আর বিশ্বাস মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে, যেন প্রকৃতির মায়ায় জমাট বেঁধেছে নীলকণ্ঠের গাঢ় রং! অনেকগুলো অভুক্ত অমাবস্যা পূর্ণিমা পার করে এক আশ্চর্য ব্যালেন্সে আস্ত মহাদেবকে মাথায় তুলে নিয়েছে ওরা। তাঁর পরনে রক্তাম্বর, মাথার গোড়ায় একটা ছোট ত্রিশূল পোঁতা। সন্ন্যাসীদের ভাষায় এঁকে ‘দেল’ বলে। আসলে একটা হাতসাতেকের পাটা, দেখতে অনেকটা ছোট ছিপনৌকার মতো। তার গায়ে শঙ্খচক্রসহ আরো অন্যান্য প্রতীক খোদিত। ত্যাগ, ভক্তি আর বিশ্বাসের দোলায় চড়ে, প্রায় গোটা চৈত্র মাস জুড়ে দেল সন্ন্যাসীদের মাথায় চড়ে বাড়ি বাড়ি ঘোরেন মহাদেব। এই ভিক্ষান্নই দিনে মোট দুবার হবিষ্য করে গ্রহণ করতে পারেন সন্ন্যাসীরা। একবার ভোর তিনটের সময় আরেকবার রাত আটটায়, মহাদেবকে ভোগ চড়ানোর পর। ডোবাটার দক্ষিণদিকে জোড়া খেজুরগাছ। সেখানে তখন লালবসন পরিহিত আরেক সন্ন্যাসী হাতের মুঠোতে ধুনো ভরে ধুনুচিতে ছুঁড়ে দিচ্ছেন আর সেই ধুনোর ধোঁয়া মস্ত অজগর সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে আশপাশ ঢেকে ফেলছে যেন! অমরত্বের আশায় পেয়ে বসা উড়নচণ্ডী কোন এক সন্ন্যাসী তার ঝাঁকড়া চুল এলো করে প্রচণ্ড জোরে মাথা দুলিয়ে মন্ত্র পড়ছেন আর হাতে মুঠো করে ধুনো নিয়ে নিভু নিভু জ্বলতে থাকা ধুনুচিতে ছুঁড়ে মারছেন,
 
“এর ধুপ সের ধুপ কালা ধুপ,
এই চার ধুপ পড়িয়া করলাম চুপ।
এই ধুপের গন্ধ যাবে শ্রীকৈলাশপুর।
এই ধুপের গন্ধে নাচে আপাল আর গোপাল।
এই ধুপের গন্ধে নাচে বারো ফাল্গুনী,
এই ধুপের গন্ধে নাচে ঢাকি ও সন্ন্যাসী।
এই ধুপের গন্ধে নাচে কার্তিক গণপতি,
এই ধুপের গন্ধে নাচে লক্ষ্মী সরস্বতী,
এই ধুপের গন্ধে নাচে শিব ও পার্বতী।”
 
গোটা মাস জুড়েই প্রায় দেল সন্ন্যাসীদের ব্রতপালন চলেছে। গেলো চোদ্দোদিন এক কাপড়ে আছেন ওঁরা। খেজুরসন্ন্যাসসহ মোট ষোলোরকমের সন্ন্যাস ওরা করে থাকেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আটসন্ন্যাস, ঘাটসন্ন্যাস, জলসন্ন্যাস, আগুনসন্ন্যাস, তালসন্ন্যাস। দেহ সাধনার আড়ালে এসবই মুগ্ধ সুগন্ধময় মাটির বুকে, ধীর, শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন এক আলোকবর্তীকায় তৈরি করে গাজনসন্ন্যাসীদের কৃচ্ছসাধনের এক কঠিন বোহেমিয়ান চালচিত্র। এই নয়ানপোঁতার চড়কের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এখানকার চড়কে সন্ন্যাসীদের সকলেই প্রায় মুসলিম। গাজীপীরের দরগা যেখানে এই চড়ক ভাঙা উৎসব হয়, সেটা আসলে গাজী মৈনুদ্দিনের কবর। তবু এই চড়কের দিনে হিন্দু মুসলিম মিলে মিশে এক হয়ে যায়। এই গাজীপীর কোন এক জীবনে হিন্দু ছিলেন। হয়তো বা ছিলেন নিম্নবর্গজাত। হয়তো বা ব্রাহ্মণ্যবাদের নিপীড়নে কোনঠাসা হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে বাংলায় বখতিয়ার খলজি অধ্যায়ে ইসলাম ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে ধর্মান্তরিত হন। তবু তাঁর প্রেরণায় এবং স্থানীয় বিশ্বাসের জোরে গাজনসন্ন্যাস, চড়ক কিংবা খেজুরঝাঁপ বন্ধ হয়নি আজও। ভাঙা ভাঙা স্বরে মেঠো ফরিয়াদী সুরের মতো সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলছে!
 
দেলসন্ন্যাসীদের প্রধান দুই পান্ডা বা ‘বালা’, যাঁরা নিজেরাও ইসলামী পয়গম্বর তারা দক্ষিণমুখী সদরের সামনে বসে মাজারের পীরের উদ্দেশ্যে পূজা নিবেদনের পর, গাজনের একখানা লম্বা ছড়া পড়েন।
 
“ইরূপে দ্বিজগন কোরে সৃষ্টি সম্হারন
আমি বোরো হইলো অভিচার
বৈকন্ঠে ধর্ম মনে ত পাইয়া মারমা
মায়াতে হইলো অন্ধকার
ধর্ম হোইলা যবনরূপী মাঠে তা কালো টুপি
ঘৃণা শোবে ত্রিকচ্ছ কামান
চাপিয়া উত্তম হয় ত্রিভুবনে লাগে ভয়
খোদয়ে বলিয়া এক নাম
নিরঞ্জন নিরাকার হইলো ভেস্ত অবতার
মুখেতা বোলে তা ডোম্বোদার
যতেক দেবতাগন সবে হোইয়া একমন
আনন্দেতা পোরিলো ইজার
ব্রহ্মা হোইলা মুহম্মদ বিষ্ণু হোইলা পেকাম্বর
আদমফা হইলো সুলাপানি
গণেশ হোইয়া গাজী কাত্তিক হোইলা কাজী
ফকির হইলা জোট মুনি
তেজিয়া আপন ভেক নারদ হইলা শেখ
পুরন্দর হইলো মালানা
চন্দ্র সূর্য আদি দেবে পদাতিক হোইয়া সেবে
সবে মিলে বাজায় বাজনা
অপুনি চণ্ডিকা দেবী তিনহু হোইলা হায়া বিবি
পদ্মাবতী হইলা বিবি নূর
যতেক দেবতাগ হোইয়া সবে একমন
প্রবেশ করিলো জাজপুর
দেউল দোহারা ভাঙ্গে ফাদ্যা ফিদ্যা খায় রঙ্গে
পাখোর পাখোর বোলে বোল
ধোরিয়া ধরমের পে রামাই পণ্ডিত গে
আমি বোরো বিশম গন্ডোগল”
 
ঢাক ঢোল কাঁসরের উচ্চ স্বরের বাজনা আর সাথে “শিব শিব মহাদেব, দেবের দেব, মহাদেব” এই উল্লাসে সে আওয়াজ চাপা পড়ে যায়। যেন অলীক শ্রাবণমেঘে ছেয়ে যায় খটখটে চৈত্রের আকাশ! বাকি সন্ন্যাসীরা তখন ইমারতের পূর্বদিকে পশ্চিমমুখী হয়ে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। ছড়া পাঠের সাথে সাথে মূল সন্ন্যাসীদের ঘিরে নানা মুদ্রাসহ মাথাচালা, বেতনাড়া ও সন্ন্যাসধর্ম অনুসারে শিবপূজার যাবতীয় রীতিনীতি পালিত হতে থাকে। গাজীপীর এই নয়ানপোঁতার দেবতা। ভক্তদের বিশ্বাসে তিনিই এখানকার ধর্মঠাকুর, সব বিপদের পরিত্রাতা। আজও গোরুর প্রথম দুধ, গাছের প্রথম ফল পীরকে নিবেদন না করে কেউ ভোগ করে না এই গ্রামে। গৃহারম্ভ, গৃহপ্রবেশ, অন্নপ্রাশন, ব্যবসা-বাণিজ্যের শুভারম্ভ, বিদেশযাত্রা এমনকি স্বদেশ প্রত্যাগমনের শুভ মুহূর্তে গাজীপীরকে শিরনি দেওয়া হয়। সন্তান লাভের আশায় এই চড়কের দিনে গাজীপীরের থানে খেলনা ঘোড়া মানত করে গ্রামের মেয়ে বৌয়েরা।
 
ক্রমশ…

No comments:

Post a Comment

জাল— মাছ কাটতে না জানলেও কিছু মানুষ জানে


Popular Top 10 (Last 7 days)