বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | ছোটগল্প
মনোজ চ্যাটার্জী
অবিচল
"ঋতবাক অবাক হয়ে মানুষের অবিশ্বাস্য ক্লোনিং দেখে। সেই একই নবমীর বলিদান রক্তচক্ষু কাপালিক দুখীরামের হাতে। মোষবলি শেষ হলে দুখীরাম কাটা মোষের মুণ্ডু মাথায় নিয়ে ঘুরতে থাকে, তার চোখের কোণ বেয়ে মহিষের রক্ত গড়িয়ে পড়ে।"
-কি গো এবার পুজোয় কী প্রোগ্রাম করবে কিছু ঠিক করলে?
স্ত্রী অভিষিক্তার কথায় একটু চমকে ওঠে ঋতবাক, প্রায় এক মাস আগে থেকে বললেও এখনও সে কংক্রিট কিছু করতে পারেনি।
-তাই তো কী করি বলো তো, কোন জায়গার তো ট্রেনের টিকিট পাচ্ছি না, মাত্র ষাটদিন আগে টিকিট দেওয়ার কী যে নিয়ম
করেছে, খুলতে না খুলতেই দুশো ওয়েটিং।
-তাহলে আর কী, মাথায় হাত দিয়ে বসে
থাকো, আমি কিন্তু টিকিট পেয়েছে এমন
কেউ অফার করলেই তার সাথে ড্যাং ড্যাং করে চলে যাব এই বলে রাখছি।
বলেই পিছন ঘুরে ফিক করে একটু
হাসে অভিষিক্তা।
-তাই করো, আমি ছেলেকে নিয়ে
কলকাতায় ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখব।
-দেখো, বাবা-ছেলেতে হাউমাউ
করে কাঁদতে বসো না।
-ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন আমার মাথায় একটা নতুন আইডিয়া এসেছে, শুনবে কি?
-কী শুনি?
-আমার রবিমামা তো প্রায়ই ফোন করে খোঁজখবর নেয়, প্রায় প্রত্যেক বছরই পুজোতে গ্রামে যেতে
বলে, এবারও বলেছে, ওনার ছেলেরাও খুব আন্তরিক, আমরা গেলে ওদের নিশ্চয়ই অসুবিধা হবে না তাই বারবার যাওয়ার জন্য বলে।
-ওদের না অসুবিধা হলেও আমার ও ছেলের খুবই অসুবিধা হবে। ওসব
গ্রামে-ট্রামে ভাল ওয়াশরুম নেই,
বেসিন
নেই, নেট থাকে না, টাওয়ার থাকে না,
ছেলের
মনমতো খাবার, জল পাওয়া যাবে না, যা খুশি একটা আইডিয়া করলেই হল।
-তোমার একটু অসুবিধা হবে, সবকিছু ছিমছাম পাবে না, তবে কদিন একটু মানিয়ে
নিলে, ছেলে যে ওখানে গেলে কী খুশিই হবে, না গেলে তুমি বুঝতে পারবে না।
-তোমার যা খুশি কর,
ছেলের
শরীর খারাপ হলে তুমিই সামলাবে, এটা বলে রাখলাম।
কোনরকমে অভিষিক্তাকে নিমরাজি
করিয়ে পঞ্চমীর দিন দুপুরে বন্দেভারতে পুরুলিয়ার টিকিট কাটে ঋতবাক। সামনের দুটো
সিটে মা ও ছেলে বসেছে, পিছনের সিটে জানলার
ধারে ঋতবাক। কিছুক্ষণ চলার পরেই মা ও ছেলে আরামদায়ক কামরায় ঘুমিয়ে পড়ে। তার চোখে
ঘুম নেই, সে একটু একটু করে ফ্ল্যাশব্যাকে
চলে যায়।
বাবা আসানসোলের কাছে কোলিয়ারিতে কাজ করত।
ষষ্ঠীর সকালে সাতটায় পুরুলিয়ার লোকাল ট্রেন ছাড়ত। একটু চলার পরেই দামোদর স্টেশন ও
নদী, প্রকৃতি তার আদিগন্ত প্রসারিত
অপার রূপমহিমা নিয়ে অপূর্ব সরলতার আশিষ দিত। সেদিনের কৈশোর-নিকটস্থ বালকের মাথায়। অদ্ভুত সব স্টেশনের নাম, মধুকুন্ডা, মুরাড্ডি, রামকানালী, বেরো, আনাড়া ইত্যাদি। ছোটনাগপুর মালভূমি তার রূপ ও রূপহীনতার অনবদ্য মেলবন্ধন নিয়ে ছড়িয়ে আছে সুবিস্তৃত চরাচরে। তুলনায় উঁচু
স্থানের স্টেশনগুলি থেকে দেখা যায় কোথাও সুউচ্চ টিলা, দূরে পাহাড়ের সপ্রাণ স্থবির রুপ, ছোট ছোট নদীর মতো ঝোড়া বয়ে যায় উপত্যকায়, ইতস্তত ছড়ানোয় ছোট-বড় দীঘির কালো জলে গভীরতা কথা বলে সবুজ
তৃণভূমির সাথে। আবার কোথাও অতিকায় ফুটবল মাঠের মতো ছড়িয়ে আছে
গ্রানাইট ও নিস পাথরের চাতাল, যেখানে গ্রামের
মেয়েরা ফসল শুকোয় টাঁড়ে টাঁড়ে চলে গিয়ে। ওরা নামত পুরুলিয়া নয়, কুস্তাউর স্টেশনে। আসল নাম কুশটাঁড়, হয়তো ইংরেজদের বদান্যতায় এই নাম হয়েছে। কুশ একধরনের পবিত্র
ঘাস ও টাঁড় অর্থ অনুর্বর রুক্ষ ভূমি। তখন মামাবাড়ির গ্রাম যাওয়ার রাস্তা ছিল
কাঁচা। যানবাহন কিছু চলত না, রবিমামা বাড়ির মুনিষ
নবঘনশ্যাম ওরফে লবঘনাকে তার গোরুরগাড়ি নিয়ে স্টেশনে পাঠিয়ে দিতেন। ঘন্টাদুয়েক সেই
যাত্রাটা একটু কষ্টকর হলেও বাড়ির পাশেই পুজোর ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড় শব্দে আনন্দের বাদ্যি বাজত মনে।
-কী রে ভাগনা, কখন এলি রে?
এর উত্তর যে কতবার দিতে হত
তার কোন ইয়ত্তা নেই। অষ্টমীর খ্যান শুরু হতে আর বেশি বাকি নেই। আপাতনির্জন দুর্গামণ্ডপের চারপাশ গিজগিজ করছে লোকে। শুধু বলিকাঠের লাগোয়া ফাঁকা জায়গাতে একটি নধর
পাঁঠা বাঁধা আছে উৎসর্গের সিঁদুর মাখা হয়ে। পুরোহিতমশাইয়ের
উদাত্ত মন্ত্রপাঠের পর বলিদানের সময় হয়েছে। ঋতবাক জানে এখন ক্ষুদিরাম মামা আসবেন, গ্রামে সচরাচর যাকে দেখা যায় না। রোগা লিকলিকে চেহারা, পরনের পাঞ্জাবি বলিদানের জন্য খুলতেই দেখা যায় সরু সরু
হাড়ের উপর একটা পাতলা চামড়ার আস্তরণ যেন জড়িয়ে আছে। অথচ অবলীলায় এক কোপে পাঁঠাবলি করবেন। পরেরদিন নবমীপুজো। মণ্ডপে এসেই ঋতবাক অবাক হয়ে যায়
ক্ষুদিরামমামার আজকের রূপ দেখে। শুনেছে নবমীতে প্রায়
পঞ্চাশটা পাঁঠাবলি ও চারটে মোষবলি হয়। আজকে তার লাল চোখ, কাপালিকের মতো রুদ্রমূর্তি, একটার পর একটা পাঁঠা বলিকাঠে চাপানো হয় আর তিনি বলেন,
-আরও নিয়ে আয়, আরও নিয়ে আয়, মায়ের খিদে বলে কথা।
আশি কেজি ওজনের মোষের মাথাও
সব এক কোপে কেটে ফেললেন। তারপর সেই কাটা মোষের মুণ্ডু মাথায় নিয়ে গোটা গ্রাম
পরিভ্রমণ আর ফটকার পর বোমফটকা ফেটে যাচ্ছে, ছোটদের হাতে বাজিপটকার প্যাকেট দিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। উন্মাদনার কী অবিশ্বাস্য
প্রদর্শন।
এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে
গেছিল ঋতবাক বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারে ট্রেন চান্ডিল
স্টেশনের কাছাকাছি। সে নামার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বউ-ছেলেকে ঘুম
থেকে তুলে দেয়।
পুরুলিয়া থেকে গ্রামের
রাস্তায় যেতে যেতে সে অবাক। ঝাঁ চকচকে চওড়া পিচের রাস্তা। সাঁইসাঁই করে তাদের
গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে, আশেপাশের গ্রামে সব
পাকা বাড়ি, জলের কল, শুধু দূরের প্রকৃতি ছাড়া সব কেমন পালটে গেছে।
তাদের গ্রামেও তাই, কাঁচা মাটির বাড়ি
প্রায় নেই বললেই চলে। গ্রামের ভিতরের রাস্তাগুলোও সব ঢালাই রাস্তা। তবে পরেরদিন
সকালে চারপাশের পরিবেশের সৌন্দর্য দেখে অভিষিক্তার খুশি আর ধরে না। বাঁধনছাড়া
পরিবেশে ছেলেরও আনন্দের শেষ নেই।
গ্রামের ভক্তিনিবেদিত পুজো
দেখে অভিষিক্তা। বোধন, কলাবউ স্নান
ইত্যাদি সব কিছুতেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়ে। ঋতবাক অন্যদিকে ব্যস্ত থাকলেও
অষ্টমীর খ্যানের সময় দুর্গামণ্ডপে
উপস্থিত হয়। নতুন সুসজ্জিত আপাতনির্জন দুর্গামণ্ডপের সামনে যথারীতি ভিড় গিজগিজ করছে, শুধু বলিকাঠের লাগোয়া ফাঁকা জায়গাতে একটি নধর পাঁঠা বাঁধা আছে উৎসর্গের সিঁদুর
মাখা হয়ে। হঠাৎ একজনকে আসতে দেখে ঋতবাকের চোখ কপালে উঠে যায়। একি আজ প্রায়
পয়তাল্লিশ বছর পরে সেই একই ক্ষুদিরামমামা কোথা থেকে আসছে? পয়তাল্লিশ বছরেও একটা মানুষের কোনও পরিবর্তন
নেই! সে পাশে দাঁড়িয়ে এক বয়স্ক মামাকে জিঞ্জেস করে,
-ইনি কি সেই ক্ষুদিরাম মামাই?
-না গো ভাগনা, সি তো কবেই চলে গ্যাছে, তার ছিলাও আর বেইচ্যেঁ নাই, ই হলো ক্ষুদিরামের নাতি দুখীরাম।
ঋতবাক অবাক হয়ে মানুষের
অবিশ্বাস্য ক্লোনিং দেখে। সেই একই নবমীর বলিদান রক্তচক্ষু কাপালিক দুখীরামের হাতে।
মোষবলি শেষ হলে দুখীরাম কাটা মোষের মুণ্ডু মাথায় নিয়ে ঘুরতে থাকে, তার চোখের কোণ বেয়ে মহিষের রক্ত গড়িয়ে পড়ে।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment