প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা ~ ~ ~ নাম নয় মানই বিবেচ্য

শারদ | উৎসবের অঙ্গীকার

  বাতায়ন/শারদ/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন , ১৪৩২ শারদ | সম্পাদকীয়   উৎসবের অঙ্গীকার "নারীতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে পুরুষতন্ত্...

Monday, September 15, 2025

নিরুদ্দেশের পথে | মণিজিঞ্জির সান্যাল

বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
মণিজিঞ্জির সান্যাল
 
নিরুদ্দেশের পথে

"অনেকে বলে বয়স বাড়ছেকৈশোর আর নেই। যৌবনও চলে যাবে কোন একদিন। মন বলে বেশ হয়েছেভালই আছিসতেজ আছি সব ঋতুতে। বয়স মাপার যন্ত্র দিয়ে মাপা যাবে জন্ম-তারিখসতেজতা মাপা যাবে কি মনকে কাছে নিয়ে?"

প্রকৃতি যেভাবে পেতে রাখে নরম ঘাসের চাদর কঠিন মাটির বুকে, আমিও সেভাবেই ঢেকে রাখি আমার যা কিছু। তোমার চলার আঘাতে যেমন ওরা নুয়ে পড়ে মাটিতে, আমিও তেমন সহ্য করি তোমার সকল অস্বাভাবিকতা। হ্যাঁ আমার আর রূপসার যাপনের কথা...

 
আমি আর রূপসা দুজনেই মাঝেমধ্যে বেরিয়ে পড়ি অচেনা অজানা প্রান্তরে। আসলে সবুজ প্রান্তর আমাদের যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। ঘরবাড়ি সবকিছু ভুলে গিয়ে আমরা ছেলেমানুষের মতো ঘুরে বেড়াই যখন যেখানে যেদিন মন চায়।
 
অদ্ভুত ব্যাপার, সবাই আমাদের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। দুজন মহিলা এভাবে প্রকৃতির কোলে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে! এ যেন তাদের কাছে এক বিস্ময়। পুরুষ ছাড়া আবার আনন্দ হয় নাকি? অনেকের কাছেই অদ্ভুত এক প্রশ্ন চিহ্ন। কিন্তু সত্যিই আমরা ছেলেমানুষ হয়ে যাই যখন পরস্পর আমরা একসঙ্গে কিছুটা সময় কাটাই। মাঝে মাঝে বিনা কারণেই হাসতে থাকি, কখন আবার গানের লড়াইয়ে মেতে উঠি। মাঝে মাঝে শুধুই কবিতা, কখন আবার কোনকিছুই নয়, নিস্তব্ধ নির্জন প্রান্তরে চুপচাপ বসে শুধু পাহাড়ি পাখির আওয়াজকে নিবিড় করে কাছে পাওয়া। কখনবা ঝরনার কলতান, কোনোদিন তিস্তার অক্লান্ত বয়ে যাওয়াকে শুধুই দুচোখ ভরে অনুভব করা। অবাক হয়ে নিশ্চুপে ফিশফিশে কিছু কথা আর নীরবে শুধুই দেখে যাওয়া লাস্যময়ী তিস্তাকে! ওর প্রেমিক পাহাড় কত যত্নে আগলে রেখেছে। নিশ্চিন্ত তিস্তা বয়ে চলেছে আপন বেগে, আপন ছন্দে।
 
আমি আর রূপসা কখন করোনেশন ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখি, মনটা কেমন হয়ে যায়। কখন আবার ছোট্টবেলার মতো বৃষ্টির সাথে লুকোচুরি খেলি। বর্ষার অবিরাম ধারাস্রোতে ভিজতে থাকি আপনমনে।   
 
অনেকে বলে বয়স বাড়ছে, কৈশোর আর নেই। যৌবনও চলে যাবে কোন একদিন। মন বলে বেশ হয়েছে, ভালই আছি, সতেজ আছি সব ঋতুতে। বয়স মাপার যন্ত্র দিয়ে মাপা যাবে জন্ম-তারিখ, সতেজতা মাপা যাবে কি মনকে কাছে নিয়ে? আঠারো বছর বয়সকে আজও আমরা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।
 
আমি লিখি আর রূপসা আমাকে লেখার ইন্ধন জোগায়। আমাদের মিলিত সুর থেকে প্রথম শব্দ ধ্বনিত হয় ভালবাসা, না বুঝতে চাইলে বোঝানো যায় না কিছু, না শুনতে চাইলে শোনানোও যায় না কিছু। কিন্তু রূপসা আমার সব কিছু শোনে, আমি বলে যাই আমার কথা আমার ভাবনা অনুসারে, ও কোন বাধা দেয় না। ভালবাসা আমার কাছে সুস্থ বিবেক, সংশয়হীন মনের আহ্বান। কিছু দিতে গেলে হৃদয় চাই, কিছু পেতে হলে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে নিজের মতো করে।
 
রূপসার কাছে প্রেম, ভালবাসার কোন মুল্য নেই। রূপসা আর বলে দু বেলা খাবারের জন্যে যখন সংগ্রাম করতে হবে, শতছিন্ন কাপড় দিয়ে যখন লজ্জা ঢাকতে হবে, খাবারের ভাগ নিয়ে যখন লড়াই করতে হবে, তখনই প্রেমের মূল্যের জয়গান করা উচিত। ওর সঙ্গে থাকতে থাকতে ওর কথাগুলো চিন্তা করতে করতে জীবনের রূপটা, জীবনের ছবিটা কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে যায়। যৌবনের কঠিন সময়ে দেহের বিনিময়ে যারা পেটের খিদের জ্বালা মেটায়, যৌবনের শেষের দিনগুলোতে তাদের দেহ পড়ে থাকে ডাস্টবিনে। এই ভয়াবহ বাস্তব ছবি থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন রাস্তা আছে কিনা রূপসা অনেক্ষণ ধরে সেদিন ভাবছিল। হঠাৎ পাহাড়ি বৃষ্টি এসে ওকে ওর ভাবনার হাত থেকে মুক্তি দিল।
 
রূপসাকে ওর ভাবের জগত থেকে সরিয়ে আমি এলাম অন্য প্রসঙ্গে, বললাম "সামনে পুজো প্লিজ হেল্প কর, অনেক লেখা লিখতে হবে। কে কেমন সাজছে, কে কোথায় যাচ্ছে, কে কী খাচ্ছে।"
 
আমাকে ভাল করে কিছুক্ষণ দেখল, করুণ চোখের দৃষ্টি ওর, বুঝিয়ে দিল অন্য ভাষা। আমাকে খুশি করতে ওর সমস্ত ভাবনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে আমাকে দুটো দিন সময় দিল পুরোপুরি। পরিচয় করিয়ে দিল অর্ক, সায়ন, নীলাঞ্জন, রূপম, তমসা, প্রিয়াঙ্কা, দেবযানী আরও অনেকের সঙ্গে।
 
তাদের সঙ্গে পরিচয়ের পাশাপাশি জানলাম ওদের লাইফ স্টাইল, ওদের ইমোশন, আর কত কী। ওদের কেউ কেউ পুজোতে সাবেকিয়ানাকে বজায় রাখতে চায়। মানে খাওয়াদাওয়া বলতে লুচি, ছোলার ডাল, কষা মাংস। আর পোশাকে অষ্টমীতে ধুতি মাস্ট অবশ্যই পরিবারের সঙ্গে
 
সন্দীপ আর অর্ক নতুন নতুন গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে ভ্রমণ। মানে বছরে বছরে ডজন ডজন গার্ল ফ্রেন্ড, তমসার চিত্রটা একটু আলাদা। ওর কাছে পুজো মানেই আশি শতকের সেই গানগুলো। কিশোর কুমারের "সেদিনও আকাশে ছিল কত তারা / আজও মনে আছে তোমারই কথা।"
 
ও নিজেও ভাল গান গায়। ওর গানে মুগ্ধ হয়ে পুজো প্যান্ডেলেই তো সবার সামনে সায়ন্তন ওর মনের কথা জানিয়ে ফেলেছিল। সে কী লজ্জা তমসার। একঝাঁক বন্ধুবান্ধবদের সামনে সেই নায়কোচিত বাচনভঙ্গি আজও তমসাকে অবাক করে।
 
রূপমের কাছে পু্জো মানে কোন তাড়া নেই। খাও-দাও আর ঘুমোও, আর প্রাণভরে আড্ডা মারো। দেবযানী অবশ্য পুজোর সময় কোনোদিনই নিজের শহরে থাকে না। আর কিছু হোক না হোক পুজোর সময় চিয়ারফুল লাল কোন লিপস্টিক, তাতে হিন্ট অফ পিঙ্ক। এই রংটা ঠোঁটে লাগালে ঠোঁটের টেক্সচার ঢেকে যায় না, ঠোঁটটা খুব নমনীয়ও লাগে। অর্কের কাছে আবার পুজো মানে ছেঁড়া জিন্‌স, ধুনুচি, নাইটক্লাব আর মস্তি। রিনিলার কাছে পুজো মানে জিমে একটুও ফাঁকি নয় কিন্তু খাবারের ব্যাপারে বিরিয়ানি থেকে বাঙালি খাবার, আর চতুর্থী-পঞ্চমীতে ফাঁকায় ঠাকুর দেখা। নীলাঞ্জনের কাছে পুজো মানে ফেসবুক আর মস্তি। অঞ্জন আবার পুজো মানে বোঝে ভদকা আর স্কোয়াস। শ্রীতমা সবচেয়ে বেশি নজর দিয়েছে ওজন কমানোয়, কারণ এবার পুজোয় চোলি ব্লাউজ পরবে বলে ঠিক করেছে, এছাড়া কিনেছে ব্যাকলেস।
-কী হল? কী দেখছিস অমনভাবে রূপসা?
-না তোকে দেখছি, তোর চিকচিক চোখগুলো! লেখার বিষয় পেয়ে তুই কত উচ্ছ্বসিত!
 
"কোনোদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে
           বসন্ত বাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
     ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেইক্ষণে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
     তোমার প্রাণের প্রান্তে, বিস্মৃত প্রদোষে
        হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নের মুরতি।"
 
 
                                                   (দুই)
 
রূপসা হঠাৎই আমাকে টানতে টানতে নিয়ে চলল অচেনা এক পথে। কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করার সাহস হল না কেন জানি। প্ল্যাটফর্মের কাছাকাছি এসে অর্ধউলঙ্গ এক মহিলাকে দেখল, তারপাশেই বসে আছে বছর বারো-তেরো বছরের এক অন্ধ মেয়ে, গায়ে চাকা চাকা দাগ। তার থেকে দু-হাত দূরে একটা জায়গায় এসে আমরা দাঁড়ালাম। আড়াই-তিন বছরের এক বাচ্চাকে তার মা নির্মমভাবে মারতে মারতে রেল লাইনের ধারে নিয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে পরিষ্কার একটা ট্রেনকে ছুটে আসতে দেখতে পাচ্ছি, কোন ভ্রূক্ষেপ না করে রূপসা আমাকে সেখান থেকে নিয়ে এল অন্য এক ঠিকানায়, এক অনাথ-আশ্রমে। তারপর সেখান থেকে বিভিন্ন হোম, যেখানে বাচ্চাগুলো অবহেলিত, শোষিত, নির্যাতিত। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে কেউ কেউ। শরীরে কোনোদিন একটা সুন্দর জামা নিয়ে কল্পনা করেনি। মনের মধ্যে একটু ভাল খাবারের ছবিকে কখনও প্রশ্রয় দেয়নি। শুধু সুস্থভাবে বাঁচার জন্য পরস্পর একটু জল, একটু আলো-বাতাসের জন্য কাড়াকাড়ি করেছে দিনের পর দিন।
 
সেখান থেকে বেরিয়ে আমি রূপসাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করলাম, মুখে কোন কথা নেই। জীবনের রংকে একটু মেলাতে লাগলাম নিজের কাছে। নিজের কাছে নিজেই লজ্জা পেলাম।
 
"করুণ মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান
            হৃদয় অঞ্জলি হতে মম।"
 
হঠাৎ দেখলাম একটা পাগলি সঙ্গে তিন-চার বছরের ছেলে। রাস্তার কিছু ছেলে পাগলিটাকে ঢিল মারছে। বাচ্চাটা কেমন অসহায় ভাবে তাকাচ্ছে।
 
"কেন মারছ তোমরা?" কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। ওরা তো যুগ যুগ ধরে এভাবেই মার খেয়ে আসছে, এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু হঠাৎ কী হল? এত ভিড় কেন? ছুটে গেলাম, দেখলাম একটা চারচাকা এসে পাগলিটাকে মেরে দিয়ে চলে গেছে। রক্তে ভেসে গেছে ওর সমস্ত শরীর। মায়ের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট ছেলেটা অসহায়ের মতো কাঁদছে। বাচ্চাটার এমনিই কোন পরিচয় ছিল না। ওর বাবাকে ও  চেনে না, দেখেইনি কোনদিন। ছেলেটা যার নষ্ট নক্ষত্র, পাওনা কিছুই থাকে না, মূল্যবোধ কিছুই নেই। পৃথিবীতে ছিল কেবল ওর পাগলি মা, আজ সেও চলে গেল। অপরাধ জগতের খাতায় আর একজনের সংখ্যা বাড়ল।
 
আমি ধীরে ধীরে রূপসার কাছে ফিরে এলাম। ভাষাহীন চোখে চেয়ে রইলাম ওর দিকে। মনে হল ও মনে মনে হাসছে, মনে হল ও যেন বলছে, "শুধু ঠাকুর ঘরে থেকে ঠাকুর ঠাকুর করে ঠাকুরের পায়ে মাথা ঠেকালে পূণ্য প্রার্থী হবে না।"
 
আর আমি ভাবছি, পুজোর সময় এই প্যান্ডেল থেকে ওই প্যান্ডেলে সবাই যখন ঘুড়ে বেড়াবে, এক রেস্তোরাঁ থেকে অন্য রেস্তোরাঁতে সবাই যখন নতুন নতুন ডিশের অর্ডার দেবে, তখন ওই মাতৃহারা ছোট্ট ছেলে ভিড়ের মাঝে ডাস্টবিন হাতিয়ে কোন সুস্বাদু খাবারের সন্ধান করবে।
'কতদিন আর এভাবে চলবে?'
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম নক্ষত্রের সমারোহ; কখন যে রূপসাকে টেনে নিয়ে গেছে অজানা কোন এক নিরুদ্দেশের পথে। পুজোর কটা দিন আমি আর রূপসা হয়তো খুঁজে বেড়াব তাদের। ভাবনার শেষ থেকে শুরু হবে আমাদের পথ চলা। কোন কথা হয়তো বলা হল না। দেওয়া হল না পুজোর ফুল। তাই তো মনে হয়,
"আমার আশার তরী বেড়ায় একুল-ওকুল ধরে, পাই না তারে কাছে, মুখ ফিরিয়ে তাই সে চলি বুকের ব্যথা নিয়ে।"
 
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

'ও মন তরে কে-বা পার করে...'


Popular Top 9 (Last 30 days)