বাতায়ন/শারদ/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ধারাবাহিক গল্প
শুভব্রত
ব্যানার্জী
উমা
[১ম পর্ব]
"বিসর্জনের জন্যে প্রতিমা বরণের আগে থেকে সেই উমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জমিদার বাড়ির দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন বলে কথা, অনেক লোকের সমাগম ঘটেছে।"
দশমীর দিন নিরঞ্জনের জন্যে প্রতিমা বরণ করার প্রাক মুহূর্ত থেকে উমা নিখোঁজ। চারিদিকে হুলুস্থুল কাণ্ড। তার মা, গোবিন্দনগর জমিদার বাড়ির বড়বৌ অহনা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বাড়ির অতিথি মেয়ে-বৌরা তাঁকে সান্তনা দেবার ভাষা
খুঁজে
পাচ্ছেন না। সবাই জমিদার বাড়ির আনাচেকানাচে তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাকে কোথাও খুঁজে
পায়নি। ঢাক, কাঁসর-ঘণ্টা, প্রতিমা বরণ সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিমা বরণের শুভ সময়
প্রায় পেরিয়ে যায়। জমিদারগিন্নি মন্দিরাদেবী একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন আরেক জননী
মৃন্ময়ী মা দুর্গার দিকে। তাঁর দুই গাল বেয়ে বয়ে চলেছে অশ্রুধারা। কাতরভাবে
প্রার্থনা করে চলেছেন মৃন্ময়ী মায়ের চিন্ময়ী রূপের চমৎকার দেখার আশায়।
গোবিন্দনগরের জমিদার
অতীন্দ্রমোহন চৌধুরীর বাড়ির দুর্গাপুজো এবার তিনশো বছরে পড়েছে। আগের সেই জমিদারি
জৌলুস আর নেই কিন্তু আভিজাত্য এখনও অটুট আছে। এখনও
গোবিন্দনগর ও আশেপাশের গ্রামের লোক তাঁদের সম্মান করে। তার কারণও আছে, জমিদারি অত্যাচার বলতে যা বোঝায় তাঁদের পূর্ব পুরুষেরা বা
তাঁরা কোনদিনই করেননি জনগণের ওপর। বরং জনসাধারণের আপদে-বিপদে, সুখে-দুঃখে তাঁরা সবসময় তাদের পাশে থেকেছেন। গ্রামের লোক সারাবছর
অপেক্ষা করে থাকে জমিদার বাড়ির এই দুর্গা পুজোর জন্যে। গ্রামে এখন দু-একটা
সার্বজনীন দুর্গা পুজো শুরু হলেও জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোর ঐতিহ্য ও আনন্দই
আলাদা। জমিদার বাড়ির পুজোই গ্রামের লোকের আসল দুর্গাপুজো। সবার সেখানে অবাধ
যাতায়াত ও অধিকার।
যবে থেকে মা দুর্গার কাঠামো
বাঁধা শুরু হয় তবে থেকে উমার ব্যস্ততা শুরু হয়। উমা হলো জমিদার অতীন্দ্রমোহন
চৌধুরীর বড়ছেলে সূর্যনারায়ণ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী অহনা
চৌধুরীর একমাত্র সন্তান। তার ভাল নাম রাজনন্দিনী চৌধুরী, সবার আদরের উমা। সে-ই এখনও জমিদার বাড়ির একমাত্র সন্তান।
জমিদার বাড়ির ছোটছেলে চন্দ্রকান্ত চৌধুরী বিয়ে করবেন না জানিয়ে দিয়েছেন। দেশ ও
দশের সেবা তাঁর ব্রত। জমিদারবাবুর কন্যা শ্রীমতী সরযুবালাদেবীর বিয়ে হয়েছিল
দিল্লীবাসী গোবিন্দ মল্লিকের সাথে। গোবিন্দবাবুর কাপড়ের বড় ব্যবসা ছিল দিল্লিতে। অজ্ঞাত কারণে ব্যবসায় ভরাডুবি হয়ে গেলে স্ত্রী ও সন্তান ব্রজমোহনকে
নিয়ে বিগত একবছর ধরে শ্বশুর বাড়ি গোবিন্দনগরে বসবাস করেন।
প্রতিদিন সকাল থেকে মন্দিরের
চাতালে গিয়ে সত্যেন পাল ও তার ছেলের ঠাকুর গড়া দেখা আর পুটুরপুটুর করে তাদের
প্রশ্ন করা, এই ছিল উমার প্রধান কাজ দেবীর
কাঠামো বাঁধার প্রথম দিন থেকেই। মাঝে মাঝে সত্যেন হাঁপিয়ে বসে পড়লে উমা ছুটে
গিয়ে তার জন্যে জল নিয়ে আসে আর চা দেবার জন্যে তার মা'কে পীড়াপীড়ি করতে থাকে। জল চা খেয়ে সত্যেন একটু সুস্থ
হলে উমার প্রশ্ন শুরু হয় আর সে-ও সাধ্যমতো উত্তর দিতে থাকে।
মাঝে মাঝে জমিদার
অতীন্দ্রমোহন চৌধুরী দেখে হেসে বলেন,
-কী সত্যেন কেমন
কড়া নজরদারিতে পড়েছ? কাজ একদম নিখুঁত
হওয়া চাই তাছাড়া আমার দিদিভাইকে খুশি করতে পারবে না। আর জানোই তো দিদিভাই খুশি না হলে কী হবে।
সত্যেনও হেসে বলে,
-সে আর বলতে গো কর্তাবাবু, দিদিমনিকে খুশি করতেই হবে। দিদিমনি যে আমার সাক্ষাৎ মা
দুর্গা।
জমিদার বাবু তখন হেসে উমাকে
বলেন,
-দেখো দিদিভাই, সত্যেন দাদুকে যেন বেশি বিরক্ত করো-না ঠাকুর
তৈরিতে ভুল হয়ে যাবে।
-না গো কর্তাবাবু,
দিদিভাই
কিছু বিরক্ত করছে না উপরন্তু আমার কত খেয়াল রাখছে। কখন জল লাগবে, কখন চা লাগবে সব দিকে নজর রেখেছে।
উমা অভিযোগ করে বলেন,
-উঃ দাদু, তুমি এখন যাও তো সত্যেন দাদুর সাথে বকবক করে বিরক্ত করো না, ঠাকুর তৈরিতে ভুল হয়ে যাবে, দেরি হয়ে যাবে। পুজোর তো আর বেশি দেরি নেই।
জমিদার বাবু হেসে বলেন,
-ঠিক বলেছ দিদিভাই। তুমি
যেখানে তদারকি করছ সেখানে আমি থেকে আর কী করব! সত্যেন তুমি কঠিন মানুষের পাল্লায়
পড়েছ, মন দিয়ে কাজ করো। আমি বরং
অন্যদিকে দেখাশোনা করি।
এভাবেই চলতে থাকে উমার
ব্যস্ততা। কিন্তু বিসর্জনের জন্যে প্রতিমা বরণের আগে থেকে সেই উমাকে খুঁজে পাওয়া
যাচ্ছে না। জমিদার বাড়ির দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন বলে কথা, অনেক লোকের সমাগম ঘটেছে। পুজোর আগে থেকেই বাড়িতে যেমন
প্রচুর আত্মীয়স্বজনের আগমন ঘটেছিল তেমনই পুজোর প্রতিটি দিন প্রচুর লোকের সমাগম
ঘটেছে। কথায় বলে বেশি ভাল, ভাল নয়। জমিদারদের ভালমানুষির সুযোগ নিয়ে তাঁদের সুনামের
প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে কেউ কিছু করল কি না সেটাও বোঝা যাচ্ছে
না। পুলিশে খবর দেবার কথা বললে জমিদারবাবু বলেন,
-না না, এখনি পুলিশে খবর দেবার কোন দরকার নেই। প্রতিমা তৈরি করার
সময় থেকেই দিদিভাই খুব যুক্ত ছিল। প্রতিমা বিসর্জন হয়ে যাবে বলে আজ সকাল থেকেই
তার মন খারাপ। আমার মন বলছে, প্রতিমার বিসর্জন
সহ্য করতে পারবে না বলে দিদিভাই ঠিক অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে। তোমরা মহলের চারধারে
ভাল করে খুঁজে দেখো দিদিভাইকে ঠিক খুঁজে পাবে।
উমার মা অহনাকে কিছুতেই
বোঝানো যাচ্ছে না, সামলানোও যাচ্ছে না।
মাঝে মাঝেই অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন আর জ্ঞান ফিরলে উমার জামা, সাজের জিনিসগুলো জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। উমা জমিদার বাড়ির
একমাত্র সন্তান, সবাই নানারকম পোশাক
কিনে দিয়েছে। সব পরাও হয়ে ওঠেনি এখনও। অহনা নিজে বাজারে গিয়ে পোশাকের সাথে
মিলিয়ে মিলিয়ে সাজের জিনিসপত্র কিনে এনেছে। সব আছে পড়ে, শুধু যে পরার সে-ই নিখোঁজ।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment